সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান অক্টোবর ২০২০ থেকে কারাগারে রয়েছেন। হাতরাস গণধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রতিবেদন করার চেষ্টা করায় তাকে ভারতের রাষ্ট্রদ্রোহ আইন এবং কঠোর বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (UAPA) এর অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
হাতরাসে ১৯ বছর বয়সী এক দলিত মহিলা উচ্চবর্ণের ঠাকুরদের গণধর্ষণের শিকার হয় এবং পরে হাসপাতালে মারা যায়। ঘটনা ধামাচাপা দিতে মাঝরাতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ তার পরিবারের সম্মতি বা উপস্থিতি ছাড়াই তাড়াহুড়ো লাশ জ্বালিয়ে দিয়েছে।
ভয়ঙ্কর সহিংসতা এবং অপরাধীদের রক্ষায় পুলিশ তৎপর- এমন শিরোনামে রিপোর্ট করার চেষ্টা করায় কাপ্পান, তার দুই ছাত্র কর্মী- আতিকুর রহমান ও মাসুদ আহমেদ এবং তাদের গাড়িচালক আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেফতারের পর, কাপ্পানকে পুলিশ নির্যাতন করে এবং ডায়াবেটিসের ওষুধও খেতে দেয়নি। গ্রেপ্তারের প্রায় ছয় মাস পর, কাপ্পানের বিরুদ্ধে ৫,০০০ পৃষ্ঠার একটি চার্জশিট দাখিল করা হয়।
উত্তর প্রদেশ পুলিশ যাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে তা হল বাস্তবিক অবস্থার রিপোর্টিং। যেমন, ভারত সরকারের কোভিড ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, মার্চ ২০২০ সালে দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালীন মুসলমানদের হয়রানি করা, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ছাত্র কর্মী এবং রাজনৈতিক বন্দীদের গ্রেপ্তার, এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে মুসলিম গণহত্যা।
গ্রেপ্তারের এক বছর পরও কাপ্পানকে জামিন দিতে অস্বীকার করা হয়। তার আইনজীবী উইলস ম্যাথিউস বলেছেন যে তিনি “এখনও এই চার্জশিটের অনুমোদিত কপি পাননি” পুলিশের কাছ থেকে।
কাপ্পান একা নন, কাশ্মীরি সাংবাদিক আসিফ সুলতান তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে রয়েছেন। কাপান এবং সুলতান বানোয়াট অভিযোগে কোন বিচার ছাড়াই বন্দী রয়েছেন। তারা কেবল মুসলিম সাংবাদিক হওয়ার কারণেই জেলে রয়েছেন।
অতি সম্প্রতি, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মুসলিম বিরোধী সহিংসতার প্রতিবেদন এবং নথিভুক্ত করার জন্য অন্য অনেক সাংবাদিককে হয়রানি করা হয়েছে এবং হুমকি দেওয়া হয়েছে। হিন্দু জনতা মুসলমানদের মালিকানাধীন মসজিদ এবং সম্পত্তিতে আক্রমণ করার পোস্ট করার কারণে ত্রিপুরা রাজ্য পুলিশ সন্ত্রাস আইনের অধীনে সাংবাদিক মীর ফয়সাল এবং শ্যাম মীরা সিং সহ ১০২টি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে৷
এরকম অসংখ্য কাপ্পান আর আসিফ ভারতের জেলগুলোতে বিনা বিচারে আটক রয়েছে বছরের পর বছর। অনেকের আবার হদিসও পাওয়া যায়নি। আর জেল হেফাজতে মৃত্যুও হয়েছে নাম না জানা বেশ কয়েকজন মুসলিম সাংবাদিকের।
এসব কারণে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ২০২১ সালের বিশ্ব প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স ভারতকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪২-এ স্থান দিয়েছে। এটিকে “সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলির মধ্যে একটি” বলে অভিহিত করেছিল।
যেহেতু নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ২০১৯ সালে দ্বিতীয় ম্যান্ডেট জিতেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, “মিডিয়ার উপর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকার প্রচুর চাপ বাড়িয়েছে।”
মোদি এবং বিজেপি ২০১৪ সালে ভারতে প্রথম ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকেই অপশাসনের প্রশ্ন বা সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের উপর ক্রমাগত আক্রমণ হয়েছে। চাকরির নিরাপত্তাহীনতা সহ সাংবাদিকদের নিয়মিতভাবে হুমকি দেওয়া হয়, ভয় দেখানো হয়, গ্রেপ্তার করা হয়, মামলা করা হয়—এবং রাষ্ট্র কর্তৃক অভিযোগের মাধ্যমে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।
সাংবাদিকদের মধ্যে যারাই বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে, তাদের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয় বা UAPA-এর মতো কঠোর আইনের অধীনে গ্রেপ্তার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, যাতে প্রমাণ সরবরাহ করার প্রয়োজন ছাড়াই একতরফাভাবে ব্যক্তিদের সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করে।
সাংবাদিকতার জন্য ভারত সত্যিই একটি অত্যন্ত বিপজ্জনক জায়গা হয়ে উঠেছে। Watch The State (WTS) এর প্রকাশিত ডকুমেন্টে বলা হয়, মে ২০১৯ থেকে আগস্ট ২০২১ এর মধ্যে ভারতে ২৫৬ জন সাংবাদিক তাদের কাজের জন্য আক্রমণের শিকার হয়েছে।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে, জম্মু ও কাশ্মীরে এবং দিল্লিতে পুলিশ সাংবাদিকদের সরাসরি অপরাধী সাজিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে রিপোর্ট করে৷ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি সাংবাদিকদের জন্য অন্যগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বিপজ্জনক।
ইউনেস্কোর করা তালিকা মতে, ২০২০ সালে ভারত ছিল সারা বিশ্বে সাংবাদিকদের জন্য ৬ষ্ঠ বিপদজনক দেশ। আফগানিস্তান, মেক্সিকো, সিরিয়া, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের পরেই ভারতের অবস্থান। ভারতের আগের ৫টি দেশের ৪টি-ই যুদ্ধবিধ্বস্ত; আর যুদ্ধবিধ্বস্ত না হয়েও আফগান-ইয়েমেনের চেয়ে বেশি পিছিয়ে নেই বিশ্বের কথিত বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত।
তবে কিছু দালাল মিডিয়া সর্বদাই হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকারের চাটুকারিতায় ব্যস্ত থাকে। মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দিতে এবং বিজেপির মুসলিম গণহত্যা ও অখণ্ড ভারত নির্মাণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে এরা বদ্ধপরিকর।
তথ্যসূত্র:
=====
১। Modi’s India Is “One of the Most Dangerous Countries for Journalists”
https://tinyurl.com/f9k46n5k
২। Modi’s India Is “One of the Most Dangerous Countries for Journalists”
https://tinyurl.com/v65u4jmu