বহু অপরাধের হোতা পাপুলের উদ্দেশ্য হাসিল করতো আওয়ামী দূতাবাস

1
759
বহু অপরাধের হোতা পাপুলের উদ্দেশ্য হাসিল করতো আওয়ামী দূতাবাস

কুয়েতে ভয়ঙ্কর এক নাম পাপুল। তার মন মর্জির উপর নির্ভর করতো অনেক কিছুই। কত প্রবাসীকে যে কুয়েত ছাড়া করেছে এর ইয়াত্তা নেই। কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস ছিলো তার হাতিয়ার। পাপুলের মনের আশা পূরণ করতেন রাষ্ট্রদূত নিজেই। মানবপাচার ও মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগে এই পাপুল এক কুয়েতের কারাগারে। যিনি বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য। লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি।

শহিদ ইসলাম পাপুল এখন গোটা দেশেই পরিচিত। কুয়েতের বাংলাদেশ কমিউনিটিতে তিনি আগে থেকেই ব্যাপক পরিচিত। কারণ তার প্রভাব, নির্যাতন আর অত্যাচার ছিলো সেখানকার বাংলাদেশিদের মুখে মুখে। বাংলাদেশি প্রবাসীদের কেউ তার অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুললে আর রক্ষা নেই। কিংবা কারো সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব হলেও তার আসল রুপ বেরিয়ে আসতো। তাদের উপর নির্মম নির্যাতনের পর করতেন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা। কুয়েতস্থ বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে অভিনব কৌশলে তাকে কুয়েত ছাড়া করা হতো। অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রদূতের মদতে দূতাবাস পাপুলের দেয়া নাম অনুযায়ী প্রবাসীদের কালো তালিকাভুক্ত করতে চিঠি দিতো কুয়েত সরকারকে। বিশ্বে যেখানে দেশের মানুষের জন্য দূতাবাসগুলো লড়াই করে, সেখানে বাংলাদেশ দূতাবাস নিজ দেশের মানুষকে কালো তালিকাভূক্ত করতে কুয়েত সরকারকে চিঠি দেয়। গত দেড় বছরে কমপক্ষে এমন ১৫ জনকে কালো তালিকাভুক্ত করে দেশে পাঠিয়েছে দূতাবাস। এর মধ্যে ৮ জনের নাম ও প্রমাণ এসেছে এই প্রতিবেদকের হাতে। তাদের মধ্যে কামরুল হাসান বাবুল, মিজানুর রহমান, এহসানুল হক খোকন, আবদুস সাত্তার, সফিকুল ইসলাম সফিক, জাফর আহম্মেদ, আব্দুস সাত্তার ও আরেক শ্রমিক। তাদের প্রথম তিনজন গণমাধ্যমকর্মী ও বাকি পাঁচজন ব্যবসায়ী। অভিযোগ রয়েছে, ব্যবসায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও তার অপকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাদের এই কালো তালিকাভুক্ত করতে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশস্থ কুয়েত দূতাবাস।

ভুক্তভোগী কামরুল হাসান বাবুল এসব বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিকার পাননি। আবেদনে তিনি বলেন, দূতাবাস কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থন না দিয়ে গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য কুয়েত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাবর অভিযোগ করেন। এরই সূত্র ধরে, সিআইডি তার কোম্পানির মাধ্যমে তাকে তলব করেন। পরে সিআইডি কার্যালয়ে গেলে তাকে গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কামরুল ইসলাম বাবুল বলেন, প্রবাসীদের নিয়ে আমি একটি নিউজ পোর্টাল সম্পাদনা করি। পাশাপাশি বাংলাদেশি একটি টিভি চ্যানেলের কুয়েত প্রতিনিধি ছিলাম। আমি লেখালেখি করতাম। রিপোর্ট করবো বলে পাপুলের বিষয় খবর নিচ্ছিলাম। সেটা পছন্দ করেনি পাপুল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দূতাবাসকে ব্যবহার করে আমাকে দেশ পাঠিয়ে দিয়েছে কালো তালিকাভুক্ত করে। পরে আমি দেশে এসে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার আবেদন করেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। তিনি বলেন, আমি যখন সিআইডিতে যাই তাৎক্ষণিক আমাকে বেশকিছু প্রশ্ন করে। তখন আমি বুঝতে পারি বাংলাদেশ দূতাবাস নিজ উদ্যোগে অভিযোগ করেছে আমার বিরুদ্ধে। যেখানে আমাকে গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আমি ২৪ বছর কুয়েতে ছিলাম। কোনো অভিযোগ ছিলো না আমার বিরুদ্ধে। অথচ দূতাবাস ও পাপুলের দুর্নীতির খবর প্রকাশ হওয়ার ভয়ে বিনা কারণে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

