“হযরত মিকদাদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা আমি দেখেছি। আহা! আমি যদি সেই ভূমিকা পালন করতে পারতাম, তবে তা আমার জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার সমুদয় বস্তুসম্ভার থেকে অধিক প্রিয় হতো।—হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু।
মিকদাদ ইবনে আমর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়্যাতের সূচনালগ্নে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী সাতজনের একজন এবং মক্কায় সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা প্রদানকারী।
দীর্ঘদেহী, কেশবহুল এবং দেখার মতো চমৎকার শ্মশ্রুমণ্ডিত ছিলেন। তাঁর দাড়ি না ছিলো অধিক ঘন, আর না ছিলো একেবারে পাতলা। সূক্ষ্ম রেখার মাধ্যমে তাঁর ভ্রূযুগল দারুণভাবে সংযুক্ত ছিলো।
তাঁর জন্ম ইয়ামানে। মক্কায় আগমনের পর আসওয়াদ ইবনে আব্দে ইয়াগূছ তাঁকে পালকপুত্র বানিয়ে নেয়। তখন থেকে তিনি মিকদাদ ইবনে আসওয়াদ নামে পরিচিত হন। পালক পুত্রের বিধান সম্বলিত আয়াত নাযিল হওয়ার পর মিকদাদ ইবনে আসওয়াদের পরিবর্তে পিতার নাম হিসেবে মিকদাদ ইবনে আমর নামে পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচাতো বোন দুবাআহ বিনতে যোবায়ের ইবনে আব্দুল মুত্তালিবকে বিবাহ করেন। প্রথমে হাবশায় এবং পরে মদিনায় হিজরত করেন মিকদাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু।
তিনি তাঁর জীবদ্দশায় মুশরিকদের বিরুদ্ধে সবকটি যুদ্ধে শরীক হন। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন এই মহান বীর মুজাহিদ। মুসলমানদের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বপ্রথম অশ্বারোহী যোদ্ধা।
এক বর্ণনায় দেখা যায়, বদর যুদ্ধে হযরত মিকদাদ ছিলেন একমাত্র অশ্বারোহী যোদ্ধা। অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, বদর যুদ্ধে অশ্বারোহী ছিলেন তিনজন: মিকদাদ ইবনে আমর, জুবায়ের ইবনে আওয়াম এবং মারছাদ বিন আবি মারছাদ।
বীরত্ব, অশ্বারোহণ ও বিচক্ষণতায় তিনি বিশেষভাবে খ্যাত ছিলেন। তিনি সব সময় শহীদি-মরণ কামনা করতেন।
বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সাথে পরামর্শ করছিলেন। হযরত আবু বকর ও ওমর তাঁদের মতামত ব্যক্ত করলেন। তারপর হযরত মিকদাদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ আপনাকে যে দিকে চলতে বলেছেন সে দিকে এগিয়ে চলুন। আল্লাহর কসম! বনী ইসরাঈল তো মূসা আলাইহিস সালামকে বলেছিল “তুমি আর তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ করো, আমরা এখানে বসে রইলাম”—আমরা সেরকম কথা আপনাকে বলবো না। আমরা বলছি, আপনি ও আপনার রব গিয়ে লড়াই করুন, আমরাও আপনার ও আপনার রবের সহযোগী হয়ে লড়াইয়ে শরীক আছি। সে মহান সত্তার শপথ যিনি আপনাকে সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন, আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সুদূর ইয়ামানের বারকুল গিমাদেও যান, তাহলেও আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে সেখানে যাবো।
সাহাবীর মুখে এ কথা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠল। তিনি তাঁর জন্য দোয়া করলেন। এই দৃশ্য দেখে প্রত্যেক সাহাবী মনে মনে এই আকাঙ্ক্ষা করছিলেন যে, আহা! আজ আমি যদি মিকদাদের ভূমিকা রেখে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মুখে হাসি ফোটাতে পারতাম! হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
‘মিকদাদের অবিস্মরণীয় ভূমিকা আমি দেখেছি। আহা! আমি যদি সেই ভূমিকা পালন করতে পারতাম, তবে তা আমার জন্য দুনিয়া ও দুনিয়ার সমুদয় বস্তুসম্ভার থেকে অধিক প্রিয় হতো।’
হিজরতের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশজন করে সাহাবী একেকজন আনসারের ঘরে থাকার জন্য বন্টন করে দিচ্ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে একই ঘরে যাঁরা থাকতেন হযরত মিকদাদ ছিলেন তাঁদের একজন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, প্রত্যেক নবীকে সাতজন করে প্রতিনিধি ও সঙ্গী দান করা হয়েছে, আর আমাকে দেওয়া হয়েছে চৌদ্দজন। সাহাবীগণ বললেন, ‘তাঁরা কাঁরা?’ তিনি বললেন, ‘হামজা, জাফর, আবু বকর, ওমর, আলী, হাসান, হুসাইন, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, সালমান, আম্মার, হুজাইফা, আবু জর, মিকদাদ এবং বেলাল (রাঃ)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, আল্লাহ আমাকে চার ব্যক্তিকে ভালোবাসার আদেশ করেছেন এবং আমাকে জানিয়েছেন যে, তিনিও তাঁদেরকে ভালোবাসেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে তাঁদের নাম বলুন। তিনি বললেন আলী, আবু জর, মিকদাদ এবং সালমান রাদিয়াল্লাহু আনহুম।
হযরত মিকদাদ অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে একটি রাষ্ট্রীয় পদ দিয়েছিলেন। আল্লাহর রাসূল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন তোমার কাছে কেমন লেগেছে? মিকদাদ বললেন: আমি নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করেছি এবং তাদেরকে এমন ভাবতে শুরু করেছি যে, তারা যেন সকলেই আমার চেয়ে নিচু। যেই সত্তা আপনাকে সত্য দ্বীন দিয়ে পাঠিয়েছেন—সেই সত্তার শপথ, আজকের পর কখনোই দুই ব্যক্তির আমীর হবো না।
হযরত মিকদাদ ছিলেন দানবীর। মৃত্যুর পূর্বে হাসান হোসেনকে ছত্রিশ হাজার রৌপ্য মুদ্রা প্রদানের ওসিয়ত করেন এবং উম্মাহাতুল মু’মিনিনের প্রত্যেকের জন্য ছয় হাজার করে রৌপ্যমুদ্রা প্রদানের ওসিয়ত করেন।
তিনি আমীরুল মু’মিনিন হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে ৩৩ হিজরী সনে সত্তর বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
তথ্যসূত্র:
আল ইসতীআব ফী আসমাইল আসহাব— কুরতুবী
উসদুল গাবাহ— ইবনে আসীর
আত তাবাকাতুল কুবরা— ইবনে সাআদ