খরসাঁওয়ার চাঁদনি চকের পাকা রাস্তায় ভোটের প্রচারে ঘুরছে সন্ত্রাসী দল বিজেপি-র বাইকবাহিনী। জনা পঞ্চাশেক গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা যুবক। মুখে মোদী-মুখোশ। ধ্বনি উঠছে, ‘জয় শ্রীরাম।’
সে আওয়াজ শুনছে পলেস্তারাহীন ইটের দেওয়াল। ভিতরে পায়ে-চালানো সেলাই মেশিন। ভরদুপুরেও টিমটিম করে জ্বলছে বাল্ব। দরজার সামনে খাটিয়ায় বসে শাহিস্তা আনসারি। পাশে মা শাহনাজ। শাহিস্তার হাতে বছর চব্বিশের এক যুবকের ফটো। সমুদ্রের কিনারে দাঁড়িয়ে হাসছেন তাবরেজ আনসারি। মা বললেন, ‘‘মুম্বইয়ে তোলা তাবরেজের এই ফটোর দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে মেয়ে। জোর-জবরদস্তি করে খাওয়াতে হয়।’’
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দ বাজার পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশ, ভারতীয় মালাউন হিন্দুত্ববাদীদের এক দল গুণ্ডা কর্তৃক মুসলিম যুবক তাবরেজ আনসারীকে পিটিয়ে হত্যার ফটো-ভিডিয়ো অবশ্য দেখেছে তামাম দুনিয়া। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। এক দল উন্মত্ত হিন্দু গুণ্ডা লোহার র়ড, লাঠি দিয়ে মেরে চলেছে তাঁকে। ভিডিয়োতে শোনা যাচ্ছে, ‘বোল, জয় শ্রীরাম।’ গত ১৭ জুনের ঘটনা। পাঁচ দিন পরে, ২২ জুন মারা যান তবরেজ।
দেশজুড়ে হইচই শুরু হওয়ায় লোক দেখানোর জন্য ১১ জনকে গ্রেফতার করেছিল ঝাড়খণ্ডের মালাউন পুলিশ। কিন্তু ১০ সেপ্টেম্বর জানা যায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিটে খুনের ধারা (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা) দেওয়া হয়নি। আদালতে মালাউন পুলিশ জানিয়েছে, ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী, তাবরেজের মৃত্যুর কারণ ‘হার্ট-অ্যাটাক’। তাই দেওয়া হয়েছে অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর ৩০৪ ধারা।যা ছিল মালাউন পুলিশের চক্রান্ত্র।
মারা যাওয়ার মাস দু’য়েক আগে তাবরেজের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ১৯ বছরের শাহিস্তার। তিনি বলেন, ‘‘পুণেতে ওয়েল্ডিং মিস্ত্রির কাজ করত ও।
মৃত্যুর পরে মালাউন সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি শাহিস্তার কাছে। আসেননি কোনও বিরোধী নেতাও। শ্বশুরবাড়ি কদমডিহা থেকে শাহিস্তা চলে এসেছেন বাবার কাছে। বাবা মহম্মদ সরাফউদ্দিন পেশায় দর্জি। বড় মেয়ের এই অবস্থার পর ভেঙে পড়েছেন তিনি। শাহনাজ বলেন, ‘‘কখন কোথায় যে চলে যায়! পড়শিদের দয়ায় বেঁচে আছি।’’
সন্ত্রাসী দল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ গোড়া থেকেই অভিযুক্তদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল। খুনের ধারা না থাকায় তাদের জোর বাড়ে। এর মধ্যে জামশেদপুরের এমজেএম মেডিক্যাল কলেজের একটি দলও জানিয়ে দিয়েছিল, হিন্দু গুণ্ডাদের আঘাতে তাবরেজের খুলি ভেঙে গিয়েছিল, হার্ট-চেম্বারেও জমে ছিল রক্ত। এর ফলেই ‘হার্ট-অ্যাটাক’-এ মারা যান তিনি। পরে মালাউন পুলিশ বাধ্য হয়ে ১১ জনের নামে খুনের ধারা জুড়ে দেয়।
কিন্তু প্রশাসনের এই সামান্য ভূমিকায় অখুশি হয় সন্ত্রাসী দল বিজেপির কর্মীরা। বিজেপির সন্ত্রাসী কর্মী রমেশ সিংহ বলেছে, ‘‘তাবরেজ চোর ছিল! বৌটাও এত টাকা পেয়েছে যে ওর বাবাও দর্জির কাজ করে না। কত লোক আসছে ওকে টাকা দিতে! মামলা লড়াতে।’’ পাশ থেকে এক বিজেপি সন্তাসী কর্মী বলে, ‘‘পহেলু খানের মামলা তো জানেন। ভিডিয়ো থাকলেই কি সব হয়। আদালতে সাক্ষী দেবে কে?’’
সন্ত্রাসী দল বিজেপির ভয়ে কেউ তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে আদালতে যায় না যেমনটি হয়েছে মুসলিম ব্যবসায়ী পহেলু খানের মামলাতে। তাকেও হিন্দু সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করেছিল।
তাই প্রতিনিয়ত লড়ছে শাহিস্তা। মাস-দু’য়েকের ঘর করা ‘স্বামী’-র ফটো হাতে নিয়ে বলছেন, ‘আওর কুছ নাহি, ইনসাফ চাহিয়ে।’’ কিন্তু প্রশ্ন হল তাবরেজও তো মুসলমান ছিল এখন শাহিস্তা কি ইনসাফ পাবে?