খেলাফতে উসমানীয়ার পতনের পর মুসলিমরা একে একে তাদের সমস্ত বিজিত অঞ্চল হারিয়ে বসে। মুসলিমদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে ইসলামী সভ্যতা ও ইতিহাসের গৌরব-উজ্জল অধ্যায়। কাফির,মুশরিকেরা মুসলিমদের পবিত্র স্থানগুলোকে অপবিত্র করতে থাকে। মুসলিমদেরকে বিভক্ত করে দেওয়া হয় জাতীয়তাবাদ, সীমানার গোঁড়ামি, দেশপ্রেম এবং ভাষাতত্ত্বের নামে। এভাবেই মুসলিমদের প্রথম কিবলা মাসজিদুল-আক্বসাও দখলে নিয়ে নেয় অভিশপ্ত ইহুদীরা।
এই দীর্ঘ সময় পর আফগানিস্তানে অরাজকতা, দুর্নীতি ও নিপীড়ন অবসানের লড়াইয়ের ডাক দেওয়া মোল্লা ওমর মুজাহিদ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন ছাত্ররা প্রথমবারের মত পূর্ণাঙ্গ ইসলামি শরিয়াহ্ ব্যাবস্থা চালু করেন। তালেবানরা ক্ষমতালোভী মিলিশিয়াদের হটিয়ে দেশটির ৯৫% এরও বেশি এলাকা ১৯৯৬ সালের মধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হন। নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকে ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান হিসেবে নতুন রাষ্ট্রের ঘোষণা করা হয় । ২০০১ সাল পর্যন্ত তাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। দীর্ঘ ৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে আফগানিস্তানে ইসলামি শরিয়াহ্ ব্যবস্থার সুশীতল ছায়াতলে মানুষ ফিরে পায় শান্তি, শৃঙ্খলা আর জীবনের নিরাপত্তা।
তালেবান মুজাহিদিন কর্তৃক কাবুল বিজয় ও ইমারতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান ঘোষণার পর হেকমতিয়ার আফগানিস্তান ছেড়ে ইরানে বসতি স্থাপন করে। আর আহমদ শাহ মাসউদ কাবুলের উত্তরে কৌশলগত পাঞ্জাশির উপত্যকায় অবস্থান নেয়। এসময় তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আবদুল রশিদ দোস্তুম, রব্বানী এবং মাসউদের নেতৃত্বে নর্দান অ্যালায়েন্স গঠিত হয়। দেশের উত্তরে এরা শক্তি বৃদ্ধি করেছিল। সায়াফও তখন এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হয়। এক কথায় ক্ষমতালোভী দলগুলো দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর নিজেদের মধ্যকার যুদ্ধের ইতি টানে, তা আফগান জনগণের স্বার্থ রাক্ষায় নয় বরং তালেবান মুজাহিদদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যে।
তালেবানদের বিরুদ্ধ উত্তরাঞ্চলীয় জোট গঠনের শুরু থেকেই ইরান, রাশিয়া এবং ভারত এই জোটকে সমর্থন দিতে থাকে। এসময় তুরস্কও (বর্তমানের মতো) দোস্তুমকে সমর্থন দেয়।
এরপর এই জোট অক্টোবরে কাবুলে তালেবানদের উপর হামলা চালায়। ফলে তালেবানরাও পাল্টা আক্রমণ করেন এবং কাবুলের উত্তরাঞ্চল এবং কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাগরাম বিমানঘাঁটি দখল করেন। এভাবেই মুজাহিদগণ পাঞ্জাশির উপত্যকার দ্বারে পৌঁছে যান। তালেবানরা আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় অঞ্চলগুলো শিয়া হিজব-ই-বাহাদেতের কাছ থেকে বিজয় করার পর, এই দলটি ১৯৯৬ সালের শেষের দিকে উত্তর ছাড়া দেশের সমস্ত অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য হারায়। এভাবে ক্ষমতালোভী মিলিশিয়াগুলো ধীরে ধীরে দেশের উত্তরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
তালেবানরা আফগানিস্তানের বেশিরভাগ অঞ্চল এবং রাজধানী বিজয় করলে, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব তালেবানকে আফগানিস্তানের নতুন সরকার হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। অন্য দেশগুলো তখনো উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে দেশের সরকার হিসাবে সমর্থন করতে থাকে।
