কাবুল বিজয়ের পর তালেবান সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। কিন্তু ২০ বছর ধরে আমেরিকার সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করা স্থানীয় আফগানীরা আমেরিকার নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় আমেরিকাগামী বিমানে উঠার প্রতিযোগিতা শুরু করে। আমেরিকানরাও এমন চুক্তি করেছিল আফগান ত্যাগের সময় স্থানীয় সহযোগীদের তারা সাথে নিয়ে যাবে। কিন্তু এই বিষয়টিকে হলুদ মিডিয়া তালেবানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। তারা দাবী করতে থাকে তালেবানদের ভয়ে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। আমেরিকাকে উপস্থাপন করা হয় অত্যন্ত মহান হিসেবে যারা আফগানিদের তালেবানদের হাত থেকে রক্ষা করছে।
কিন্তু আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের কথিত উদ্ধার অভিযানের আসল চিত্র জনসম্মখে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আমেরিকা মুখে তাদের ‘আফগান সহযোগীদের’ উদ্ধারের দাবি করলেও তারা সেখানে মূলত কাদের উদ্ধার করেছে, আর কাদেরকে তারা বিমানবন্দরের বাইরে অমানবিক উপায়ে ভীড় সামলাতে মোতায়েন করেছিল- তারা জনগণের সাথে কেমন আচরণ করেছে, এসবই উঠে এসেছে আল জাযিরার একটি রিপোর্টে।
রিপোর্টটিতে ফাতেমা নামের একজন আফগান নারীর বয়ান তুলে ধরা হয়, যে আমেরিকার হয়ে দীর্ঘ ৫ বছর অনুবাদকের কাজ করেছে।
এছাড়াও ঐ রিপোর্টে আফগানের পলাতক প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির ভাই হাসমত গনির সাক্ষাতকার দেখানো হয়, যেখানে তিনি ‘এনডিএস ০ ইউনিট’ নামক এক বিশেষ বাহিনীর অপকর্মের কথা উল্লেখ করেন, যাদেরকে আমেরিকা, কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে ভীড় সামলাতে মোতায়েন করেছিল। অবশ্য তাদের অমানবিক আচরণের অভিযোগ পেয়ে তালিবান মুজাহিদিন পরবর্তীতে তাদেরকে সরিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে উত্তর দিকের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেন।
এই ‘এনডিএস ০ ইউনিট’ মূলত সিআইএ’র সরাসরি তত্তাবধানে গড়ে উঠা একটি মিলিশিয়া বাহিনী। ইউনিট ০-১, ০-২ ও ০-৩ কে যথাক্রমে কাবুল, পূর্বাঞ্চল ও কান্দাহার থেকে নিয়ে এসে কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে উত্তর দিকে মোতায়েন করা হয় ভীড় সামলাতে। হাসমত গনি জানান যে, এই বাহিনী আগেও অনেক ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ছিল। তারা মানুষের সাথে পশুর মতো আচরণ করত।
হাসমত গনির দাবির সত্যতা পাওয়া যায় আল জাযিরার গোপন ভিডিওতে। সেখানে দেখা যায়, তারা বিমানবন্দরের বাইরে জড়ো হওয়া আফগানদের বেল্ট দিয়ে বেধড়ক পেটাচ্ছে। আশেপাশে তাদের গুলি করার শব্দও পাওয়া যায়।
অপর বর্ণনাকারী ফাতিমা জানায় যে, ভীড় সামলাতে গুলি চালানো ছিল ঐ বাহিনীর একটা সাধারণ কৌশল। তারা বৃদ্ধ, মহিলা, শিশু সবাইকেই নির্বিচারে মারত।
এই বাহিনীকে তালিবানদের কাবুল বিজয়ের পরদিন থেকেই আমেরিকা মোতায়েন করে; এই বাহিনী মূলত তাদের ও তালিবানদের মাঝে একরকম একটা বাফার জোন কায়েম করে। কথা ছিল তারা সেখানে যে কোনো উপায়ে ভীড় সামলাবে। আর এসব কিছুর বিনিময়ে আমেরিকাগামী বিমানে তাদেরকে ও তাদের পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে জানায় ঐ বাহিনীর কয়েক সদস্য ও আফগান প্রত্যক্ষদর্শীরা।
ফাতেমা আরও জানায়, প্রথমে তাকে ও তার পরিবারসহ অন্য অনেক আফগান নাগরিককে বিমানবন্দরে প্রবেশ না করতে দিয়ে মারধর করে আহত করে ‘০ ইউনিট’ সদস্যরা। আহতদের অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, তাদের অনেকের চিত্রও রিপোর্টে দেখা যায়।
এরপর একসময় ফাতিমাকে বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে তার পরিবারের সদস্যপ্রতি ৫ হাজার ডলার করে দিতে বলে তারা। কিন্ত ৩ সন্তান ও স্বামীসহ পাঁচ সদস্যের জন্য ২৫ হাজার ডলার দিতে না পারায় ফাতিমা আমেরিকাগামী বিমানে উঠতে পারেনি।
উল্লেখ্য, আরও কয়েকটি আফগান পরিবারকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। অনেকেই এই ‘০ ইউনিট’কে ঘুস দিয়ে তবেই বিমানে উঠতে পেরেছিলেন।
আর বিমানবন্দরের ভিতরে তো খোদ আমেরিকান সৈনিকরাই তাদের এতদিনের আফগান সাথীদের গুলি করে হত্যা করেছে ভিড় সামলাতে না পেরে। আইএস-এর বোমা হামলার সময়ও প্রায় ১৮৮ জন নিহতের বেশিরভাগই বিস্ফোরণ-পরবর্তী আমেরিকান-ন্যাটো সৈনিকদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল বলে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।
এই ছিল আমেরিকানদের ফলাও করে প্রচার করা কথিত উদ্ধার অভিযানের ক্ষুদ্র চিত্র, যা তাদের পুরো অভিযানের বাস্তবতা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে সাহায্য করবে। রিপোর্টের একাংশে ফাতিমা তাই প্রশ্ন রাখে, “এই যে আমেরিকা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করছে যে, তারা তাদের আফগান মিত্রদেরকে উদ্ধার করছে; বাস্তবে কয়জনকে তারা উদ্ধার করতে পেরেছে…?”
এই হচ্ছে আমেরিকা, যে চুক্তি করলে ভঙ্গ করে, ওয়াদা করলে খেলাফ করে, আর বিপদে তার সাহায্যকারীদের রেখে পালিয়ে যায়।
আমেরিকা বুদ্ধিমান! সে বুঝে এরা সজাতির বিরুদ্ধে আমাদের দালালী করছে, আমাদের দেশে আশ্রয় দিলে একদিন আমাদের বিরুদ্ধেও দালালী করবে।