কুয়েতে প্রবাসী সূত্রে জানা যায়, গত বছর নভেম্বরে কুয়েত মসজিদ কমপ্লেক্স পরিচ্ছন্ন ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং জাতীয় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাজের দরপত্র আহ্বান করে কুয়েত সরকার। তিনবছর চুক্তিতে মসজিদ কমপ্লেক্স কাজের জন্য প্রায় ১ হাজার এবং বিমান চলাচল কাজের জন্য ৩০০ কর্মী নিয়োগ দেয়া হবে। এই উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করলে অংশ নেয় দুই দেশের যৌথ মালিকানা কোম্পানি জেএম গ্রুপ অব কোম্পানি কুয়েত। এ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক ও প্রবাসী বাংলাদেশি জাফর আহম্মেদকে সরে আসার জন্য চাপ দিতে থাকে পাপুল। কিন্তু তারপরও তিনি দরপত্রে অংশ নেন। এ ঘটনার এক মাস পর জাফর আহম্মেদকে কুয়েত সিআইডিতে তলব করা হয়। সিআইডি ডেকে তাকে জানান, তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মামলা আছে। তাকে দেশে ফিরে যেতে হবে। বাংলাদেশ দূতাবাস তার মামলার বিষয়টি জানিয়ে চিঠি দেয়। পরে তাকে ২১ দিন আটকে রেখে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। জাফর আহম্মেদ বলেন, পাপুল ব্যবসায়ীকভাবে আমার সাথে না পেরে রাষ্ট্রদূতকে ব্যবহার করেছে।

আরেক ভুক্তভোগী কুয়েতের বাংলাদেশ কমিউনিটির সমাজকর্মী মিজানুর রহমান। সামাজিক মাধ্যমে দূতাবাস ও পাপুলের অপকর্ম নিয়ে লিখতেন নিয়মিত। তাকেও দূতাবাস কালো তালিকাভুক্ত করে দেশে পাঠিয়ে দেন। মিজানুর রহমান বলেন, আমাকে কালো তালিকাভুক্ত করে সিআইডিতে চিঠি দেয় বাংলাদেশ দূতাবাস। কোনো প্রকার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আমি ২৬ বছর কুয়েতে ছিলাম। কোনো ধরনের অভিযোগ নেই আমার বিরুদ্ধে। কিন্তু পাপুল আমাকে সবসময় প্রতিপক্ষ মনে করতো। শুধু তাই নয়, সিআইডি যখন আমাকে দেশে পাঠানোর জন্য এয়ারপোর্টে নিয়ে যায় তখন দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারীরা আমার ছবি তুলে। কৌশলে আমার ফোন নিয়ে গিয়ে যত ছবি ছিলো সব রেখে ফরমেট দিয়ে ফোনটি দেয়। এরপর দূতাবাস ও পাপুলের লোকজন আমার ছবি দিয়ে ফেসবুকে নানা আপত্তিকর পোস্টও দেয়। আমার সম্মানহানি করে।

শহিদ ইসলাম পাপুলের অনৈতিক কর্মকান্ড ও অনিয়মের খবর প্রকাশের জন্য বাংলাদেশি প্রবাসী সাংবাদিকদের একটি অংশের ওপর দূতাবাস ও পাপুল বরাবরই ক্ষিপ্ত ছিলেন। শুধু তাই নয়, পাপুলের ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বীর ওপর ক্ষিপ্ত ছিলো দূতাবাস।

কুয়েতে গ্রোসারি ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম। দীর্ঘ ২৫ বছর ছিলেন কুয়েতে। তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনো দ্বন্দ্ব ছিলো না দূতাবাস বা পাপুলের। কিন্তু বিস্‌মিল্লাহ ট্রাভেলসের মালিক আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে পাপুলের ব্যবসায়ীক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এর সূত্র ধরেই সফিকুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার, বাংলাদেশি আরেক শ্রমিককে দেশে পাঠিয়ে দেয় দূতাবাস। সফিক বলেন, পাপুলের সঙ্গে আমার চেনা-পরিচয় ছিল। এর বাইরে কিছু ছিল না। অথচ সাত্তারের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক তাই আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাত্তারের অফিসে একদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম। এ সময় সিআইডি’র লোকজন বিনা কারণে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। এখনো আমার পরিবার কুয়েতে অথচ আমি দেশে।
দূতাবাসের অভিযোগের প্রেক্ষিতে কালো তালিকাভুক্ত করে প্রবাসীদের সিআইডি’র মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত এসএম আবুল কালাম বলেন, এটা আমি করতে পারি না। আমি সিআইডিকে কখনো এমন অভিযোগ করিনি। আমি সর্বোচ্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠাতে পারি। কালো তালিকাভুক্ত কয়েকজনের নাম বললে, তিনি তাদের চিনেন না বলে জানান।
সূত্র: মানবজমিন

১টি মন্তব্য

Leave a Reply to Md Liton Shekh প্রতিউত্তর বাতিল করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্রিজের মুখ বন্ধ করে প্রভাবশালীদের মাছচাষ, ডুবছে এলাকা
পরবর্তী নিবন্ধদুর্নীতির পেছনের রুই-কাতলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হচ্ছে না কেন?