ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত উম্মাহর শ্রেষ্ট ব্যক্তি হলেন হযরত আবু বকর (রাযি:)। তিনি ছিলেন পুরুষদের মাঝে প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ইন্তিকালের পর ইসলামের প্রথম খলিফা। তার অন্য নাম আব্দুল্লাহ। সিদ্দীক ও আতীক উপাধি, ডাকনাম বা কুনিয়াত আবু বকর । পিতার নাম ‘উসমান’। কুনিয়াত আবু কুহাফা। মাতার নাম সালমা এবং কুনিয়াত উম্মুল খায়ের। কুরাইশ বংশের উপর দিকে ষষ্ঠ পুরুষ ‘মুররা’তে গিয়ে রাসূলুল্লাহর ﷺ নসবের সাথে তাঁর নসব মিলিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহর ﷺ জন্মের দু’বছরের কিছু বেশী সময় পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং অনুরূপ সময়ের ব্যবধানে তাঁরা উভয়ে ইনতিকাল করেন। তাই মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল রাসূলুল্লাহর ﷺ বয়সের সমান।
তিনি ছিলেন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ ও প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট; তাঁর শারীরিক গঠন ছিল পাতলা ছিপছিপে। শেষ বয়সে তাঁর চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। মেহেন্দীর খিজাব লাগাতেন। তিনি অত্যন্ত দয়ালু ও সহনশীল ছিলেন।
আবু বকর (রাযি:) ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। জাহিলী যুগে মক্কাবাসীদের দিয়াত বা রক্তের ক্ষতিপূরণের সমুদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। আরববাসীর নসব বা বংশ সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাব্য প্রতিভাও ছিল, তিনি অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন। বক্তৃতা ও বাগ্মিতায় খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন নবীজি ﷺ-এর এই মহান সাহাবী।
আবু বকর (রাযি:) পেশায় ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি ছিলেন দানশীল ও সচ্চরিত্রবান। জাহিলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি তিনি। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পাণ্ডিত্য ও ব্যবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো।
হযরত আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা কুরাইশদের মধ্যে যথেষ্ট মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। মক্কা বিজয় পর্যন্ত আবু কুহাফা ইসলামের প্রতি তেমন আকৃষ্ট না হলেও, পুত্র আবু বকরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন- এমন কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অবশ্য হযরত আলী(রা)-কে তিনি দেখলে মাঝে মধ্যে বলতেন, ‘এই ছোকরারাই আমার ছেলেটিকে বিগড়ে দিয়েছে।’ মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহর (ﷺ) খিদমতে হাজির হয়ে ইসলামের ঘোষণা দেন। হিজরী ১৪ সনে প্রায় এক শ’ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন আবু কুহাফা। শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
আবু বকর ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান। অত্যন্ত আদর-যত্ন ও বিলাসিতার মধ্যে পালিত হন। শৈশব থেকে যৌবনের সূচনা পর্যন্ত তিনি পিতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বিশ বছর বয়সে পিতার ব্যবসা বাণিজ্যের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন তিনি।
শৈশব থেকে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সংগে আবু বকরের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সংগী ছিলেন। একবার রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সংগে ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া যান। তখন তাঁর বয়স প্রায় আঠারো এবং রাসূলুল্লাহর (ﷺ) বয়স বিশ। তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে; বিশ্রামের জন্য রাসূল (ﷺ) একটি গাছের নীচে বসেন। আবু বকর (রাযী) একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। এক খৃষ্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। আলাপের মাঝখানে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে, ওখানে গাছের নীচে কে? