“আরিবা নিস্পাপ অবুঝ শিশু। আমাদের জিজ্ঞেস করতে থাকে তার ‘বাবা’ কোথায়। ৪ বছর বয়সী বাচ্চাকে আমি কী বলে বোঝাব? যে তার বাবা ১,৪০০ দিনেরও বেশি সময় ধরে হিন্দুবাদীদের কারাগারে রয়েছেন।” – ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এ কথাগুলো বলেছেন কাশ্মীরি সাংবাদিক আসিফ সুলতানের স্ত্রী সাবিনা আক্তার।
মুসলিম কাশ্মীরি সাংবাদিক আসিফ, যাকে ২০১৯ সালে জন অবুচন প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল, গত ৪ বছর ধরে তিনি জেলে আছেন। তার পরিবারের বক্তব্য, তিনি হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে সাংবাদিকতা করার কারণেই তাকে আটক করা হয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে আসিফকে একটি পৃথক মামলায় জামিন দেওয়ার কয়েকদিন পরেই পুনরায় গ্রেপ্তার করে হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন। আসিফের পরিবার জানিয়েছে, আরিবা আসিফের জন্য এটি সবচেয়ে কঠিন যে, সে তার বাবাকে ভালভাবে চেনে না এবং বাবার আদর ছাড়াই বড় হচ্ছে।
আসিফের বাবা মোহাম্মদ সুলতান (৬৫) মিডিয়াকে বলেছেন, “আমি তাকে বারবার শান্তনা দেই যে তার বাবা ফিরে আসবে। কিছু দিন আগে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদু দাদু, তুমি তো বলেছিলে আব্বু আসবে, আমার আব্বু কোথায়?’ সে তো এখনো আসেনি।” তার পরিবার মিডিয়াকে জানিয়েছে তাকে বিনা বিচারে গ্রেপ্তারের ফলে তার মেয়ের উপর কতটা বিদ্রুপ প্রভাব পড়েছে। মোহাম্মদ সুলতান তার পুত্রবধূ গত চার বছরে সে যে কত সমস্যার মাঝে বসবাস করেছে সে সম্পর্কেও কথা বলেছেন। সাবিনা বলেছিলেন যে তিনি খুব আশাবাদী যে তিনি ফিরে আসবেন এবং তাদের সাথে থাকবেন।
২০১৮ সালে যখন আসিফকে প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তখন সাবিনা মিডিয়াকে বলেছিলেন। “প্রথম দিকে আমি খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম, বিশেষ করে যখন আরিবা খুব ছোট ছিল। তার বয়স তখন মাত্র ৬ মাস। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না, আমি কি ওর যত্ন নেব নাকি নিজের? কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে শক্তি দিয়েছেন। আমাকে আমার আবেগের যত্ন নিতে হয়েছিল কারণ আমার আবেগ আরিবাকেও প্রভাবিত করবে। আমি যদি হতাশ হতাম তবে কে আমাদের সন্তানের যত্ন নেবে?”
তিনি বলেছিলেন যে তার স্বামীকে ছাড়া বেঁচে থাকা খুব কঠিন ছিল। তাছাড়া, আরিবা ঐই বছর ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল যা তার জীবনে একটি অতিরিক্ত উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সাবিনা একজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি অনুমান করেছিলেন যে আরিবা আসিফকে ছাড়া বেঁচে থাকার কারণে মানসিক প্রতিবন্ধি হয়ে যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে এক পর্যায় অশ্রুসিক্ত হয়ে সাবিনা বলেন, “সে অন্য সন্তানের বাবাদের দেখে এবং নিজের বাবাকে খুঁজতে থাকে। বলতে থাকে আমার বাবা কোথায়? আমার বাবা আসে না কেন বলে মাঝে মাঝে কাঁদতে থাকে।”
সাবিনা আরো জানিয়েছেন যে, সাম্প্রতিক একটি স্কুল অ্যাসাইনমেন্টে যেখানে তাকে তার বাবার বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছিল, আরিবা লিখতে ছিল “বাবা জেলে আছে।” তার মেয়েকে বোঝাতে হয়েছিল যে সে তার স্কুল অ্যাসাইনমেন্টে এমন কিছু বলতে/লিখতে পারে না এবং তাকে বলতে/লিখতে বাধ্য করেছিল, “বাবা অফিসে আছেন।” সবচেয়ে খারাপ দিক হল আরিবা মনে করে নিয়েছে যে, বাবা দূরেই থাকবে। এর আগে যখন তারা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসিফকে দেখতে গিয়েছিল, তখন আরিবা মনে করতো জেলটি তার বাবার বাড়ি এবং তাদের নিজস্ব বাড়ি আলাদা। সে তার বাবাকে চিনতেও পারে না। “আমরা তাকে ছবি এবং ভিডিও দেখাই যেগুলোতে আসিফ আছে যাতে সে তাকে চিনে। সে আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আমি বাবার কোলে আছি এমন কোনো ভিডিও আছে কি?”
