চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিবহনের স্থায়ী অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ২৪ এপ্রিল একটি আদেশ জারি করেছে। এতে ট্রানজিট ব্যবস্থা কীভাবে কার্যকর বা বাস্তবায়ন করা হবে তার নির্দেশনা রয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের কাছে ভারতের আবদার-অভিলাষের লম্বা তালিকার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তিটি তারা পেয়ে গেল।
২০১৮ সালে “অ্যাগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফ্রম ইন্ডিয়া” নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে। এই চুক্তির আওতায় গত প্রায় তিন বছর যাবৎ পরীক্ষামূলক ভাবে (ট্রায়াল রান) চট্টগ্রাম ও মোংলা উভয় বন্দর দিয়ে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহন করা হচ্ছিল। গত ২৪শে এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই ট্রানজিট কার্যক্রম এখন থেকে পুরোদমে বাস্তবায়নের নির্দেশনা দিয়েছে।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ১৬টি রুটে ভারতীয় পণ্য যাবে ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যে। আগে শিলিগুড়ি করিডোর হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার জন্য ১ হাজার ৬৫০ কি.মি. দূরত্ব অতিক্রম করতে হতো। কিন্তু বাংলাদেশ ট্রানজিট সুবিধা দেওয়ায় এখন সেই দূরত্ব অনেক কমবে। এর ফলে প্রচুর সময় ও খরচ বাঁচবে ভারতের।
কিন্তু বাংলাদেশের লাভ কী?
বাংলাদেশের লাভ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে কেবল ন্যুনতম কিছু টাকা মাশুল আদায়। এনবিআরের স্থায়ী আদেশে ভারতের ট্রানজিট পণ্য পরিবহন বাবদ মাশুল নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এতে প্রতি চালানের প্রক্রিয়াকরণ মাশুল বা প্রসেসিং ফি ৩০ টাকা, টনপ্রতি ট্রান্সশিপমেন্ট ফি ২০ টাকা, নিরাপত্তা ফি একশ টাকা, কন্টেইনার স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা এবং অন্যান্য প্রশাসনিক ফি একশ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আদেশে প্রতিটি কন্টেইনার বা গাড়ির জন্য প্রতি কিলোমিটারে এসকর্ট (পাহারা) ফি ৮৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিট সুবিধার ক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ডের ন্যূনতম ফি ধার্য করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটারের জন্য টন প্রতি ৫৮৯ টাকা।
কিন্তু ট্রানজিট-বিষয়ক কোর কমিটির পক্ষ থেকে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সে তুলনায়ও এই ট্রানজিট মাশুল অনেক কম। ভারতকে এত বিশাল সুবিধা দিয়ে, বাংলাদেশ পণ্য পরিবহন করে কিছু টাকা বাড়তি আয়ের সুযোগ পেতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কেমন যেন ভারতের পণ্য বহনের জন্য কুলি হিসেবে কাজ করছে। তাই এটাকে কেউ কেউ বলছেন, ট্রানজিটের নামে কুলিগিরি।
এই ট্রানজিট-করিডোর থেকে বাংলাদেশ নামমাত্র যতটা লাভ পাবে, তার চেয়ে বহুগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দেশ ও দেশের মানুষ। ক্ষতিকর কিছু দিক হলো:
এক. দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে চট্টগ্রাম বন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গেটওয়ে। বাণিজ্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে আসছেন দেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা। বন্দরের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা, জাহাজ ও কন্টেইনার জট কমিয়ে আনতে নতুন নতুন টার্মিনাল নির্মাণ, বে-টার্মিনাল এবং ক্রেন সুবিধা বৃদ্ধির দাবী দীর্ঘদিনের। এ লক্ষ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সরকারের পক্ষ থেকে মতবিনিময় ও কমিশন গঠন করা হলেও বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অপেক্ষাও করা হয়নি। এ কারণে বন্দরে জাহাজের জট স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পেতে পারে। এছাড়া, বন্দরে কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয় জাহাজগুলো বিশেষ সুবিধা পাবে বলেও জানানো হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে সরাসরি দেশের অর্থনীতির উপর।