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মাদ বিন আবদিল্লাহ। পাদ্রী বলে উঠলো, এ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন। কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেঁথে যায়। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) প্রকৃত নবী হওয়া সম্পর্কে প্রত্যয় দৃঢ় হতে থাকে। ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বা ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নবুওয়াত লাভের ঘোষণায় মক্কায় হৈ চৈ পড়ে গেল। মক্কার প্রভাবশালী ধনী নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। কেউ তাঁকে বলতে থাকে মাথা খারাপ, কেউবা তাঁকে জীনে ধরা বলতে থাকে। নেতৃবৃন্দের ইংগিতে ও তাদের দেখাদেখি সাধারণ লোকেরাও ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকে। কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আবু বকর রাসূলুল্লাহকে (ﷺ) সংগ দেন, তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেন। এই প্রসংগে রাসূল (ﷺ) বলেছেন, “আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।” এভাবে আবু বকর (রাযিঃ) হলেন বয়স্ক আযাদ লোকদের মধ্যে প্রথম মুসলমান।
মুসলমান হওয়ার পর ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে তিনি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সাথে দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মক্কার আশপাশের গোত্রসমূহে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। হজ্জের মওসুমে বিভিন্ন তাঁবুতে গিয়ে লোকদের দাওয়াত দিতেন। বহিরাগত লোকদের কাছে ইসলামের ও রাসূলের (ﷺ) পরিচয় তুলে ধরতেন। এভাবে আরববাসী রাসূলুল্লাহর (ﷺ) প্রচারিত দ্বীন সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাঁর ওপর ঈমান আনে। তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব ও চেষ্টায় তৎকালীন কুরাইশ বংশের বিশিষ্ট যুবক উসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান, সা’দ ও তালহার মত ব্যক্তিরা সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন নবুওয়াতের প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন, আবু বকরের নিকট তখন চল্লিশ হাজার দিরহাম। ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সকল সম্পদ ওয়াক্ফ করে দেন। কুরাইশদের যেসব দাস-দাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দ্বারা তিনি সেই সব দাস-দাসী খরীদ করে আযাদ করেন। তেরো বছর পর যখন রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন তখন তাঁর কাছে এ অর্থের মাত্র আড়াই হাজার দিরহাম অবশিষ্ট ছিল। অল্পদিনের মধ্যে অবশিষ্ট দিরহামগুলিও ইসলামের জন্য ব্যয়িত হয়। বিলাল, খাব্বাব, আম্মার, আম্মারের মা সুমাইয়্যা, সুহাইব, আবু ফুকাইহ প্রমুখ দাস-দাসী তাঁরই অর্থের বিনিময়ে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই পরবর্তীকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসানসমূহ এমন যে, তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) মুখে মি’রাজের কথা শুনে অনেকেই যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝখানে দোল খাচ্ছিল, তখন তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন। হযরত হাসান (রা) বলেন, “মি’রাজের কথা শুনে বহু সংখ্যক মুসলমান ইসলাম ত্যাগ করে। লোকেরা আবু বকরের কাছে গিয়ে বলে, ‘আবু বকর, তোমার বন্ধুকে তুমি বিশ্বাস কর? সে বলেছে, সে নাকি গতরাতে বাইতুল মাকদাসে গিয়েছে। সেখানে সে নামায পড়েছে, অতঃপর মক্কায় ফিরে এসেছে।’