এরপর ১৯৯৮ সালে তালেবানরা কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি এবং আফগানিস্তানের নতুন সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ শাসক হিসেবে স্বীকৃতির জন্য বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে। এসময় তালেবানরা জাতিসংঘে সদস্যপদের জন্যও আবেদন করেছিলেন। পরে অবশ্য তালেবানরা এই আবেদন প্রত্যাহার করে। কারণ তারা জানতে পেরেছিল এই সদস্যপদের জন্য যেসব শর্তাবলী অন্তর্ভুক্ত তা অনৈসলামিক আইনের গ্রহণ ও প্রয়োগকে স্বীকার করে। ফলে তালেবান সরকার জাতিসংঘের সদস্যপদ ছাড়াই বহির্বিশ্ব থেকে স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট বোঝার জন্য এবার চোখ ফেরানো যাক ১৯৮০ এর দশকে। ৮০’র দশকে আফগান যুদ্ধ শুরু হলে ফিলিস্তিনি শিক্ষাবিদ ও ‘গ্লোবাল জিহাদের’ স্বপ্নদ্রষ্টা ড. আবদুল্লাহ আজজাম (১৯৪১-১৯৮৯) এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।তিনি বিশ্বের ইসলামপন্থীদের রুশ বিরোধী আফগান যুদ্ধে নিয়ে আসতে সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেন।
আবদুল্লাহ আজজাম রহিমাহুল্লাহ এই যুদ্ধের বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত ফতোয়াটি জারি করেন। তিনি তাঁর দলিল ভিত্তিক ফতোয়া এবং বক্তৃতা দিয়ে অসংখ্য মানুষকে জিহাদে যোগদানের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। বিশেষভাবে আরব বিশ্বের অনেক তরুণকে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন। হাজার হাজার মানুষ এই যুদ্ধে যোগ দিতে পাকিস্তান আসে এবং সেখান থেকে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিল। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আফগান যুদ্ধে বিদেশ থেকে আনুমানিক ২৫ হাজার মুজাহিদ অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ওসামা বিন লাদেন (১৯৫৭-২০১১), আল কায়েদার প্রতিষ্ঠাতা ও আমীর, আরবের একজন ধনী ও বিখ্যাত ব্যবসায়ী। আবদুল্লাহ আজজাম রহিমাহুল্লাহ’র আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি আফগান জিহাদে জড়িত হন। এবং এই জিহাদ এবং সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে বিপুল পরিমাণে সাহায্য করেন। বিশেষ করে আরবের শীর্ষ ধনীর সন্তান হবার পরেও এই যুদ্ধে তাঁর স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ তাঁকে আরবদের মাঝে আরও বিখ্যাত করে তুলেছিল। আজজাম রহিমাহুল্লাহ তাঁর বক্তৃতায় মাঝে মাঝেই বিন লাদেনের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও মুসলিম উম্মাহর জন্য তাঁর হৃদয়ের ভালোবাসার প্রশংসা করতেন।
একইভাবে মিসরের জিহাদী গ্রুপ “তাওহীদ ওয়াল জিহাদ” এর আমীর ও মিসরের বিখ্যাত চিকিৎসক আয়মান আজ-জাওয়াহিরিও (১৯৫১-) এই যুদ্ধের সময় মুসলিমদের সাহায্যের জন্য পাকিস্তানে আসেন। তিনি চিকিৎসক হিসেবে আফগান মুজাহিদ ও শরণার্থীদের চিকিৎসায় অংশ নেন।
একইভাজে আবু কাতাদা আল-ফিলিস্তিনি (১৯৬০-), আবু মুহাম্মদ আল-মাকদিসি (১৯৫৯-), সাইয়্যেদ ইমাম শরীফ (আব্দুল কাদির বিন আবদুল আজিজ) (১৯৫০-), আবু মুসাব আস-সুরি (১৯৫৮-) এর মতো মহান ব্যক্তিদের অনেকেই এই যুদ্ধে যোগদান বা সমর্থন করার জন্য এই অঞ্চলে আসেন। পরবর্তীতে তাঁরা ‘গ্লোবাল জিহাদ’ এর জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত হন।
দখলদার রুশ বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়ার পর এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিদেশি (আরব-অনারব) মুজাহিদগণ ১৯৮৯ সাল থেকে আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করেন।
