
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে নিজেদের অনুগত না হওয়া কোনো দেশকে শায়েস্তা করার জন্য পশ্চিমারা প্রায়ই অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে থাকে। পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে এক গবেষণায়।
সম্প্রতিক এক গবেষণায় পশ্চিমাদের এই ‘মোক্ষম হাতিয়ারে’ বেঘোরে প্রাণ হারানো তৃতীয় বিশ্বের মানুষের একটি পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। দ্য ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একতরফা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্বজুড়ে ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ও এই নিষেধাজ্ঞা কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে আল-জাজিরায় যৌথভাবে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যাপক জেসন হিকেল, ম্যাকুয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল সায়েন্সের ফেলো ডিলান সুলিভান এবং ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক ওমর তাইয়্যেব।
তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ বহুদিন ধরেই একতরফা নিষেধাজ্ঞাকে সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এর মাধ্যমে তারা গ্লোবাল সাউথের এমন সব সরকারকে শাস্তি দিতে বা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে, যারা পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত থেকে স্বাধীন পথ খুঁজতে চেয়েছে এবং প্রকৃত অর্থে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
গ্লোবাল সাউথ বা বৈশ্বিক দক্ষিণ বলতে সাধারণত সেই দেশগুলোকে বোঝানো হয়, যেগুলো তুলনামূলকভাবে কম উন্নত বা উন্নয়নশীল এবং প্রধানত এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০-এর দশকে গড়ে প্রায় ১৫টি দেশ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। এসব নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া, শিল্প খাত অস্থিতিশীল করা এবং সংকট তৈরি করে রাষ্ট্র ভেঙে ফেলা।
এরপর থেকে একতরফা নিষেধাজ্ঞার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে গড়ে প্রায় ৩০টি দেশ নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিল। আর এখন, ২০২০-এর দশকে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০টিরও বেশি—যা গ্লোবাল সাউথের বিশাল অংশকে জড়িয়ে ফেলেছে।
নিষেধাজ্ঞার মানবিক মাশুল ভয়াবহ। ১৯৯০-এর দশকে ইরাকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে দেখা দেয় ব্যাপক অপুষ্টি, খাবার পানির সংকট, ওষুধ ও বিদ্যুতের ঘাটতি। সাম্প্রতিক সময়ে ভেনেজুয়েলায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবরোধ চরম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এক বছরেই নিষেধাজ্ঞার কারণে অতিরিক্ত ৪০ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ১৯৭০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু জড়িত। ১৯৯০-এর দশকের কিছু বছরে এ সংখ্যা মিলিয়নের ঘর ছাড়ায়। কেবল ২০২১ সালেই নিষেধাজ্ঞার কারণে মারা গেছেন ৮ লাখেরও বেশি মানুষ।
গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি বছর নিষেধাজ্ঞার কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহতদের (গড়ে প্রায় ১ লাখ) চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। ভুক্তভোগীদের অর্ধেকের বেশি শিশু ও বৃদ্ধ, যারা অপুষ্টি ও বিভিন্ন রোগে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ২০১২ সালের পর থেকে নিষেধাজ্ঞায় শুধু শিশু মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ লাখের বেশি।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যই হলো ক্ষুধা ও বঞ্চনা তৈরি করা—এটি দুর্ঘটনাজনিত পরিণতি নয়। এর প্রমাণ মেলে ১৯৬০ সালের এপ্রিলের মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক নথিতে। সেখানে কিউবার বিপ্লব ও ফিদেল কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, কিউবার অর্থনীতি দুর্বল করতে ‘অর্থ ও সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া’, ‘মজুরি কমানো’ এবং ‘ক্ষুধা, হতাশা ও সরকারের পতন ঘটানো’ জরুরি।
গবেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলো যদি আরও স্বাধীন পথে হাঁটতে চায়, তবে তাদের নিজেদের বিকল্প ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। এতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ‘প্রতিক্রিয়া’ বা পাল্টা আঘাত থেকে তারা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারবে। সার্বভৌম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এই পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে জরুরি নয়, বরং একটি নৈতিক কর্তব্যও। বছরে অর্ধমিলিয়নের বেশি মানুষকে হত্যা করে পশ্চিমা আধিপত্য টিকিয়ে রাখা মানবতার জন্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
তথ্যসূত্র:
1. US and EU sanctions have killed 38 million people since 1970
– https://tinyurl.com/36svkmcc