আবু বকর বললেন, “তোমরা কি তাকে অবিশ্বাস কর?” তারা বলল, ‘হ্যাঁ, ঐতো মসজিদে বসে লোকজনকে একথাই বলছে।’ আবু বকর বললেন, “আল্লাহর কসম, তিনি যদি এ কথা বলে থাকেন, তাহলে সত্য কথাই বলেছেন। এতে অবাক হওয়ার কি দেখলে? তিনি তো আমাকে বলে থাকেন, তাঁর কাছে আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে। আকাশ থেকে ওহী আসে মাত্র এক মুহূর্তের মধ্যে। তাঁর সে কথাও আমি বিশ্বাস করি। তোমরা যে ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করছো এটা তার চেয়েও বিস্ময়কর।” তারপর তিনি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) কাছে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর নবী, আপনি কি জনগণকে বলছেন যে, আপনি গতরাতে বাইতুল মাকদাস ভ্রমণ করেছেন?” তিনি (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ।” আবু বকর বললেন, “আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল।” রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, “হে আবু বকর, তুমি সিদ্দীক।” এভাবে আবু বকর সিদ্দীক’ উপাধিতে ভূষিত হন।
মক্কায় রাসূলুল্লাহর (ﷺ) অভ্যাস ছিল প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় আবু বকরের বাড়ীতে গমন করা। কোন বিষয়ে পরামর্শের প্রয়োজন হলে তাঁর সাথে পরামর্শ করা। রাসূল (ﷺ) দাওয়াত ও তাবলীগের উদ্দেশ্যে কোথাও গেলে তিনিও সাধারণত সংগে থাকতেন।
মুসলমানদের ওপর মুশরিকদের অত্যাচার চরম আকার ধারণ করলে একবার তিনি হাবশায় হিজরাত করার ইচ্ছা করেছিলেন। কিন্তু ‘ইবনুদ দাগনাহ’ নামক এক গোত্রপতি তাঁকে এ সিদ্ধান্ত থেকে বিরত রাখে। সে কুরাইশদের হাত থেকে এ শর্তে নিরাপত্তা দেয় যে, আবু বকর প্রকাশ্যে সালাত আদায় করবেন না, কিন্তু দীর্ঘদিন এ শর্ত পালন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ইবনুদ দাগনাহর নিরাপত্তা ফিরিয়ে দেন এবং অন্যান্য মুসলমান ভাইদের যে অবস্থা হয়- সন্তুষ্টচিত্তে তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) হিজরাতের সেই কঠিন মুহূর্তে আবু বকরের কুরবানী, বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্য ও বন্ধুত্বের কথা ইতিহাসে চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবে। তাঁর সাহচর্যের কথা তো পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে। ইবন ইসহাক বলেন, “আবু বকর রাসূলুল্লাহর (ﷺ) কাছে হিজরাতের অনুমতি চাইলে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁকে বলতেন, “তুমি তাড়াহুড়া করোনা। আল্লাহ হয়তো তোমাকে একজন সহযাত্রী জুটিয়ে দেবেন।” আবু বকর (রাযীঃ) একথা শুনে ভাবতেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হয়তো নিজের কথাই বলছেন। তাই তিনি তখন থেকেই দুটো উট কিনে অত্যন্ত যত্ন সহকারে পুষতে থাকেন; এই আশায় যে, হিজরাতের সময় হয়তো কাজে লাগতে পারে।
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রা) বর্ণনা করেন, “রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) দিনে অন্ততঃ একবার আবু বকরের বাড়ীতে আসতেন। যে দিন হিজরাতের অনুমতি পেলেন সেদিন দুপুরে আমাদের বাড়ীতে আসলেন, এমন সময় কখনো তিনি আসতেন না। তাঁকে দেখা মাত্র আবু বকর বলে উঠলেন, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। তা নাহলে এমন সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আসতেন না। তিনি বাড়িতে প্রবেশ করলে আবু বকর তাঁর খাটের একধারে সরে বসলেন। আবু বকরের বাড়ীতে তখন আমি আর আমার বোন আসমা ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘তোমার এখানে অন্য যারা আছে তাদেরকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে দাও।’ আবু বকর বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), আমার দুই মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই। আপনার কি হয়েছে?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে হিজরাত করার অনুমতি দিয়েছেন।’ আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমিও কি সংগে যেতে পারবো?’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারবে।’
আয়িশা (রা) বলেন, “সে দিনের আগে আমি জানতাম না যে, মানুষ আনন্দের আতিশয্যেও এত কাঁদতে পারে। আমি আবু বকরকে (রা) সেদিন কাঁদতে দেখেছি। অতঃপর আবু বকর (রা) বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই দেখুন, আমি এই উট দুটো এই কাজের জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছি।’
