মাদকের স্বর্গরাজ্য থেকে মাদকমুক্ত ইসলামি সাম্রাজ্যের পথে আফগানিস্তান

    সাইফুল ইসলাম

    0
    1164

    কিছুদিন আগে কাবুলসহ আফগানিস্তানের বড় বড় শহরগুলোতে অভিযান চালিয়ে অন্তত ৮৩ হাজার মাদকাসক্তকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখন মাদক বিক্রেতা নেটওয়ার্ককে টার্গেট করে অভিযান পরিচালনা করছেন ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান কর্তৃপক্ষ।

    স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকবিরোধী সংস্থার কর্মকর্তাদের মতে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা মাদকাসক্তদের কাছ থেকেই মাদক বিক্রেতাদের নেটওয়ার্ক সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে, কাবুল, পুল সুখতা এবং এর আশপাশের এলাকা যেমন: সারাই নর্থ, নাদের খান পাহাড়ী, চেলেস্তন, দিয়াহ দানা, ওয়াসিলাবাদ, কামবের চক, কোম্পানি এবং আরও কিছু এলাকা মাদক বিক্রির গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত।

    সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, মাদকাসক্তদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানী কাবুল ও আরও কিছু প্রদেশ থেকে তাঁরা এখন পর্যন্ত ৫ হাজারের বেশি মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। মাদক ব্যবসায়ীদের এই নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলেও জানান কর্তৃপক্ষ।

    [মাদক উপকরণ-সহ আটক একটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র।]

    মুহাম্মাদ দাউদ একজন মাদকাসক্ত। এখন তিনি একটি সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তিনি পূর্ববর্তী সরকারের (আশরাফ গনি সরকার) সমালোচনা করে বলেছেন, তারা মাদককে সহজলভ্য করেছিল। এই শাসকরা আগে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে কোটি কোটি রুপি দুর্নীতি করেছে। কিন্তু মাদক সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই কারণেই দেশজুড়ে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের জীবনকে মাদক দিয়ে ধ্বংস করেছে।

    মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যাপারে বর্তমান ইসলামি ইমারত সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে আনন্দ প্রকাশ করেছেন তিনি। তার মতে, মাদকাসক্তদের উদ্ধার কার্যক্রম একটি ভালো উদ্যোগ, তবে মাদককে সমূলে উৎপাটন না করতে পারলে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। মাদকাসক্তরা কোনো একবার মুক্ত হতে পারলে পুনরায় মাদক নিতে শুরু করবে। তাই মাদক ব্যবসায়ীদের উৎখাত করা গুরুত্বপূর্ণ।

    অতীতে (মার্কিন তাবেদার সরকারের আমলে) মানুষের হৃদয়ে একটি প্রশ্ন জাগ্রত হতো- মাদকবিক্রেতাদের ঘাঁটিগুলো সম্পর্কে তো সরকারের জানা আছে, তবুও কেন সরকার মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি?
    এখন আর এই ধরনের প্রশ্ন জাগ্রত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ ইসলামি ইমারত সরকার আফগানিস্তানকে মাদকের স্বর্গরাজ্য থেকে মাদকমুক্ত ইসলামি সাম্রাজ্যে পরিণত করার মিশন নিয়ে নেমেছেন।

    কাবুলের সায়েদ নূর মুহাম্মাদ শাহ মিনাহ এলাকা থেকে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আসা এক মাদকাসক্ত বলেছেন, আগে বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা মাদক বিক্রি করতো। অনেক এলাকায় যুবকরা রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করছিল। কিন্তু যখনই সরকার মাদকের উপর ক্র্যাকডাউন চালাতে শুরু করলেন, শহরে মাদক বিক্রির হার কমে গেছে এবং মাদক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।

    হাজার বেদিদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক মাদকাসক্ত জানিয়েছেন, মাদকাসক্তদের উদ্ধার কার্যক্রম এবং মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পর থেকে মাদক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে।
    তার মতে, দশ দিন আগে বাহিরে থাকাকালীন তিনি ভাবতেন, যদি ইসলামি ইমারত এভাবে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউন চালাতে থাকে, তবে এক বা দুই মাসের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা শূন্যে নেমে যেতে পারে। কারণ এখন মাদক ব্যবসায়ীরা গোপনে মাদকাসক্তদের খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু মাদক নেওয়ার মতো কাউকে পায় না। তিনি বলেন, এখন মাদক ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই একে অপরের ব্যাপারে ভয়ে থাকেন, না-জানি কখন আবার সরকার তাদের গ্রেফতার করে।

    তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি কারতা নো পাহাড়ী, কামবের চক, মুহাজির ক্যাম্প, দাশত বারচি এবং কিলা নো পুলে মাদক বেঁচা-কেনা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। একইভাবে কেউ এখন ওয়াসিলাবাদে যায় না, কারণ সেখানে গেলেই গ্রেফতার করা হয়। অতীতে এসব এলাকায় প্রকাশ্যে মদ বিক্রি করা হতো। আর এখন আমরা গাড়িতে করে কাবুলের এক কোণা থেকে অন্য কোণায় গেলেও মাদকের খোঁজ মেলেনা।’

    মায়ভিন্দ হুশমান্দ একজন মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজ বিষয়ক পরামর্শক; কাজ করেন এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট মাদক নিরাময় হাসপাতালে। চিকিৎসাকালীন তিনি হাজার হাজার মাদকাসক্তদের সাথে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এলাকাভেদে মাদক বিক্রির উপায়গুলো বেশ অদ্ভুত। সারাই নর্থ এলাকায় বৃদ্ধ ও যুবক শ্রেণির একদল লোক মাদক উপকরণ বিতরণ করতো, কোম্পানি ও কামবের চক এলাকায় আরও কিছু লোক এই কাজে জড়িত ছিল। কুরতা নো তাপাতে এই কাজে ব্যবহৃত হতো শিশুরা। আর মাদক বিক্রির অপরাধের সকল ক্ষেত্রে সহযোগী হিসেবে থাকতো তরুণ ছেলে-মেয়েরা।

    স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মতে, কিছু এলাকায় বাবা, ছেলে, কন্যা এবং স্ত্রী-সহ পরিবারের সকল সদস্য মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। অনেক এলাকায় মাদক বিক্রি একটি পারিবারিক ব্যবসায় পরিণত হয়েছিল।

    উদ্ধার করা মাদকাসক্তদের অর্ধেকের বেশি আবার নিজেরাও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল, তাদেরকে এখন অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, চিকিৎসার পরে এই লোকদেরকে আদালতের মুখোমুখি করা হবে। সেখানে তারা তাদের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি পাবে।

    স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, তারা প্রথমে মাদকাসক্তদের উদ্ধার অপারেশন শুরু করেছিলেন। এরপর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মাদকবিক্রেতাদের সম্পর্কে তথ্য নেওয়া হয়। মাদকাসক্তদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করেন। এখন পর্যন্ত দেশজুড়ে অন্তত ৫ হাজার মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে কাবুল থেকেই গ্রেফতার করা হয়েছে ৪ হাজার জনকে। মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এই অভিযান এখনও চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

    ইসলামি ইমারত ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত আফগানিস্তান ছিল মাদকের স্বর্গরাজ্য। পৃথিবীর বেশিরভাগ মাদকের যোগান দিতো আফগানিস্তান। তৎকালীন আমেরিকার মদদপুষ্ট শাসকগোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় আফগানিস্তান মাদক ব্যবসায়ীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। ইসলামি ইমারত ক্ষমতায় আরোহণের পর পরই মাদকের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানিয়ে আসছিলেন। সম্প্রতি তাঁরা মাদকের মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এর আগে নব্বইয়ের দশকে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পরও আফগানিস্তানকে মাদকমুক্ত করেছিলেন ইসলামি ইমারত কর্তৃপক্ষ।



    তথ্যসূত্র:
    ১. ملک بھر میں منشیات فروشوں کے خلاف کارروائیاں جاری ہیں
     https://tinyurl.com/e523bmhh

    মন্তব্য করুন

    দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
    দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

    পূর্ববর্তী নিবন্ধর‍্যাবের সাদা পোশাকে অভিযান: পরিচয় জানতে চাওয়ায় গুলি করে খুন
    পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিন ও ফিলিস্তিনি জনগণ বলতে কিছু নেই: ইসরাইলি মন্ত্রী