দুই. ভারত বাংলাদেশের রেল-সড়ক পথ ব্যবহার করে নিজেদের পণ্য তাদেরই এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিবহন করবে। অর্থাৎ, ভারত একমুখী ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করবে। এই ট্রানজিট-করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশী পণ্য ভারতে রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়নি। এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না।
তিন. ভূ-প্রাকৃতিকভাবে ভাটির দেশ বাংলাদেশের ভূমি প্রধানত বালুমাটির। নরম মাটির ওপর তৈরি দেশের রাস্তাঘাট, মহাসড়ক। এ অবস্থায় ট্রানজিটের ভারী ট্রাক-লরি, কাভার্ড ভ্যানের বহরের বাড়তি চাপে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সার্বিকভাবে দেশের সীমিত যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হবে।
চার. ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ভারত বরাবরই বাংলাদেশের উপর প্রভুসুলভ আচরণ করে আসছে। অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ দখল করে রামরাজত্ব কায়েমের দর্শনও রয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারতের। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময় ভারতীয় নেতাদের অনেকেই বাংলাদেশ দখলের প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছে। এমন একটি দেশকে এভাবে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে দেওয়া বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ।
এত সমস্যা, সংশয়, ও আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও ভারত চাহিবামাত্র বাংলাদেশ তাকে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা দিয়ে দিলো। অন্যদিকে, ভারতের কাছে বাংলাদেশের বহুদিনের চাওয়া ভুটান, নেপালে বাণিজ্যের জন্য ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করার সুবিধা এখন পর্যন্ত পায়নি বাংলাদেশ। তিস্তার পানিও পায়নি বাংলাদেশ, এর ফলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি পড়েছে হুমকির মুখে। কিন্তু ‘মানবিক কারণে’ ফেনী নদীর পানি ঠিকই ভারতকে দিয়েছে সরকার। ভারত আমাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য আটকে দিলেও, বাংলাদেশ সরকার ভারতে পাঠিয়েছে টনকে টন ইলিশ।
বাংলাদেশের সরকার প্রধান নিজেই বলেছে, ভারতকে সে যা দিয়েছে তা আজীবন মনে রাখতে হবে। হ্যাঁ, ভারত মনে রেখেছে। ভারতের প্রায় সব আবদারই রেখেছে বাংলাদেশ, কিন্তু বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে- ভারত থেকে মুসলিমদের তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর হুমকি, প্রতিনিয়ত সীমান্তে ঝরছে ফেলানিদের লাশ, অসময়ে তিস্তার পানি ছেড়ে দেওয়ায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে, আর প্রয়োজনের সময় তিস্তার পানি আটকে রাখায় ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চল হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি।
সর্বশেষ ভারতকে একতরফা ট্রানজিট-করিডোরের সুবিধা প্রদান করে কার্যত বাংলাদেশকে যেন ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যেই পরিণত করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র:
১. পুরোদমে খুলে গেল ট্রানজিট
– https://tinyurl.com/5n8fv6fa
২. বাণিজ্যিক ট্রানজিটে কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না
– https://tinyurl.com/4s6ju4aa
৩. ভারতে নিয়মিত ট্রানজিট সুবিধা পাচ্ছে না কেন বাংলাদেশ
– https://tinyurl.com/2azajpfv
৪. নেপালকে রেল ট্রানজিট: ভারত অনুমোদন দেবে? কী লাভ হবে বাংলাদেশের?
– https://tinyurl.com/335cyeuf
৫. ভারতের ট্রানজিট চায় বাংলাদেশ
– https://tinyurl.com/mrxc5kef
৬. ট্রানজিটের নামে কুলিগিরি
– https://tinyurl.com/5n7s3vte
৭. ভারতকে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে অনুমোদন প্রসঙ্গে
– https://tinyurl.com/yz95s6uf
৮. ভারতীয় পণ্য ট্রানজিটে টন প্রতি ৫৮৯ টাকা ফি
– https://tinyurl.com/mupvf2w6