ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার জন্য ২০ জুন আসামের বিধানসভা এবং সংসদীয় আসনগুলির সীমাবদ্ধতার বিজ্ঞপ্তি দেয়। নতুন প্রস্তাবে আসন সংখ্যা আগের মতোই রাখা হয়েছে। ১৪টি লোকসভা আসন এবং ১২৬টি বিধানসভা কেন্দ্র। কিন্তু মুসলিম ভোটারদের অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় আসনের সংখ্যা কমানো হয়েছে।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ আইন ২০০২ বিধি অনুসরণ করে, ইসিআই ২০০১ সালের আদমশুমারিকে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য বিবেচনা করে। এর মাধ্যমে মুসলিম-অধ্যুষিত জেলাগুলোর আসন কমিয়ে দেওয়া হয়। আসামের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া তৈরিতে ২০০১ সালের আদমশুমারিকে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য সীমানা পুনর্নির্ধারণ কমিশন ২০১১ সালের আদমশুমারি ব্যবহার করেছিল। সেখানে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের ৮৩টি বিধানসভা কেন্দ্রকে ৯০ টি আসনে উন্নিত করা হয়েছিল।
আদমশুমারির তথ্য ব্যবহারে এই ভিন্নতা আসামের মুসলিমদের মধ্যে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এবিষয়ে অখিল গগৈ নেতৃত্বাধীন রাজোর দলের সাধারণ সম্পাদক এবং অল আসাম মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AAMSU) এর প্রাক্তন সভাপতি আজিজুর রহমান বলেছেন, “মনে হচ্ছে পুরো কার্যক্রমটি আসামের মুখ্যমন্ত্রী এবং ইসিআই দ্বারা প্রস্তাবিত। এটি পুরোনো জনশুমারি ব্যবহার করে এবং বিদ্যমান সীমানা (নির্বাচনের) পরিবর্তন করে মুসলমানদেরকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র।”
খসড়া সীমানা প্রস্তাবে জেলার জনসংখ্যার গড় সমন্বয় করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলিতে আসন সংখ্যা হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসিআই তার প্রেস বিবৃতিতে বলেছে যে, ১১ টি রাজনৈতিক দল এবং ৭২ টি সংস্থার সাথে আলোচনার পরে সংস্থাটি পর্যবেক্ষণ করেছে যে কিছু জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি অস্বাভাবিকভাবে বেশি ছিল। এখানে স্পষ্টতই মুসলিম-অধ্যুষিত জেলাগুলির ব্যাপারে বলা হয়েছে।
AAMSU উপদেষ্টা আইনুদ্দিন আহমেদ বলেন, “এটি ইতিমধ্যে বিদ্যমান আসনগুলিকে এমনভাবে বিভক্ত করেছে যে, মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আসন সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।”
জনাব আহমেদ আরও বলেন, “যদিও ইসিআই ২০০১ সালের আদমশুমারি ব্যবহার করেছে, তবুও মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আসন বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল; ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাব সরিয়ে রাখলেও। তবে আগে যেখানে ৩৫টি আসনে মুসলিম ভোটারদের প্রভাব বেশি ছিল, নতুন খসড়ায় সেটা কমিয়ে প্রায় ৩০-এ নামিয়ে আনা হয়েছে।”
আসামের মুসলিম জনসংখ্যা ২০০১ সালে ৩০.৯ শতাংশ ছিল। যা ২০১১ সালে ৩৪.২২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়৷ তবে, যেহেতু জাতীয়তার ভিত্তিতে জনসংখ্যার কোনও বিভাজন নেই, নির্বাচনী রাজনীতিতে তাই বাঙালি মুসলমানদের সঠিক সংখ্যা স্পষ্ট নয়৷ কিন্তু স্থানীয় বিভিন্ন অনুমান অনুসারে, বাঙালী মুসলিম সম্প্রদায় মুসলিম জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ। আর এদের বেশিরভাগই আসামের পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চলে এবং লখিমপুরের উত্তর জেলায় বসতি স্থাপন করে।