যে দুটি পরিচয়ের কারণে আসিফের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে, তা হল: তিনি একজন মুসলিম এবং একজন কাশ্মীরি সাংবাদিক। কাশ্মীরের মতো বিশ্বে নজিরবিহীন উচ্চ সামরিকায়িত অঞ্চলে স্বাধীন সাংবাদিকতা কখনই সহজ ছিল না। বিশেষ করে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল হওয়ার পর থেকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর হিন্দুত্ববাদীদের হামলা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। সাংবাদিকদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মাধ্যমে কোণঠাসা করা হয়। ঘন ঘন গ্রেপ্তার করা হয়। সে বছরই কাশ্মীর প্রেসক্লাবও বন্ধ করে দেয় হিন্দুবাদী ভারত সরকার।
এদিকে আসিফের বাবা হার্টের রোগী। এক বছর আগে তার হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচার করা হয়। এবং তার হৃদপিণ্ডে রক্তের প্রবাহের জন্য তার বুকে একটি ডিভাইস লাগানো হয়েছিল। এই মুহুর্তে পরিবার আসিফের অনুপস্থিতিতে কঠিন সময় পার করছে। আসিফও অনেক দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে, তার বাবার প্রয়োজনে পাশে থাকতে পারেননি।
সাবিনা ও আসিফের বন্ধু তার সাংবাদিকতার শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা বলেছেন।
সাবিনা বলেন, “আসিফ খুব নরম স্বভাবের মানুষ। তিনি কারো সাথে ঝগড়া করার মতো ব্যক্তি নন, তিনি কেবল নিজের, তার আচরণ, কাজ এবং পরিবারের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। তিনি একজন সম্পূর্ণ পারিবারিক মানুষ, এবং সবসময় তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।”
অন্যদিকে আসিফের বন্ধু বলেন, “আসিফ একজন পরিশ্রমী মানুষ। তিনি তার স্কুল জীবনে ভাল রেজাল্ট করেছিলেন এবং ভাল সুনাম অর্জন করেছিলেন। সুলতান একজন গেজেটেড অফিসার ছিলেন এবং আসিফ ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। আসিফ একজন মেডিকেল স্টুডেন্টও ছিলেন, কিন্তু তার লেখালেখির দক্ষতা ছিল এবং তিনি এটিকে “সাংবাদিকতা” হিসেবে নিয়েছেন। আমি তাকে আমার শিক্ষক মনে করি। একজন ব্যক্তি এবং একজন সাংবাদিক হিসেবে তিনি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল এবং সৎ।”
আসিফ ২০১৮ সালে কাশ্মীর ন্যারেটরের জন্য ‘দ্য রাইজ অফ বুরহান’ লিখেছিলেন। আসিফের বন্ধু বলেন, “সে যখন এই লেখাটি লিখেছিল, তখন সে আমার কাছ থেকে একটি সতর্কবার্তা পেয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম যে, ‘আপনি একটি উচ্চ সামরিক এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাস করেন, সেখানে একটি প্রতিক্রিয়া হতে পারে’, কিন্তু তিনি ভয় পাননি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘এতে কোনও ভুল নেই, এটা আমার সাংবাদিকতার কাজ।’ যাই হোক না কেন, আমি তাকে নিয়ে খুব গর্বিত এবং আমি সবসময় তার পাশে থাকব।”
“তিনি তার লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। তার লেখা প্রকাশিত হওয়ার পরই তিনি হিন্দুত্ববাদীদের হুমকি সম্বলিত কল পেতে শুরু করেছিল। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে হিন্দুত্ববাদী কর্তৃপক্ষ তাকে সমস্যা করবে। কারণ প্রতিষ্ঠিত সত্যের প্রতি তাদের এলার্জি রয়েছে। তারা বিশ্ববাসীকে কাশ্মীরের ‘সাব কুচ চাঙ্গা হ্যায়’ ছবি দেখাতে চায়। অর্থাৎ সবকিছু ঠিক আছে। হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসনের ব্যাপারে অন্ধকারে রাখতে চায়।”
আসিফের এই গল্প প্রতিটি কাশ্মীরির গল্প। কাশ্মিরের প্রতিটি যুবক যেন এক এক জন আসিফ, হিন্দুত্ববাদের জিঘাংসা আর পাশবিকতার শিকার। কাশ্মীর সহ গোটা উপমহাদেশ আজ হিন্দুত্ববাদের শিকলে বন্দী। এ শিকল কে ছিন্ন করবে, কে আজ হিন্দুত্ববাদের এই সর্বগ্রাসি স্রোতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, অসহায় এই উম্মতকে আজ কে পথ দেখাবে, কেউ আছে কি?
লেখক : উসামা মাহমুদ
তথ্যসূত্র:
1. “Our daughter keeps asking where her baba is”: Aasif Sultan’s wife on her husband’s incarceration
– https://tinyurl.com/ynyye3pn