দারসে রমাদান।। দারস-৮।। গীবত।।

0
171

প্রিয় ভাইয়েরা, আজ এমন এক ব্যাধি নিয়ে আলোচনা করব যা নেককার, সংস্কারক, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছোট-বড় সকলকে শেষ করে দিচ্ছে। এই রোগটি সব জায়গায় মানুষের সাথে থাকছে। এমনকি বাইতুল্লাহ বা মসজিদেও তা মানুষের সঙ্গী হচ্ছে। কেউ ইসলামের রোকন ফরজ হজ্জ পালন করছে, ফরজ রোযা রাখছে; তখনও এই রোগে আক্রান্ত থাকছে। এই রোগ মুসলিমদের মাঝে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। তবে আল্লাহ যাকে রক্ষা করেন, কেবল সেই রক্ষা পাচ্ছে।

ব্যাধিটি হলো গীবত। গীবত কাকে বলে? ইমাম মুসলিম তাঁর সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগণকে জিজ্ঞাসা করেছেন,
“أتدرون ما الغيبة؟”
তোমরা কি জানো গীবত কাকে বলে?
তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। এবার তিনি গীবতের ব্যাখ্যা করলেন:
“الغيبة ذِكْرُك أخاك بما يَكْرَهُ ”
“গীবত হলো, তোমার ভাইয়ের এমন বিষয় আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে”।
তারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যেটি আলোচনা করেছি সেটি যদি বাস্তবেই তার মাঝে থাকে? যে গুণটি আলোচনা করেছি, বাস্তবে যদি সে গুণটি তার মাঝে বিদ্যমান থাকে? তিনি বললেন,
” فَقَدِ اغْتَبْتَهُ، وإنْ لَمْ يَكُنْ فيه فقَدْ بَهَتَّهُ. ”
“তাহলেই তুমি গীবত করেছ; আর যদি সেটি তার মাঝে না-ই থাকে, তাহলে তো তার ওপর অপবাদ দিয়েছ”।

অধিকাংশ মানুষ গীবতকে হালকা মনে করে। মনে করে গীবত সাধারণ বিষয়। জোহর বা আসরে নামায পড়েছি কিংবা ওযু করেছি তো গীবত মাফ হয়ে গেছে। না; প্রিয় ভাই, না। আপনি কি জানেন, গীবত কবীরা গুনাহ; এটি সগীরা গুনাহ নয়? উলামাগণ বলেছেন, কবীরা গুনাহ নামায-রোযার দ্বারা মাফ হয় না। এর জন্য আল্লাহর কাছে তাওবা করা আবশ্যক। তাওবা-ইস্তেগফার করবে, অনুতপ্ত হবে, তা পুনরায় না করার প্রতিজ্ঞা করবে; তাহলে কবীরা গুনাহ মাফ হবে।

“তোমার ভাইয়ের এমন বিষয় আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে”। এখন সচরাচর সংঘটিত হয় এমন কিছু গীবতের উপমা পেশ করব। কেননা, বর্তমানে মানুষ গীবতকে খুবই হালকা মনে করে। কেউ বলতে পারে, এগুলো গীবত নয়। যেমন, অমুক লোক কৃপণ। এটা গীবত। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গীবতের মূলনীতি উল্লেখ করেছেন,
“ذكرك أخاك بما يكره”
“তোমার ভাইয়ের এমন বিষয় আলোচনা করা যা সে অপছন্দ করে”।
লক্ষ করুন! এমন সকল কথা যা আপনার ভাইয়ের কাছে পৌঁছলে অপছন্দ করবে, বিরক্তিবোধ বা কষ্ট অনুভব করবে— এমন সকল কথা গীবত।
অমুক কৃপণ, অমুক ভীরু, অমুকের ঘুম বেশি, অমুক খাদক, অমুক রাগী, অমুকে সন্তানদের আদব শিক্ষা দেয়নি, স্ত্রীকে আদব শিক্ষা দেয়নি— এসব কথা গীবত। …
কেউ তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, অমুকের কোনো কৃতিত্ব নেই। এটাও গীবত।

