ইসলামের তারকাগণ | পর্ব-১০ | তারিক বিন যিয়াদ রহিমাহুল্লাহ

1
2307
ইসলামের তারকাগণ | পর্ব-১০ |  তারিক বিন যিয়াদ রহিমাহুল্লাহ

“তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পশ্চাতে সমুদ্র; সুতরাং হয় শরীয়াহ, নয় শাহাদাহ”

বারো হাজার মুসলমানের কাছে এক লক্ষের বিশাল বাহিনীর পরাজয়ের বিষয়টিকে প্রাচ্যের ঐতিহাসিকরা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালিয়ে গোপন রাখতে চায়। তারা মানুষকে এই বিভ্রান্তিতে ফেলতে চায় যে, মুসলমানরা পলায়নের জাহাজ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাদের বিরুদ্ধবাদীদের হত্যা করেছিল। কিন্তু ঐ সকল প্রাচ্যের ঐতিহাসিকরা এ বিষয়টা অনুধাবনই করতে পারে না যে, মুসলমানেরা বিজয় ও শাহাদাতের তামান্নাতেই জাহাজ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। ফলে, মুসলমান মুজাহিদগণ কাফেরদের বিপুল সংখ্যকের উপর বিজয় লাভ করেছেন। মুসলমানদের বিজয়ের বিষয়টি শুধু মুসলিম ঐতিহাসিকদের লিখনিতে উল্লেখ আছে এমনটি নয় বরং অনেক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকরাও তাদের লিখনিতে উল্লেখ করেছেন। আমরা এখন সেই অল্প সংখ্যক মুজাহিদ নিয়ে (উন্দুলুস) স্পেন বিজয়কারী ইসলামের মহাবীর সম্পর্কে জানবো, ইনশাআল্লাহ।

তারিক বিন যিয়াদই ছিলেন (উন্দুলুস) স্পেন বিজয়কারী সৈনিকদের দলনেতা। তাঁর নেতৃত্বেই সর্বপ্রথম ইউরোপীয় মহাদেশে ইসলামিক যোদ্ধাদের প্রেরণ করা হয়েছিল।

তারেক বিন যিয়াদ ছিলেন মুসা বিন নুসাইর-এর গোলাম। তারেক বিন যিয়াদ বার্বারদের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ও উত্তম বংশ ডেন্ডালে ৫০ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন তিনি। অল্প বয়সেই কুরআনুল কারীমের বেশ কিছু সূরা এবং হাদিস মুখস্থ করেছিলেন। মুসা বিন নুসাইর তারিক বিন যিয়াদের বিচক্ষণতা, যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে পারদর্শিতা, সততা, আরবী ভাষায় বাগ্মীতাসহ অন্যান্য গুণাবলী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।

তিনি তারিকের যোগ্যতা দেখে তাকে নায়েবে সালার পদে আসীন করলেন। অবশেষে ৫ই রজব ৯২ হিজরী মোতাবেক ৯ই জুলাই ৭১১ খৃষ্টাব্দে এই গোলাম পেয়ে গেলেন স্পেন অভিযানে সেনাপতির দায়িত্ব।

তারেককে যে ফৌজ দেয়া হয়েছিল তার সংখ্যা ছিল সাত হাজার। এর মাঝে কয়েকশ সওয়ারী ছিল। সমস্ত সৈন্য নিয়ে উপকূলের যেখানে জাহাজ ভিড়েছিল তার নাম─কিপলী, পরবর্তীতে যা জাবালুত তারিক বা জিব্রাল্টার নামে প্রসিদ্ধ হয়।

সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী স্পেন উপকূলে নামার পর তারিক বিন যিয়াদ জাহাজের মাল্লাদের নির্দেশ দিলেন, “সব কটি জাহাজে আগুন লাগিয়ে দাও।” তার নির্দেশের পর সব কটি জাহাজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো।

তারপর তিনি একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা আজো ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ। ঐ ভাষণের সারমর্ম ছিলো, “হে বাহাদুর যুবক ভাইয়েরা! এখন পিছু হটবার বা পলায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। তোমাদের সম্মুখে দুশমন আর পশ্চাতে সমুদ্র। এখন তোমাদের সামনে বিজয় লাভ বা শাহাদাতবরণ ছাড়া আর তৃতীয় কোনো পথ অবশিষ্ট নেই। আর সব দেশই আমাদের দেশ, কারণ এ সবই আমাদের আল্লাহর দেশ।”

