২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। গোটা গুজরাটে মুসলিমদের বাড়িঘরে হিন্দুত্ববাদীদের দেয়া আগুন জ্বলছে। চলছে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম নিধনযজ্ঞ। হিন্দুত্ববাদীরা একের পর এক অসহায় মুসলিমদের খুন করে চলেছে। আর তা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন এবং সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে।
এমন সংকটময় অবস্থায় হিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে রক্ষা পেতে, বিলকিস বানুর পরিবার নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরিবারের মোট ১৪ জন সদস্য একটি মিনি ট্রাক চড়ে গোপনে অন্য স্থানে চলে যেতে উদ্যত হয়। পথিমধ্যে কাস্তে, তলোয়ার, লাঠি নিয়ে ২০-৩০ একদল উন্মত্ত, ধর্মান্ধ দাঙ্গাবাজ হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। বিলকিস বানু তখন গর্ভবতী, সঙ্গে আড়াই বছরের কন্যা সন্তান। তার মাছুম কন্যার মাথায় তরবারি চালিয়ে খুন করা হয়। চোখের সামনে একের পর এক পরিবারের ১৩ জন সদস্যকে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে খুন হতে দেখে বিলকিস বানো।
পরিবারের 8 জন নারীকে হত্যা করার আগে, গণধর্ষণ করা হয়। ছাড় পায়নি বিলকিস নিজেও।
গণধর্ষণ ও খুনের জঘন্য অপরাধে গ্রেপ্তার মোট ১৩ জনের প্রত্যেকেই ছিলো বিলকিসের প্রতিবেশী, পরিচিত, চেনাজানা। বিলকিস সকল অভিযুক্তকে সনাক্ত করেন। বিলকিস এদের সকলকেই চিনতেন। যেমন বিপিন চন্দ্র জোশীর বাড়ি ওর বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে। বিলকিসের বাবা ওষুধ বিষুধের দরকার হলে বিপিনের বাবার ক্লিনিকেই যেতেন। প্রদীপ মধিয়া আর নরেশ মধিয়া দুজনেই ছোট দুটো হোটেল চালাত। এরা সবাই একই মহল্লায় থেকে এসেছে বরাবর।
রাধিকাপুরের মসজিদের পাশে থাকত শৈলেশ ভট্ট। ঘটনার দিনকয়েক আগেই শৈলেশ বিলকিসের হাতে করা চা খেয়ে গেছে ওই বাড়িতে বসে। ঘটনার দিন সে কোন কথা শুনেনি। সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট সালেহাকে খুন করতেও তার হাত কাঁপেনি।
তিন প্রৌঢ়, জসবন্ত নাই, গোবিন্দ নাই আর নরেশ মধিয়া বিলকিসকে ধরেছিল। তারপর সেই তিন প্রৌঢ় বিলকিসকে বিবস্ত্র করে। জসবন্তকে অনুরোধ করল ১৯ বছরের বিলকিস, “চাচা, আমি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আমাকে ছেড়ে দাও।” গোবিন্দ আর নরেশকে অনুরোধ করল তাকে ছেড়ে দিতে। নরেশ বিলকিসের হাত চেপে ধরল, গোবিন্দ তার বুকে পা তুলে দিল। তারপর তিনজন মিলে একে একে ধর্ষণ করল অন্তঃসত্ত্বা বিলকিসকে। অজ্ঞান বিলকিসকে মৃত ভেবে রাস্তায় ফেলে চলে যায় হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা।
কয়েক ঘন্টা পর জ্ঞান আসে বিলকিসের। চোখ খুলে দেখে তার চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে তারই পরিবারের সকলের রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত লাশ। মাত্র এক দিন বয়সী ভাগ্নিকেও রেহাই দেয়নি ওরা। তার পাশেই পড়ে আছে ওর নিজের সাড়ে তিন বছরের মেয়ে সালেহার লাশ। মুখটা এমন থেঁতলে গেছে যে চেনাই যায়না।
পরে বিলকিস বানু স্থানীয় থানায় মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। এতে বিলকিস বানু এবং তার পরিবারেব বাকী সদস্যদেরও হত্যার হুমকি দিতে থাকে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা। অনেক হয়রানির পর সুপ্রিম কোর্ট মামলাটি গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্রে নিয়ে যায়।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে মুম্বাই-এর একটি আদালত গণধর্ষণ ও হত্যার দায়ে ১৯ আসামির মধ্যে মাত্র ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তবে বিলকিস বানু গণধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ঐ এগার হিন্দু সন্ত্রাসীকে গত ১৫ আগস্ট ২০২২ তারিখে মুক্তি দিয়েছে হিন্দুত্ববাদী গুজরাট সরকার। পরে গোধরা সাব-জেল থেকে তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়।