১৮১৬ সাল থেকে বাঙালি মুসলমানদেরকে ব্রিটিশদের পাশাপাশি স্থানীয় রাজারা চাষাবাদের জন্য আসামে নিয়ে আসে এবং তারা অসমিয়া জনসংখ্যার অংশ ছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ৩১ জন মুসলিম বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছেন। “কিন্তু এখন যদি খসড়াটি বাস্তবায়িত হয় তাহলে হাউসে মুসলিম বিধায়কদের সংখ্যা কমে যাবে। কারণ কিছু নির্বাচনী এলাকা বাতিল করা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে মুসলিম সিদ্ধান্তের কারণগুলি কাটা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু আসন সংরক্ষিত করা হয়েছে।
যেমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বারপেটাতে বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৮টি থেকে ৬টিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। এই ছয়টির মধ্যে একটি আবার তফসিলি জাতি (এসসি) সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রস্তাবিত সংরক্ষিত আসনটি হল বারপেটা আসন, যেখানকার বর্তমান
বিধায়ক একজন মুসলিম।
খসড়া সীমানা প্রস্তাবে বাঙ্গালী-অধ্যুষিত বরাক উপত্যকা জেলা কাছাড়, হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জের বিধানসভা আসনসংখ্যা ১৫ থেকে ১৩ তে কমিয়ে আনা হয়েছে। হাইলাকান্দি এবং করিমগঞ্জের প্রতিটি মুসলিম-প্রধান জেলায় একটি করে আসন রয়েছে।
এছাড়াও খসড়াটিতে এসসি এবং এসটি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পূর্বে এসসিদের জন্য সংরক্ষিত আসনসংখ্যা নয়টি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর এসটিদের জন্য নির্ধারিত আসন ১৬ থেকে বাড়িয়ে ১৯ করা হয়েছে। বারপেটা আসনের মতো গোয়ালপাড়া পশ্চিম আসনটিও এসটিদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অথচ গোয়ালপাড়া পশ্চিম আসনটিতে ১৯৬৭ সালের পর থেকে মুসলিম প্রার্থীরাই নির্বাচিত হয়ে আসছে। সংরক্ষিত আসনএর প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে কোন মুসলিম প্রার্থী এই আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না।
যদিও মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় বিধানসভা আসনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তবে চারটি আসন সম্বলিত কার্বি অ্যাংলং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল পাঁচটি আসন করা হবে। আর নতুন খসড়ার অধীনে বিটিআর-এর আসনসংখ্যা ১২ থেকে বাড়িয়ে ১৫ করা হয়েছে।
মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ছাত্র সংগঠন অল বিটিসি মাইনরিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক তাইসন আহমেদ বলেন, “আসামের রাজনীতিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব চিরতরে মুছে ফেলার জন্য এসব করা হচ্ছে। সংখ্যালঘু সংস্থাগুলির বিরোধিতা সত্ত্বেও নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্গঠনের এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী। এটি আরএসএস এবং বিজেপির ইচ্ছা অনুযায়ী করা হয়েছে।”
যদিও গণতন্ত্রে সকলের সমানাধিকারের কথা বলা হয়ে থাকে, তবে মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতে এই পদ্ধতির অসারতা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। কেননা এই শাসনব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠের দোহাই দিয়ে বিরোধী মতকে দমন করা একটি সহজাত ব্যপার। আর ঠিক এই কাজটি হিন্দুত্ববাদী ভারত সরকার সফলভাবে আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে ভারতের মুসলিমদের দমনে। অপরদিকে দেখা যাচ্ছে, আফগানিস্তানের ইসলামি ব্যবস্থা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের আর্থ-সামাজিক অধিকার নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে, যা পশ্চিমা বিভিন্ন পরিসংখ্যান দ্বারাই প্রমাণিত।
তথ্যসূত্র:
1. Draft delimitation to erase the Muslim representation in Assam politics
– https://tinyurl.com/3r8m5ztu