তারেক বিন যিয়াদ তাঁর বাহিনী নিয়ে ‘জাবালে ফাতাহ’ বা জাবালে তারেক (জিব্রাল্টার) এর উপকূলে অবতরণ করেছিলেন। সেখান থেকে সবুজ উপদ্বীপ পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়েই জয় করেন।

তারপর রডারিক তার বিখ্যাত সেনাপতি থিওডমীরকে (Theodomir) বিশাল এক বাহিনীসহ তারেকের মোকাবেলা করার জন্য প্রেরণ করে। মুসলিম সেনাবাহিনীর সাথে থিওডমীরের পরপর অনেকগুলো লড়াই হয়। আর প্রতিটি লড়াইয়ে সে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

পরে রডারিক নিজেই প্রায় একলাখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী তৈরি করে তারেকের সাথে মোকাবেলা করার জন্য।

এদিকে তারিক মুসা বিন নুসাইয়ের কাছে আরো সৈন্য চেয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে মুসা বিন নুসাইর আরো পাঁচ হাজার সৈন্য প্রেরণ করেন। ফলে তারিকের মোট সৈন্য সংখ্যা বারো হাজারে উন্নীত হয়।

পরিশেষে মুসলমানগণ আল্লাহর সাহায্য লাভ করেন এবং বিজয় তাদের পদচুম্বন করে। রডারিকের বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে পালিয়ে যায়। রডারিক নিজেও ঐতিহাসিক এ লড়াইয়ে নিহত হয়। এ বিজয় মুসলমানদের জন্য সমগ্র ইউরোপ বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। এরপর মুসলমানগণ স্পেনের সমস্ত শহর পদানত করতে করতে সম্মুখে অগ্রসর হতে থাকেন। তারা স্পেনের তৎকালীন রাজধানী টলেডো (Tollido)-কেও জয় করেন। পরে তাদের সাথে মুসা বিন নুসাইরও তাঁর বাহিনী নিয়ে যোগদান করেন। তারপরেও তাদের অগ্রাভিজান অব্যাহত থাকে এমনকি তারা ফ্রান্সের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে পিরনীজ পর্বতমালার পাদদেশে পৌঁছে যায়।

কিন্তু ৯৫ হিজরীতে খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের  নির্দেশে অগ্রাভিযান থামিয়ে তাদেরকে দামেস্কে ফিরে আসতে বলা হয়। ফলে থেমে যায় মুসলমানদের যুগান্তকারী অগ্রাভিজান।

ইসলামের এই মহান বিজেতা তারেক বিন যিয়াদ রহিমাহুল্লাহ ৭২০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

এ সকল বিজয়ের পর স্পেন আন্দালুসে পরিণত হয়, আর সেখানে মুসলমানগণ আট’শ বছর পর্যন্ত শাসনকার্য চালান। এ সময়ে তারা ওখানে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অতুলনীয় প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেন। তারা এ ভূখণ্ডকে পৃথিবীর সর্বাধিক উন্নত ভূখণ্ডে পরিণত করেছিলেন।


তথ্যসূত্র:

১. কিতাবুল ইব্রু ওয়া দিয়ানুল মুবতাদা ওয়াল খবর ফি আইয়্যামিল আরব ওয়াল আজম ওয়াল বারবার ওয়া মিন আয়িনাহুম/ ইবনে খালদুন

২. ইসলাম ওয়েব/ রাগেব সিজিস্তানী

৩. উইকিপিডিয়া

১টি মন্তব্য

Leave a Reply to নাবিল প্রতিউত্তর বাতিল করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধতালেবাানের ইস্তেশহাদি হামলায় ৫৬ মুরতাদ সৈন্য নিহত, হতাহত আরো ৪২ এরও অধিক
পরবর্তী নিবন্ধআল-ফিরদাউস নিউজ বুলেটিন || মে ৩য় সপ্তাহ, ২০২০ঈসায়ী ||