মুসলিম নারীকে ধর্ষণ করার কারণে আসামীদেরকে হিন্দুত্ববাদীরা ফুলের মালা দিয়ে বীরের মতো বরণ করে নিয়েছে। এবং মিষ্টি বিতরণ করেছে। এমন জঘন্য আসামীদের মুক্তি দেওয়ার পর বিসকিস বানু ও অন্যান্য মুসলিম পরিবারগুলো খুবই আতঙ্কের মাঝে পড়েছেন।
কারণ তাদের নামে মামলা করার সময়েই তারা হুমকি দিয়েছিল যে, সুযোগ পেলে তারা বাকিদেরকেও খুন করবে। এখন তো তারা জেল থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে। ফলে যেকোন সময় তারা সে গ্রামে বসবাসরত মুসলিমদের উপর হামলা করতে পারে। এই ভয়ে সেখানে বসবাসরত মুসলিমরা তাদের মুক্তির পর থেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন।
গত ২১ আগস্ট রবিবার, ২৪ বছর বয়সী এক মুসলিম নারী সুলতানা তার মা এবং বোনের সাথে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্য কলোনিতে এসে পড়েছে। এই মুসলিম নারী জানিয়েছে, “গত সপ্তাহ থেকে মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। কারণ অন্যান্য হিন্দুরা তাদেরকে বীরের মত স্বাগত জানিয়েছে। গ্রামে হিন্দুদের মাঝে আনন্দের অনুভূতি বিরাজ করছে। ফলে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। এবং চলে অন্যত্র চলে এসেছি। কারণ আমরা সেখানে নিরাপদ বোধ করিনি। যখন তারা প্যারোলে বেরিয়ে আসত তখন এটি আলাদা ছিল, কারণ আমরা জানতাম যে তারা শেষ পর্যন্ত বন্দী ছিল, থাকবে। কিন্তু এখন তারা মুক্তি পেয়েছে।”
শুধু মুক্তি নয়, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১১ জনের কপালে তিলক কেটে, মিষ্টিমুখ করিয়ে, মালা পরিয়ে স্বাগত জানানোর দৃশ্যও সামনে এসেছে।
কথিত সভ্য সমাজের মানুষের একবার ভেবে দেখা উচিত, যে অমানুষগুলো একের পর এক মহিলাকে ধর্ষণ করেছে, একের পর এক মানুষকে খুন করেছে। মাত্র এক দিন বয়সী ও ২ বছরের শিশুকে তরবারির আঘাতে ও মাথা থেতলিয়ে খুন করেছে। তারা কোন যুক্তির ভিত্তিতে ক্ষমা পেয়েছে? নিশ্চয়ই তারা হিন্দু হওয়াতেী তাদের ১৪ খুন মাফ!
গুজরাট সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়েছিল হিন্দুত্ববাদী বিজেপি বিধায়ক রাউলজির কাছে। জবাবে সংবাদমাধ্যমে সে বলেছে, ওরা সব ব্রাহ্মণ সন্তান। মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ।
এ ঘটনাই প্রমাণ করে হিন্দুত্ববাদী আইন আদালত কতটা মুসলিমদের কাজে আসে! তারা ব্রাহ্মণের সন্তান হওয়ায় জঘন্য অপরাধ করেও ক্ষমা পায়। আর মুসলিমরা বিনা অপরাধে কারাগারে পঁচে মরে।
এ নিয়ে মিডিয়াতে কোন সমালোচনা নেই; দালাল বুদ্ধিজীবীরাও মুখ খুলছে না। কোন কথিত নারীবাদীও এ নিয়ে প্রতিবাদ করেনি। মসজিদের আজানের আওয়াজে যে সেক্যুলারের ঘুম ভেঙে যায়, রুশদির উপর আক্রমণে যে প্রগতিবাদীর কণ্ঠ সঙ্গত ভাবেই সরব হয়ে ওঠে, কুমিল্লায় পুজো-মণ্ডপে হামলার নাটকে যে কণ্ঠে মেকি প্রতিবাদ ধ্বনিত ধ্বনিত হয়ে ওঠে- সেই সেক্যুলারদের সভ্যতা-মানবতা আজ হাড়হিম করা নীরবতায় নিমগ্ম কেন?
লিখেছেন : মাহমুদ উল্লাহ্
তথ্যসূত্র :
1. Indian Express: ‘There is fear’: Muslim families flee village, take shelter in relief colony
– https://tinyurl.com/ycxy66z5
2. Bilkis Bano Case: ‘ওরা ব্রাহ্মণ, মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ’, বিলকিসের ধর্ষকদের দরাজ সার্টিফিকেট বিজেপি বিধায়কের
– https://bit.ly/3KhG6MA
3. NewsClick : Bilkis Bano Case: 11 Convicts set Free by Gujarat Government Under its Remission Policy
– https://tinyurl.com/2p84kp5u
4. ‘There is fear’: Muslim families flee village, take shelter in relief colony
– https://tinyurl.com/4hu5ndm6