দক্ষিণ চট্টগ্রামে আওয়ামী শাসন আমলে এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় ১০ গ্রামবাসীকে হত্যা করে পুলিশ

0
71

চট্টগ্রাম শহর থেকে কর্ণফুলী নদী পার হয়ে একদিকে কক্সবাজার আর অন্যদিকে বান্দরবানের আগের সাতটি উপজেলা দক্ষিণ চট্টগ্রাম হিসেবে পরিচিত। অসংখ্য নদী ও খালবেষ্টিত সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠসমৃদ্ধ এলাকাটি রাজনৈতিক সহাবস্থান ও শান্তির জনপদ হিসেবে পরিচিত ছিল।

তবে বিগত দেড় দশক এ অঞ্চলকে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রতীকে পরিণত করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পুলিশ প্রশাসন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, পটিয়া এবং বোয়ালখালী উপজেলার মধ্যে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতবিক্ষত হয় আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনামলে।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের নামে এখানে যা ঘটেছে, তা মানবতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই দুই উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা ও অপহরণের ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। এর বাইরে জামায়াতের দুই সক্রিয় কর্মীকে অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যার ঘটনাও ঘটে সাতকানিয়ায়।

জামায়াতে ইসলামীর নেতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তি আন্দোলনে সাতকানিয়ায় নিহত হয় চারজন। এর মধ্যে একদিনেই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় কিশোরসহ তিনজন। ধরে নিয়ে পায়ে গুলি করে চিরতরে পঙ্গু করে দেওয়া হয় একাধিক নেতাকর্মীকে।

অপহরণের পর দুই জামায়াতকর্মীকে হত্যা

সাতকানিয়ার জামায়াতকর্মী আব্দুল হাকিম (৪৫) এবং কামাল উদ্দিনকে (৪০) ২০১১ সালের ১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের শীর্ষ সন্ত্রাসী বশির বাহিনীর প্রধান বশিরের নেতৃত্বে অপহরণ করা হয়। পরদিন আব্দুল হাকিমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয় সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের রূপকানিয়া এলাকার হাতিয়ার খাল থেকে। এর একদিন পর একই খালের ডলুনদীর মোহনা থেকে উদ্ধার করা হয় কামাল উদ্দিনের লাশ।

পুলিশের গুলিতে ঝরে পড়া প্রাণ

২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে স্থানীয় জনতা। এ সময় সাতকানিয়া থানা পুলিশের একটি বিশাল দল কোনো ধরনের সতর্কতা জারি ছাড়াই রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসুক জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। এতে আহত হন অন্তত অর্ধশত মানুষ। গ্রেপ্তার করা হয় বেশ কয়েকজনকে। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কিশোর শহীদুল ইসলাম (১৩) ও আবু তাহেরের (২৭) মৃত্যু হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান ওসমান গনি (৩০) নামে আরেকজন। এছাড়া পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন একই এলাকার বাসিন্দা আবু ছালেহ (৩৮)। গুলিবিদ্ধ অনেকে এখনো দুঃসহ যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন।

কথিত ক্রসফায়ারে হত্যা

২০১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়ার বার্মা কলোনি এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছদাহা ইউনিয়ন জামায়াতের নেতা মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন। একই সময় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়ে পরে এক পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যান মোহাম্মদ রফিক। পঙ্গু মোহাম্মদ রফিক গণমাধ্যমকে বলেন, জসিমকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পায়ের সঙ্গে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আমাকে চিরতরে পঙ্গু করে দেয়।

২০১৬ সালের ১৬ অক্টোবর ভোরে পুলিশ পশ্চিম সাতকানিয়া থেকে কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার জামায়াতকর্মী আবুল বশরকে (৪০) গ্রেপ্তার করে। পরে অস্ত্র উদ্ধারের নামে তাকে ওই দিন ভোরে এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা এলাকায় নিয়ে গুলি করে হত্যা করে কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে বলে দাবি করে পুলিশ। সাতকানিয়া থানার তৎকালীন ওসি ফরিদ উদ্দিন খন্দকারের নেতৃত্বে এএসআই হিরু বিকাশ দে গুলি করে বশরকে হত্যা করেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

জঙ্গি নাটক

বাঁশখালী উপজেলার সাধনপুর ইউনিয়নের দুর্গম লটমণি পাহাড়ে মুরগির খামার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন মোবারক আলী। ২০১৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে হঠাৎ কয়েক হাজার র‌্যাব সদস্য ঘিরে ফেলে পুরো এলাকা। বলা হয়, খামারের আড়ালে জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলত সেখানে। কয়েক ঘণ্টার নাটকীয়তা শেষে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের দাবি করা হয় সেখান থেকে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে আনা পাঁচ যুবককে কথিত জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গ্রেপ্তারদের মধ্যে ছিলেন ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার মিঠাপুকুর গ্রামের আইয়ুব আলীর ছেলে মোবাশ্বের হোসেন (১৭), ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গাছোয়াপাড়া গ্রামের নূর মোহাম্মদের ছেলে আব্দুল খালেক হুরাইরা (২১), টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উড়িয়াবাড়ী গ্রামের চান মিয়ার ছেলে আমিনুল ইসলাম হামজা (২২), একই জেলার মির্জাপুরের মাহমুদপুর গ্রামের দরবেশ আলীর ছেলে হাবিবুর রহমান তাসিম (১৯) এবং গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কয়েখাঁ গ্রামের মোফাজ্জল হোসেনের ছেলে আমির হোসেন ইসহাক (২৫)।