কোনো আলেম চমৎকার কথা বলেছেন যে, কেউ কেউ দোয়ার ছলেও গীবত করে। যেমন, কারো ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বলে, অমুকের কথা কী বলব, আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও ক্ষমা চাইছি। এটাও গীবত। এটা কীভাবে গীবত? এমন কথার দ্বারা মানুষ বুঝবে যে, অমুকের উপর কোনো আপত্তি আছে। অন্যের খবর জিজ্ঞাসা করলে কেউ এভাবে বলে, ভাই! আমাকে ছাড়ুন, আমি তার গীবত করতে পছন্দ করি না। উলামায়ে কেরাম বলেন, এটাও গীবত। আমি তার গীবত করতে পছন্দ করি না, আমি কারও গীবত করতে চাই না, আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা চাই। কারও ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে এভাবে জবাব দেওয়াকেও উলামায়ে কেরাম গীবত বলেছেন।

আমরা গীবতের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করব। এমনকি যেখানে গীবতের সম্ভাবনা আছে, আল্লাহর শপথ! একশ ভাগের একভাগ সম্ভাবনা থাকলেও তা পরিহার করব। এটা গীবত কি না— এমন সন্দেহজনক কথাও বর্জন করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেননি? যে,
” دَعْ مَا يَرِيبُكَ إِلَى مَا لَا يَرِيبُكَ ”
“সন্দেহজনক বিষয় ছেড়ে সন্দেহজনক নয় এমন বিষয় গ্রহণ কর”।

কিছু কিছু আলেমের লেখায় পড়েছি; যদি বলেন, অমুক মিসকীন। এটাও গীবত। কেননা, কেউ চায় না যে তাকে মিসকীন বলে ডাকা হোক। অমুক সাদাসিধে দরবেশ। প্রিয় ভাই! গীবত থেকে বাঁচতে হলে এধরণের সকল কথা আমাদের বর্জন করতে হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মেরাজে আকাশের উপরে উঠেন তখন একদল লোক দেখতে পান।
কিছুলোক জিজ্ঞাসা করেন গীবতকারীর শাস্তি কী? আমরা বলি, গীবত কবীরা গুনাহ। যাহোক; বর্ণনাকারী বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখেন, এক শ্রেণির লোক পিতলের নখবিশিষ্ট। তারা নখ দিয়ে চেহারায়, বুকে আঁচড় কাটছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত জিবরীল আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা কারা? তাদের অপরাধ কী? তারা কী করেছে? জিবরীল আলাইহিস সালাম বলেন, এরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত, তারা মানুষের দোষচর্চা করত। এই হচ্ছে গীবতকারীর শাস্তি। তাদের পিতলের নখ থাকবে। তা দিয়ে চেহারায় বুকে আঁচড় কাটবে। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ!

লক্ষ করুন! আল্লাহ তায়ালা গীবতকারীর কেমন নিকৃষ্ট উপমা দিয়েছেন:
أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتاً فَكَرِهْتُمُوهُ
অর্থ: তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? বস্তুত, তোমরা তা অপছন্দ করবে।
চিন্তা করুন! আপনার মৃত ভাইয়ের লাশ আপনার সামনে আর আপনি তার গোশত খাবলে খাচ্ছেন। কেমন কুৎসিত ও বীভৎস সে দৃশ্য! ঠিক গীবতকারী যেন তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাচ্ছে। – আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও ক্ষমা চাইছি।

আমাদেরকে গীবতের মজলিস থেকে সতর্ক থাকতে হবে। কিছু মানুষের গীবতকারীকে বাধাদানের সামর্থ্য নেই। এটা এক ধরনের সমস্যা। আরেক সমস্যা হলো, মজলিসে থাকলে গীবত শুনতে হবে। তবে মজলিসের সঙ্গীদের সাথে ভালো আচরণ করব। তাদেরকে আমাদের ওপর রাগান্বিত করব না। দেখবেন কেউ একবার চুপ করে আবার কথা শুরু করে, এভাবে দুই-তিনবার চলতেই থাকে। এভাবে সে গীবতের স্বাদ উপভোগ করতে থাকে। অবশেষে গীবতের ব্যাধি তার মাঝে শেকড় গাড়ে। গীবত তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে ওঠে। গীবত শোনা তার কাছে কোনো সমস্যাই মনে হয় না।

