হয়ত প্রথম বারের মত আপনি এই মহা মনীষীর সাথে পরিচিত হচ্ছেন। শায়খ আবু বকর ইবনে উমর আল-লামতূনী রহিমাহুল্লাহ। দাওয়াতুল মুরাবিত্বীনের প্রতিষ্ঠাতা শাইখ আব্দুল্লাহ ইবনে ইয়াসিন রহ. শাহাদাৎ বরণ করার পর আবু বকর ইবনে উমর আল-লামতূনী ৪৫১হিজরী মোতাবেক ১০৫৯ সনে দাওয়াতুল মুরাবিত্বীনের দায়িত্ব হাতে নেন ।
আবু বকর ইবনে উমর আল-লামতূনী ছিলেন বিদগ্ধ আলেম ও দক্ষ রাজনীতিবিদ। তাঁর নেতৃত্বের দুই বছরের মধ্যে উত্তর সেনেগাল ও দক্ষিণ মৌরিতানিয়ার কিছু অঞ্চল নিয়ে “দাওলাতুল মুরাবিত্বীনাস্ সুগরা” নামে ছোট একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
তিনি ‘‘দাওয়াতুল মুরাবিত্বীনের” দায়িত্বে থাকাকালে মরক্কো এবং মৌরিতানিয়ার সীমান্ত এলাকায় কয়েকটি বর্বর জাতিগোষ্ঠির মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তা দমনের লক্ষ্যে মুরাবিত্বীনের এক বাহিনী সাথে নিয়ে দাঙ্গা কবলিত এলাকায় গমন করেন। এ সময় তিনি তাঁর চাচাত ভাই ইউসুফ বিন তাশফীনকে দাওয়াতুল মুরাবিত্বীনের ভারপ্রাপ্ত আমীর নিযুক্ত করে যান।
দাঙ্গা কবলিত এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পর তিনি মানুষকে ইসলামের দিকে আহ্বান করার জন্য পশ্চিম আফ্রিকার পথে রওয়ানা হন।
সেখানে পৌঁছে তিনি দেখতে পান কিছু গোত্র মূর্তিপূজাও করছে। তাদের কাছে আদৌ ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি। এমন পরিস্থিতিতে শাইখ রহ. তাঁর সাথে থাকা সাত হাজার আফ্রিকান মুসলিম নিয়ে তাদের মাঝে দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে নিরলসভাবে কাজ করেন । তাদের দাওয়াতে অনেকেই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। অবশিষ্টরা শাইখের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে দীর্ঘ যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধ এবং দাওয়াতী কর্মতৎপরতা একই সাথে চলতে থাকে।
দাওলাতুল মুরাবিত্বীন ছেড়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ ১৫ বছর তিনি আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচার করেন। ১৫ বছর পর ৪৬৮ হিজরী ১০৭৬ সনে পুনরায় মৌরিতানিয়ায় ফিরে আসেন।
এদিকে তাঁর চাচাতো ভাই ইউসুফ বিন তাশফীন সেনেগাল, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার মতো দেশগুলোকে দাওলাতুল মুরাবিত্বীনের অধীনে নিয়ে আসতে সক্ষম হন।
ইউসুফ বিন তাশফীন যে বাহিনী গঠন করেছিলেন তাতে কেবল অশ্বারোহী যোদ্ধার সংখ্যা ছিল পাঁচ লক্ষ। ইউসুফ বিন তাশফীনের শাসনাধীন অঞ্চলসমূহ “দাওলাতুল মুরাবিত্বীনাল্ কুবরা” নাম ধারণ করে।
শাইখ আবু বকর ইবনে ওমর রহ. তাঁর চাচাতো ভাইয়ের বিজয় ও সফলতা দেখে অনেক খুশি হলেন । শাইখ রহ. তাঁর চাচাতো ভাইকে খোদাভীরু, দুনিয়াত্যাগী ও দ্বীনের একজন বিজ্ঞ আলেম হিসেবে দেখতে পান।