তাঁরা আবদুল্লাহ ইবন উরায়কাতকে পথ দেখিয়ে নেয়ার জন্য ভাড়া করে সাথে নিলেন। সে ছিল মুশরিক, তবে বিশ্বাস ভাজন। রাতের আঁধারে তাঁরা আবু বকরের বাড়ীর পেছন দরজা দিয়ে বের হলেন এবং মক্কার নিম্নভূমিতে ‘সাওর’ পর্বতের একটি গুহায় আশ্রয় নিলেন । হাসান বসরী (রা) থেকে ইবন হিশাম বর্ণনা করেন, “তাঁরা রাতে সাওর পর্বতের গুহায় পৌঁছেন। রাসূলুল্লাহর (ﷺ) প্রবেশের আগে আবু বকর (রা) গুহায় প্রবেশ করলেন। সেখানে কোন হিংস্র প্রাণী বা সাপ-বিচ্ছু আছে কিনা তা দেখে নিলেন। রাসূলুল্লাহকে (ﷺ) বিপদমুক্ত রাখার উদ্দেশ্যেই তিনি এরূপ ঝুঁকি নিয়েছিলেন।
মক্কায় উন্মুল মু’মিনীন হযরত খাদীজার (রাঃ) ওফাতের পর রাসূলকে (ﷺ) যখন আবু বকর (রা) বিমর্ষ দেখলেন, অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আদব সহকারে নিজের অল্পবয়স্কা কন্যা আয়িশাকে (রা) রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সাথে বিয়ে দেন। মোহরের অর্থও নিজেই পরিশোধ করেন।
হিজরাতের পর সকল অভিযানেই তিনি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) সাথে অংশগ্রহণ করেন।
কোন একটি অভিযানেও অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হননি। তাবুক অভিযানে তিনি ছিলেন মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী। এ অভিযানের সময় রাসূলুল্লাহর (ﷺ) আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়িতে যা কিছু অর্থ-সম্পদ ছিল সবই তিনি রাসূলুল্লাহর (ﷺ) হাতে তুলে দেন। আল্লাহর রাসূল (ﷺ) জিজ্ঞেস করেন, “ছেলে মেয়েদের জন্য বাড়ীতে কিছু রেখেছো কি?” তিনি জবাব দিলেন, ‘তাদের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই যথেষ্ট।’
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে প্রথম ইসলামী হজ্জ আদায় উপলক্ষে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু বকরকে (ﷺ) ‘আমীরুল হজ্জ’ নিয়োগ করেন। রাসূলুল্লাহর (ﷺ) অন্তিম রোগ শয্যায় তাঁরই নির্দেশে মসজিদে নববীর নামাযের ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন। মোটকথা, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) জীবদ্দশায় আবু বকর (রা) তাঁর উযীর ও উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করেন।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ওফাতের পর আবু বকর (রা) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ‘খলীফাতু রাসূলিল্লাহ’- এ লকবটি কেবল তাঁকেই দেওয়া হয়। পরবর্তী খলীফাদের “আমীরুল মু’মিনীন” উপাধি দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায় ছিল তাঁর পেশা। ইসলাম-পূর্ব যুগে কুরাইশদের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন তিনি। ইসলাম গ্রহণের পরেও জীবিকার প্রয়োজনে এ পেশা চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে খলিফা হওয়ার পর খিলাফতের গুরু দায়িত্ব কাঁধে পড়ায় ব্যবসার পাট চুকাতে বাধ্য হন। হযরত ‘উমার ও আবু উবাইদার পীড়াপীড়িতে মজলিসে শূরার সিদ্ধান্ত মুতাবিক প্রয়োজন অনুপাতে ‘বাইতুল মাল’ থেকে ন্যূনতম ভাতা গ্রহণ করতে স্বীকৃত হন। যার পরিমাণ ছিল বাৎসরিক আড়াই হাজার দিরহাম। তবে মৃত্যুর পূর্বে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ‘বাইতুলমাল’ থেকে গৃহীত সমুদয় অর্থ ফেরতদানের নির্দেশ দিয়ে যান।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ওফাতের সংবাদে সাহাবামণ্ডলী যখন সম্পূর্ণ হতভম্ব, তাঁরা যখন চিন্তাই করতে পারছিলেন না, রাসূলের (সা) ওফাত হতে পারে, এমনকি হযরত ‘উমার (রা) কোষমুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে ঘোষণা করে বসেন- “যে বলবে রাসূলের (ﷺ) ওফাত হয়েছে, তাঁকে হত্যা করবো।” এমনই এক ভাব-বিহ্বল পরিবেশেও আবু বকর (রা) ছিলেন অত্যন্ত দৃঢ় ও অবিচল। সমবেত জনতাকে লক্ষ্য করে তিনি ঘোষণা করেন, “যারা মুহাম্মাদের ইবাদাত করতে তারা জেনে রাখ, মুহাম্মাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু যারা আল্লাহর ইবাদত কর, তারা জেনে