তথাকথিত অভিযান শেষে র‌্যাব দাবি করে, লটমণি পাহাড়ে জঙ্গি আস্তানা তৈরি করে অস্ত্র, বোমা তৈরি ও জঙ্গি প্রশিক্ষণ হচ্ছিল আজিজুল হক ও পারভেজ নামে দুজনের নেতৃত্বে।

ওই ঘটনার পর চট্টগ্রামের আলেম-ওলামাদের ওপর চলে আরেক দফা নির্যাতন। এর কয়েকদিন পর হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে ২৫ জনকে আটক করে র‌্যাব। এর মধ্যে ১২ জনকে লটমণি পাহাড়ের কথিত জঙ্গিসংশ্লিষ্টতায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

ছাদ থেকে ফেলে হত্যা

২০১৩ সালের ১৩ মার্চ গভীর রাতে নগরীর রাহাত্তারপুল এলাকার সৌরভী আবাসিকের একটি বাড়ি ঘিরে ফেলে পুলিশ। বাড়িটিতে জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর ছোট ভাই সাপ্তাহিক সময়ের প্রয়াস পত্রিকার প্রকাশক মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করত।

প্রত্যক্ষদর্শীরা গণমাধ্যমকে জানান, পুলিশ সদস্যরা শাহজাহান চৌধুরীর খোঁজে প্রতিটি রুমে তল্লাশি শুরু করে। তাকে না পেয়ে ওই বাড়ির নারীদের সঙ্গেও অশোভন আচরণ করে। অভিযানের একপর্যায়ে শাহজাহান চৌধুরীর ভাগনে সাতকানিয়া সরকারি কলেজের মেধাবী ছাত্র মঈনুদ্দিন হাসান মুন্নাকে আটক করে ভবনের ছাদে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে শাহজাহান চৌধুরীর সন্ধান দেওয়ার জন্য মুন্নার ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। একপর্যায়ে তাকে ভবনের ছাদ থেকে লাথি মেরে নিচে ফেলে হত্যা করে।

নদভীর গজবি শাসনে চিরতরে পঙ্গু অনেকে

আওয়ামী শাসনামলে এই এলাকায় পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন অন্তত ৩৫ জন। এর মধ্যে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন নারীসহ পাঁচজন। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর ইন্ধনে পুলিশ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়।

২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর রাতে সাতকানিয়ার এওচিয়া-মার্দাশা ইউনিয়নসংলগ্ন পাহাড়তলী আলীনগর এলাকায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (দক্ষিণ) নাজমুল হাসান ও চট্টগ্রামের রিজার্ভ অফিসার কাজী শফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একদল পুলিশ আবু তাহের নামে একজনের খামারবাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে। কথিত অস্ত্র উদ্ধারের নামে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে তার পা কেটে ফেলতে হয়।

গায়েবি মামলা

আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাত থানায় পাঁচ শতাধিক গায়েবি মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের অন্তত ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। বাদ যাননি এলডিপির নেতাকর্মীরাও। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় জামায়াতের বিরুদ্ধে ২৮৮টি, বিএনপির বিরুদ্ধে ৩৭টি, চন্দনাইশে এলডিপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৫টি, জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ১০টি, লোহাগাড়ায় জামায়াত ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয় দুই শতাধিক। পটিয়ায় বিএনপি ও জামায়াত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা অর্ধশতাধিক। এসব মামলায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি মসজিদের ইমাম এবং মাদরাসার শিক্ষকদেরও আসামি করা হতো।

এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে ১০ জনকে গুলি করে হত্যা

বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা এলাকায় সরকারি জমির পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জমি দখল ও সাগর ভরাট করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নিমার্ণের কাজ শুরু করেছিল শিল্প গ্রুপ এস আলম। পরিবেশবিধ্বংসী ওই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন স্থানীয়রা। এ সময় গ্রামবাসীর ওপর দুই দফায় নির্বিচারে গুলি করে ১০ জনকে হত্যা করে পুলিশ।

প্রথম সংঘর্ষ হয় প্রকল্পের শুরুতে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল। দুদিন ধরে চলা সংঘর্ষে নিহত হন চারজন। ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল প্রকল্পের শেষ সময়ে এস আলম গ্রুপের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফের ফুঁসে ওঠেন এলাকাবাসী। এবারো দানবীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় পুলিশ। গুলি করে হত্যা করে ছয়জনকে। দুই ঘটনায় পুলিশ ও এস আলম গ্রুপের ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হন শতাধিক গ্রামবাসী।


তথ্যসূত্র:
১. এস আলমের বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষায় ১০ গ্রামবাসীকে হত্যা পুলিশের
-https://tinyurl.com/yrtbj5d6

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ২৮ লক্ষ নারী শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে: মুত্তাকি হাফিযাহুল্লাহ
পরবর্তী নিবন্ধআ.লীগ নেতার সুপারিশে চাকুরি পেয়ে ‘পত্রিকার হকারের ছেলে’ থেকে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক হিন্দু কর্মকর্তা