অনেক মুজাহিদ তাদের দেশে ফিরে যান বা একই সময়ে শুরু হওয়া যুদ্ধে অংশ নিতে বসনিয়া, চেচনিয়া, আলজেরিয়া ও তাজিকিস্তানের মতো অন্যান্য অঞ্চলে চলে যান। যাদের মাঝে ওসামা বিন লাদেনও ছিলেন। তিনি ৮০ এর দশকে আফগান যুদ্ধে আবু আবদুল্লাহ নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সৌদি আরবে ফিরে আসেন।
১৯৯০-৯১ সালে উপসাগরীয় সংকট ও যুদ্ধের সময় মার্কিন সৈন্যদের সৌদি আরবে আসার তীব্র বিরোধীতা করেন শাইখ ওসামা। আমেরিকা থেকে সাহয্য নেবার পরিবর্তে তাঁর অধীনস্থ সেচ্ছাসেবক ও মুজাহিদদের এই কাজে যুক্ত করার পরামর্শ দেন সৌদি আরবকে। যাদেরকে ওসামা বিন লাদেন আফগানে গড়ে তুলেছেন, যাদের অনেকে তখনও আফগানে ও কেউ কেউ আরবে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সৌদি আরব ওসামার পরামর্শ গ্রহন করেনি। তারা আরবের মাটিতে ক্রুসেডার মার্কিন সৈন্যদের আশ্রয় দেয়। যার ফলে সৌদি আরব ও ওসামা বিন লাদেনের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ফলে তিনি ১৯৯১ সালে পুনরায় আফগানিস্তানে ফিরে আসেন এবং ১৯৯২ সালে সুদানে বসতি স্থাপন করেন। আর এখান থেকে তিনি গ্লোবাল জিহাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন।
এদিকে ১৯৯২ সালে আফগানিস্তান ক্ষমতালোভীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। তখন বিদেশি মুজাহিদগণ আরও দ্রুততার সাথে আফগানিস্তান ছাড়তে শুরু করেন। কারণ তাঁরা যেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন তা নিজেদের চোখের সামনেই ক্ষমতালোভীদের হাতে ধ্বংস হচ্ছিল। তবে মিশর ও আরব মুজাহিদদের একটা অংশ তখনও আফগানিস্তানে অবস্থান করেন। এসময় এই মুজাহিদগণ নতুন এক যুদ্ধের জন্য সামরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন। তবে তাঁরা ক্ষমতালোভী দলগুলোর মধ্যে চলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। মূলত বিদেশি মুজাহিদগণ এই প্রশিক্ষণ শিবিরে, তাঁদের নিজ নিজ দেশে এবং বিশ্বব্যাপী সামরিক সংগ্রামের একটি নতুন অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এরপর ১৯৯৬ সালে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবান মুজাহিদগণ রাজধানী কাবুল দখল করলে আরব মুজাহিদদের এই দলটি মোল্লা ওমরের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে মনযোগী হন। অপরদিকে ওসামা বিন লাদেন ১৯৯২-১৯৯৬ সময়ে সুদানের সাথে যৌথভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন। এরইমধ্যে ১৯৯৪ সালে সৌদিআরব তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করে। এবং সৌদি আরবের হাতে তুলে দেবার জন্য সুদানের কাছে দাবি জানাতে শুরু করে। ফলে সুদান বিন লাদেনের দেশ ত্যাগের জন্য চাপ সৃষ্টি করে। আর তখন ১৯৯৬ সালের মে মাসে তিনি আবারো আফগানিস্তানে আসেন। সেসময় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবান সরকার। কিন্তু তালেবানরা তখনও উত্তরাঞ্চলীয় জোট নর্দান অ্যালায়েন্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এতে তালেবানদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। আর ঠিক তখনই ওসামা বিন লাদেন আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবানদের সমর্থন করতে আরব মুজাহিদদের পরামর্শ ও নির্দেশনা দেন। এরমধ্য দিয়ে আল কায়েদা-তালেবানদের সহযোগিতা পর্ব শুরু হয়। এবং তখন শাইখ আইমান আজ-জাওয়াহিরি হাফিজাহুল্লাহ’র নেতৃত্বাধীন মিশরের দলটিও নিজেদের দল বিলুপ্ত করে আল-কায়েদার সাথে যুক্ত হয়ে যায় ।
চলবে ইনশা আল্লাহ…
লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক: আল ফিরদাউস নিউজ।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-