রাখ, আল্লাহ চিরঞ্জীব— তাঁর মৃত্যু নেই।” তারপর এ আয়াত পাঠ করেন, “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল ছাড়া আর কিছু নন। তাঁর পূর্বে বহু রাসূল অতিবাহিত হয়েছে। তিনি যদি মারা যান বা নিহত হন তাহলে তোমরা কি পেছনে ফিরে যাবে? যারা পেছনে ফিরে যাবে তারা আল্লাহর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। যারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শিগগিরই আল্লাহ তাদের প্রতিদান দেবেন।” (সূরা আলে ইমরান-১৪৪) আবু বকরের মুখে এ আয়াত শুনার সাথে সাথে লোকেরা যেন সম্বিত ফিরে পেল। তাদের কাছে মনে হল এ আয়াত যেন তারা এই প্রথম শুনছে। এভাবে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ইনতিকালের সাথে সাথে প্রথম যে মারাত্মক সমস্যাটি দেখা দেয়, আবু বকরের (রা) দৃঢ় হস্তক্ষেপে তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
রাসূলুল্লাহর (সা) কাফন-দাফন তখনো সম্পন্ন হতে পারেনি। এরই মধ্যে তাঁর স্থলাভিষিক্তির বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করলো। মদীনার জনগণ, বিশেষত আনসাররা ‘সাকীফা বনী সায়েদা’ নামক স্থানে সমবেত হলো। আনসাররা দাবী করলো, যেহেতু আমরা রাসূলুল্লাহকে (ﷺ) আশ্রয় দিয়েছি, নিজেদের জান-মালের বিনিময়ে দুর্বল ইসলামকে সবল ও শক্তিশালী করেছি, আমাদের মধ্য থেকে কাউকে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) স্থলাভিষিক্ত করতে হবে। মুহাজিরদের কাছে এ দাবী গ্রহণযোগ্য হলো না। তারা বললো, ইসলামের বীজ আমরা বপন করেছি এবং আমরাই তাতে পানি সিঞ্চন করেছি। সুতরাং আমরাই খিলাফতের অধিকতর হকদার। পরিস্থিতি ভিন্নদিকে মোড় নিল। আবু বকরকে (রা) ডাকা হল। তিনি তখন রাসূলুল্লাহর (ﷺ) পবিত্র মরদেহের নিকট। তিনি উপস্থিত হয়ে ধীর-স্থিরভাবে কথা বললেন। তাঁর যুক্তি ও প্রমাণের কাছে আনসাররা নতি স্বীকার করলো। এভাবে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ইনতিকালের পর দ্বিতীয় যে সমস্যাটি দেখা দেয়, আবু বকরের (রা) বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় তারও সুন্দর সমাধান হয়ে যায়।
আবু বকর খলীফা নির্বাচিত হলেন। খলীফা হওয়ার পর সমবেত মুহাজির ও আনসারদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই আমাকে খলীফা বানানো হয়েছে। আল্লাহর কসম, আমি চাচ্ছিলাম, আপনাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ এ দায়িত্ব গ্রহণ করুক। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আপনারা যদি চান আমার আচরণ রাসূলুল্লাহর (ﷺ) আচরণের মত হোক, তাহলে আমাকে সেই পর্যায়ে পৌঁছার ব্যাপারে অক্ষম মনে করবেন। তিনি ছিলেন নবী। ভুলত্রুটি থেকে ছিলেন পবিত্র। তাঁর মত আমার কোন বিশেষ মর্যাদা নেই। আমি একজন সাধারণ মানুষ। আপনাদের কোন একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকেও উত্তম হওয়ার দাবী আমি করতে পারিনা।… আপনারা যদি দেখেন আমি সঠিক কাজ করছি, আমার সহায়তা করবেন। যদি দেখেন আমি বিপথগামী হচ্ছি, আমাকে সতর্ক করে দেবেন।’
তাঁর সেই নীতিনির্ধারণী সংক্ষিপ্ত প্রথম ভাষণটি চিরকাল বিশ্বের সকল রাষ্ট্রনায়কদের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।
তাঁর চরিত্রের সীমাহীন দৃঢ়তার আরো এক প্রকাশ ঘটে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ইনতিকালের অব্যবহিত পরে উসামা ইবন যায়িদের বাহিনীকে পাঠানোর মাধ্যমে। রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ওফাতের অল্প কিছুদিন আগে মুতা অভিযানে শাহাদাত প্রাপ্ত যায়িদ ইবন হারিসা, জাফর ইবন আবী তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার (রা) রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। এ বাহিনীর কমাণ্ডার নিযুক্ত করেন নওজোয়ান উসামা ইবন যায়িদকে। রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নির্দেশে উসামা তাঁর বাহিনীসহ সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলেন। তাঁরা মদীনা থেকে বের হতেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁরা মদীনার উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) রোগমুক্তির প্রতীক্ষা করতে থাকেন। কিন্তু এ রোগেই রাসূল (ﷺ) ইনতিকাল করেন। আবু বকর (রা) খলীফা হলেন। এদিকে রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ওফাতের সংবাদে আরব উপদ্বীপের বিভিন্ন দিকে নানা অপশক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। কেউবা ইসলাম ত্যাগ করে, কেউবা যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়, আবার কেউবা নবুওয়াত দাবী করে বসে। এমনি এক চরম অবস্থায় অনেকে পরামর্শ দিলেন উসামার বাহিনী পাঠানোর ব্যাপারটি স্থগিত রাখতে। কিন্তু আবু বকর (রা) অত্যন্ত কঠোরভাবে এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি যদি এ বাহিনী পাঠাতে ইতস্ততঃ করতেন বা বিলম্ব করতেন, তাহলে খিলাফতের দায়িত্ব লাভের পর এটা হতো রাসূলুল্লাহর (ﷺ) নির্দেশের প্রথম বিরুদ্ধাচরণ। কারণ, অন্তিম রোগশয্যায় তিনি উসামার বাহিনীকে যাত্রার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
আবু বকর (রা) উসামার বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। তখন আনসারদের একটি দল দাবী করলেন, তাহলে অন্ততঃ উসামাকে কমাণ্ডারের পদ থেকে সরিয়ে অন্য কোন বয়স্ক সাহাবীকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করা হোক। উল্লেখ্য যে, তখন উমাসার বয়স মাত্র বিশ বছর। সকলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি হযরত উমার উপস্থাপন করলেন। প্রস্তাব শুনে আবু বকর (রা) রাগে ফেটে পড়লেন। তিনি উমারের (রা) দাড়ি মুট করে ধরে বল্লেন, “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যাকে নিয়োগ করেছেন, আবু বকর তাকে অপসারণ করবে?” এভাবে এ প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।
হযরত উমারও ছিলেন উসামার এ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত একজন সৈনিক। অথচ নতুন খলিফার জন্য তখন তাঁর মদীনায় থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। খলীফা ইচ্ছা করলে তাঁকে নিজেই মদীনায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি উসামার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করে তাঁর কাছে আবেদন জানালেন উমারকে মদীনায় রেখে যাওয়ার জন্য। উসামা খলীফার আবেদন মঞ্জুর করলেন। কারণ, আবু বকর বুঝেছিলেন উসামার নিয়োগকর্তা খোদ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। সুতরাং এ ক্ষেত্রে উসামার ক্ষমতা তাঁর ক্ষমতার ওপরে। এভাবে আবু বকর (রা) রাসূলুল্লাহর (ﷺ) আদেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেন এবং তাঁর সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণ থেকেও বিরত থাকেন।
রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ইনতিকালের পর আবাস ও জুবইয়ান গোত্রদ্বয় যাকাত দিতে অস্বীকৃতি জানায়। বিষয়টি নিয়ে খলীফার দরবারে পরামর্শ হয়। সাহাবীদের অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান না চালানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু আবু বকর (রা) অটল। তিনি বললেন, “আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহর (ﷺ) যুগে উটের যে বাচ্চাটি যাকাত পাঠানো হতো এখন যদি কেউ তা দিতে অস্বীকার করে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবো।”
কিছু লোক নবুওয়াতের মিথ্যা দাবীদার ছিল। আবু বকর (রা) অসীম সাহস ও দৃঢ়তা সহকারে এসব ভণ্ড নবীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ইসলামের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র নস্যাত করে দেন। তাই ইতিহাসবিদরা মন্তব্য করেছেন, “আল্লাহর সাহায্য ও সহায়তার পর যদি আবু বকরের এ দৃঢ়তা না হতো, মুসলিম জাতির ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লেখা হতো।”
