মুহাম্মাদ তাহির, ৩৬ বছর বয়সী এই যুবক ২০০৮ সালে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন এবং সেই বছরই কাশ্মিরে ফিরে আসেন। তাহির তখন ছিলেন অনেক খুশি কারণ তার চিন্তায় তখন বিরাজ করছিল তাঁর সুন্দর ভবিষ্যৎ। তার বাবা ছিলেন একজন দোকানদার, সাত জনের পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। তাহিরের পরিবার তার পোস্ট-গ্র্যাজ্যুয়েশন শেষে তার কর্মজীবন শুরু করার ব্যপারে ছিল অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত।
তাহির যখন কাশ্মিরে আসেন, তখন সেখানে শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হবার শেষ সুযোগ ছিল। তাহির যেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে এবং তার যেন সময় নষ্ট না হয় সেজন্য তার মা নিজের গহনা বিক্রি করে দেন। এরপর তাহির তাঁর বিশের দশকের শুরুর দিকেই “শান্তি ও দ্বন্দ্ব শিক্ষা” (পিস এন্ড কন্ফ্লিক্ট স্টাডিজ)-এ তার পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। একই বিষয়ে তিনি জাপানের ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ জাপান’-এ তাঁর দ্বিতীয় পোস্ট-গ্র্যাজ্যুয়েশন সম্পন্ন করেন।
জাপানে একই বিষয়ে দ্বিতীয় দফায় পোস্ট-গ্র্যাজ্যুয়েশন সম্পন্ন করার ব্যপারে তাহির বলেন যে, ২০১০ সালের কাশ্মির বিদ্রোহ সেখানের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই পড়াশোনাকে ব্যাহত করে। এবং এ কারণেই তিনি জাপানে গিয়ে একই বিষয়ে দ্বিতীয় দফায় তার পোস্ট-গ্র্যাজ্যুয়েশন সম্পন্ন করেন।
জাপান থেকে তিনি আয়ারল্যান্ডের ‘ডাবলিন সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভর্তি হন। সেখানে তিনি “রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক” বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। পিএইচডি শেষে তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়েই সহকারী অধ্যাপক হিসাবে চাকরি পান। তার পরিবার তখন খুশি ছিল। কিন্তু এক বছর পরেই ২০২০ সালে কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে তিনি ভারতে ফিরে আসেন।
তাহির নিশ্চিত ছিলেন যে, কাশ্মীরে তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসাবে কোথাও চাকরি পেয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে যান যখন কাশ্মীরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ‘অপর্যাপ্ত’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তখন পর্যন্ত স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক জার্নালে ‘১০টি প্রকাশনা’ (পিয়ার-রিভিউ করা জার্নালগুলিতে দুটি) এবং ‘জাতীয় যোগ্যতা পরীক্ষায়’ [এনইটি টেস্ট- বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলিতে ‘সহকারী অধ্যাপক’ এবং ‘জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ ও সহকারী অধ্যাপক’ এর জন্য ভারতীয় নাগরিকদের যোগ্যতা নির্ধারণে পরিচালিত একটি পরীক্ষা] পাস করা সত্ত্বেও, তাঁকে কাশ্মীরে শিক্ষকতার অযোগ্য বলে মনে করা হয়।
আজ এক বছরেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, কিন্তু তাহির এখনও বেকার। তার শিক্ষকতার কর্মজীবন পুনরায় শুরু করতে না পারায় তিনি এখন হতাশ, তাঁর জীবন বিষণ্ণ। তিনি এখন তাঁর সামান্য সঞ্চয় এবং কয়েক মাস ধরে ‘অতিথি অনুষদের সদস্য’ (গেস্ট ফ্যাকাল্টি মেম্বার) হিসাবে কাজ করেই বেঁচে আছেন।
কাশ্মীরের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত যে বিষয়ে পড়ানো হয় সেই বিষয়ের প্রার্থীদেরই নিয়োগ দেবার প্রচলন আছে। ‘স্বজাতীয়’ কোন বিষয়ের ডিগ্রীধারীদের তারা সেক্ষেত্রে গ্রহণ করে না। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অনেক জায়গাতেই প্রার্থীরা “শান্তি ও দ্বন্দ্ব শিক্ষার” মতো ‘স্বজাতীয়’ যেকোন বিষয়ে মাস্টার্স করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চুক্তিভিত্তিক সহকারী অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করতে পারে।
কাশ্মিরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘রাজনীতি ও প্রশাসন’ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খালিদ ওয়াসিম বলেন, ‘স্বজাতীয়’ বিষয়ের ডিগ্রীধারী প্রার্থীদের শিক্ষকতার পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে মানদণ্ড কাশ্মীরে প্রচলিত তা শিথিল করা প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন যে, ইউজিসি’র যে গাইডলাইন আছে তা কাশ্মীরে সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না। তিনি এটিকে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীদের প্রতি ‘অবিচার’ এবং ‘বৈষম্যমূলক’ আচরণ বলেও অভিহিত করেন।
হিন্দুত্ববাদী ভারতের দখলকৃত কাশ্মীরে মুসলিম শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে তাঁদের অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে ‘মানসিক টর্চার’ করা হিন্দুত্ববাদী প্রশাসনের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেরই একটি অংশ বলে মনে করেন অনেক মুসলিম বিশেষজ্ঞগণ। মুসলিমদেরকে হতাশ ও বিষণ্ণময় জীবন যাপন করতে বাধ্য করে তাঁদের দিশেহারা করা হিন্দুত্ববাদীদের অনেক দিনেরই একটি পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনায় তারা এখনও পর্যন্ত বেশ সফল।
তবে বর্তমানে কাশ্মীরের মুসলিমরা আগের যেকোন সময়ের চেয়ে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য অনেক বেশি মরিয়া। তাই হিন্দুত্ববাদীদের এ ধরণের পরিকল্পনা তাদের জন্যই বুমেরাং হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞগণ। কারণ, বাস্তবতা ইতিমধ্যে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, অস্ত্র আর ত্যাগ ছাড়া স্বাধীনতা আসে না।
অনুবাদক ও সংকলক : আবু উবায়দা
তথ্যসূত্র:
1. Why Hundreds Of Kashmiri Scholars Are Rejected For Teaching Jobs In Kashmir Universities, Colleges
– https://tinyurl.com/k8mk3eed