তাই, প্রিয় ভাই! আমরা গীবতের মজলিস থেকেও সাবধান থাকব। নারীদের মজলিস দেখলে আপনি গীবতের মজলিস চিনতে পারবেন। আমি বোনদের সাবধান করছি, কেননা গীবত নারীদের মাঝে পুরুষের চেয়ে প্রবল আকার ধারণ করেছে। আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা ও ক্ষমা চাইছি। অমুক নারীকে তালাক দেওয়া হয়েছে, অমুক নারীকে এই করা হয়েছে, সেই করা হয়েছে… সর্বক্ষণ তারা নারী-পুরুষের খবরাখবর নিয়েই পরস্পর কথা বলে। ফলে তারাই সবচে বেশি গীবতে লিপ্ত হয়।

আমাদের এই ভয়ানক ও ধ্বংসাত্মক ব্যাধি থেকে পরিপূর্ণ সচেতন থাকতে হবে যা মানুষের নেক আমল গ্রাস করে ফেলে। যদি আপনি তাওবা না করেন তাহলে যার গীবত করেছেন কেয়ামতের দিন সে আপনার নেক আমল নিয়ে যাবে। ইমাম ইবনে কাইয়ুম রহিমাহুল্লাহ চমৎকার বলেছেন। তাঁর “الداء والدواء” নামক কিতাবে তিনি বলেন, একলোক যুহদ, ইবাদত ও দ্বীনদারিতে পাকা। পাশাপাশি অনেক হারাম ও অশ্লীল কাজ যেমন, যিনা, চুরি, হারাম খাওয়া থেকে বিরত থাকে। কিন্তু গীবত থেকে বিরত থাকে না। সে যবান নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। জীবিত-মৃত মুসলিমদের দোষচর্চায় লিপ্ত হয়। মাআযাল্লাহ। এই আবেদ, যাহেদ লোকটি অনেক কবীরা গুনাহ বর্জন করা সত্ত্বেও গীবতের কবীরা গুনাহ ছাড়তে পারেনি। মোটকথা, গীবত তার মাঝে শেকড় গেড়েছে। তার দেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। যেকোনো মজলিসেই সে মানুষের মন্দচর্চা করে। এটা গীবতের ব্যাধি। মানুষ অন্যের মন্দচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। মুসলমানদের গোপন গুনাহ প্রকাশ করে দেয়। এটা মারাত্মক ব্যাধি; মুজাহাদার মাধ্যমে তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। এর জন্য মুজাহাদা আবশ্যক। জরুরত, কল্যাণ ব্যতীত কখনও মানুষের ব্যাপারে কথা বলব না। আমরা জরুরত, কল্যাণের দোহাই দিয়ে আবার গীবতকে ব্যাপক করে ফেলব না।

জরুরত, কল্যাণের কিছু নমুনা দেখুন। যেমন, ফাসেক, জালেম থেকে সচেতন করা। এক ব্যক্তি কোনো নারীকে বিবাহ করবে। তাই তার ব্যাপারে জানতে চাইলে তার সঠিক বর্ণনা দেওয়া। সে এখন আপনার বোন বা মেয়েকে বিবাহ করতে চাচ্ছে, তার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে বলা যে, তাকে এমন এমন জানি। এমন প্রশ্নের জবাবে জরুরত ও কল্যাণের স্বার্থে বলা যাবে। জরুরত, কল্যাণ না থাকলে মানুষের মন্দচর্চা জায়েয নেই।

আল্লাহ তাআলা আমাদের জবানকে গীবত থেকে হেফাজত করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমীন।


মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসরায়েলি আগ্রাসনের ১৬৬ তম দিনে গাজায় কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিক নিহত
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনের জিহাদ || আপডেট – ২১ মার্চ, ২০২৪