এমনটি সম্ভব হয়েছে এজন্য যে, হযরত আবু বকরের (রা) স্বভাবে দু’টি পরস্পরবিরোধী গুণের সমাবেশ ঘটেছিল, সীমাহীন দৃঢ়তা ও কোমলতা। এ কারণে তাঁর চরিত্রে সর্বদা একটা ভারসাম্য বিরাজমান ছিল। কোন ব্যক্তির স্বভাবে যদি এ দু’টি গুণের কেবল একটি বর্তমান থাকে এবং অন্যটি থাকে অনুপস্থিত, তখন তার চরিত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে এ দু’টি গুণ তাঁর চরিত্রে সমানভাবে বিদ্যমান ছিল। হযরত আবু বকর (রা) যদিও মুসলমানদের নেতা ও খলীফা ছিলেন, তবুও তাঁর জীবন ছিল খুব অনাড়ম্বর। খলীফা হওয়া সত্ত্বেও মদীনার অলিগলিতে ঘুরে ঘুরে জনগণের অবস্থা জানতেন এবং তাদের ব্যক্তিগত কাজও সময় সময় নিজ হাতে করে দিতেন। হযরত উমার (রা) বলেন, “আমি প্রতিদিন সকালে এক বৃদ্ধার বাড়ীতে তার ঘরের কাজ করে দিতাম। প্রতিদিনের মত একদিন তার বাড়ীতে উপস্থিত হলে বৃদ্ধা বললেন, ‘আজ কোন কাজ নেই। এক নেককার ব্যক্তি তোমার আগেই কাজগুলি শেষ করে গেছে।’ হযরত উমার পরে জানতে পারেন, সেই নেককার লোকটি হযরত আবু বকর (রা)। খলীফা হওয়া সত্ত্বেও এভাবে এক অনাথ বৃদ্ধার কাজ করে দিয়ে যেতেন।”
হযরত আবু বকর (রা) মাত্র আড়াই বছরের মত খিলাফত পরিচালনা করেন। তবে তাঁর এ সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। রাসূলুল্লাহর (ﷺ) ইনতিকালের পর তাঁর সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখা। আরবের বিদ্রোহসমূহ নির্মূল করা। রাষ্ট্রও সরকারকে তিনি এত মজবুত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন যে, মুসলমানরা ইরান ও রোমের মত দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে সাহসী হয় এবং অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বহু অঞ্চল দখল করে নেয়।
হযরত আবু বকরের (রা) আরেকটি অবদান পবিত্র কুরআনের সংকলন ও সংরক্ষণ। তাঁর খিলাফতকালের প্রথম অধ্যায়ে আরবের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। সেইসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে কয়েকশত হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন। শুধুমাত্র মুসায়লামা কাজ্জাবের সাথে যে যুদ্ধ হয় তাতেই সাত শ’ হাফেজ শহীদ হন। অতঃপর হযরত উমারের পরামর্শে হযরত আবু বকর (রা) সম্পূর্ণ কুরআন একস্থানে গ্রন্থাকারে সংকলন করেন এবং কপিটি নিজের কাছে সংরক্ষণ করেন। ইতিহাসে কুরআনের এই আদি কপিটি ‘মাসহাফে সিদ্দীকী’ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে হযরত ‘উসমানের (রা) যুগে কুরআনের যে কপিগুলি করা হয় তা মূলতঃ মাসহাফে সিদ্দীকীর’ অনুলিপি মাত্র। পবিত্র কুরআন ও রাসূলের (ﷺ) বাণীতে আবু বকরের সীমাহীন মর্যাদা ও সম্মানের কথা বহুবার বহু স্থানে ঘোষিত হয়েছে।
হযরত আবু বকর (রা) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা জাহাবী ‘তাজকিরাতুল হুফফাজ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। অত্যধিক সতর্কর্তার কারণে তাঁর বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় খুব কম। উমার, উসমান, আবদুর রহমান ইবন আউফ, ইবন মাসউদ, ইবন উমার, ইবন আমর ইবন আব্বাস, হুজাইফা, যায়িদ ইবন সাবিত, উকবা, মা’কাল, আনাস, আবু হুরাইরা, আবু উমামা, আবু বারাযা, আবু মুসা, তাঁর দু’কন্যা আয়িশা ও আসমা প্রমুখ সাহাবী তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। বিশিষ্ট তাবেয়ীরাও তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন।”
১৩ হিজরীর ৭ জমাদিউল উখরা হযরত আবু বকর (রা) জ্বরে আক্রান্ত হন। ১৫ দিন রোগাক্রান্ত থাকার পর হিজরী ১৩ সনের ২১ জামাদিউল উখরা মুতাবিক ৬৩৪ খৃষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ইনতিকাল করেন। হযরত আয়িশার (রা) হুজরায় রাসূলুল্লাহর (ﷺ)-এর পাশের একটু পূর্ব দিকে তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি দু’বছর তিন মাস দশ দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলাম ও মুসলিমের প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালনের দৃঢ়তা এবং রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস, ভালবাসা ও শ্রদ্ধার কারণে আবু বকর (রাযিঃ)-এর নাম এই উম্মাহর মধ্যে সবার উপরে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
লিখেছেন : উসামা মাহমুদ
Masaallah, very nice writing.