আবু বকর ইবনে উমর আল-লামতূনী যে কাজে নিজেকে আজীবন নিয়োজিত রেখেছিলেন তা কেবল সেই ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব যিনি ঈমান ও দাওয়াহ ইলাল্লাহর স্বাদ আস্বাদন করতে পেরেছেন। তাইতো তিনি তার চাচাতো ভাই আমীর ইউসুফ বিন তাশিফীনকে বললেন- হে প্রিয় ভাই! রাষ্ট্র পরিচালনার স্বভাবজাত যোগ্যতা তোমার মাঝে আমার চেয়ে বেশি রয়েছে। তাই এর উপযুক্ত তুমিই। এদিকে আমি পেয়েছি মানুষকে ইসলামে দীক্ষিত করার স্বাদ। তাই মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্য আমি আবারো ফিরে যেতে চাই আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে।।
শাইখ আবু বকর বিন ওমর আল-লামতূনী রহ. নিজ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আফ্রিকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ফিরে গেলেন এবং দ্বীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিলেন দূর-বহুদূরে। এক সময় তাঁর দাওয়াতে গিনি বিসাউ, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, মালি, বুরকিনা ফাসু, নাইজার, ঘানা, বেনীন, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা এবং গ্যাবন ইত্যাদি দেশ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
আফ্রিকার পনেরও অধিক দেশে তিনি ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেন। তাঁর এই কর্মময় জীবনের শেষে কোন এক বিজয় যুদ্ধে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। আল্লাহ তাঁর উপর রহম করুন।
হাফেজ ইবনে কাসীর রহ. আল বিদায়া ওয়ান নিহায় গ্রন্থে লিখেছেন- আবু বকর ইবনে ওমর রহ. একসময় ঘানায় ছিলেন। ওই সময় তাঁর সাথে ছিল এত বেশি সংখ্যক সহচর, যা কোন রাজা-বাদশাহ ও সরকার প্রধানের সাথেও থাকত না। তিনি যখন শত্রুর মোকাবেলায় বের হতেন, তখন তার সাথে থাকতেন পাঁচ লক্ষ জানবাজ যোদ্ধা। তারা সবাই তাঁর অনুগত ছিলেন, কেউ তাঁর বিরোধী ছিলেন না।
পাশাপাশি তিনি শরিয়তের হদ কায়েম করতেন এবং ইসলামের সম্মান সমুন্নত রাখতেন, আর দ্বীনের হেফাজতে তিনি থাকতেন সদা তৎপর। মানুষের দৃষ্টিতেও তিনি ছিলেন শরিয়তের জীবন্ত আদর্শ। তিনি সঠিক দ্বীন ও আকিদার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি আব্বাসীয় শাসন ব্যবস্থাকে সমর্থন করতেন। কোন এক যুদ্ধে এই মহা মানবের গলায় তীর বিদ্ধ হলে তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন।
ড. সাল্লাভী “ আল জাওহারুস সামীন বি মা’রেফাতী দাওলাতিল মুরাবিতীন” গ্রন্থে উল্লেখ করেন- শাইখ আবু বকর ইবনে ওমর রহ. ছিলেন মুরাবিত্বীনের সর্বোচ্চ নেতা, মুত্ত্বাকী, ধার্মিক এবং আল্লাহর পথে শহীদ হতে সদা উদগ্রীব। বিভক্ত মরক্কোকে একীভূত করতে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য।
তিনি মরুভূমির প্রান্তে প্রান্তে এবং সেনেগাল ও নাইজারের সীমান্ত পর্যন্ত ইসলামের বাণী প্রচার করেছেন। পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে আমরণ যুদ্ধ করেছেন। অবশেষে তারা ইসলামের শৌর্যবীর্যের সামনে মাথা নত করেছে।
তাঁর প্রচেষ্টায় অসংখ্য কৃষ্ণাঙ্গ ইসলামে দীক্ষিত হয়ে “দাওলাতুল মুরাবিত্বীন” এর গোড়াপত্তনে ভূমিকা রাখেন। তারা স্পেনের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা “দাওলাতুল মুরাবিত্বীনকে সুসভ্য রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
তথ্যসূত্র:
আল কামেল/ ইবনে আসির
সিয়ারু আলামুন নুবালা
তারিখুল ইসলাম
আল বয়ানুল মাগরিব
তারিখে ইবনে খালদুন