প্রিয় ভাই! আজকের মজলিসে আমরা শহীদের ফজীলত সম্পর্কে আলোচনা করব। শহীদের অনেক অনেক ফজীলত রয়েছে। শহীদ মৃত্যুবরণ করে না; বরং কবরেও আল্লাহর থেকে রিযক, নেয়ামত, স্বাদ-ভোগ ইত্যাদি লাভ করতে থাকে।
আপনি বলবেন, এটা কীভাবে সম্ভব? আমি বলব, এটা আখেরাতের বিষয়। একটি মূলনীতি জেনে নিন, আখেরাতের বিষয়ে কখনও বলবেন না— “এটা কীভাবে সম্ভব?” কেননা, আমাদের আকল সীমাবদ্ধ। আমাদের বিবেক আখেরাতের হাকীকত ও বাস্তবতা বুঝতে অক্ষম। তবে আমরাও যখন আখেরাতের জগতে প্রবেশ করব তখন আল্লাহর ইচ্ছায় আখেরাতের বাস্তবতা বুঝতে পারব।
আল্লাহর নিকট শহীদের ফজীলত কী, সেই বর্ণনা অনেক হাদীসে পরিস্কারভাবে ফুটে উঠেছে। এজন্য সার্বিকভাবে সাহাবাদের মাঝে যেই গুণটি বিদ্যমান ছিল তা হচ্ছে, আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতলাভের আকাঙ্ক্ষা ও ভালোবাসা। চাই তিনি আলেম হোন বা গাইরে আলেম, ধনী বা গরীব।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “মৃত্যুর পর একমাত্র শহীদ ব্যতীত কেউ পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসতে চাইবে না”। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২৮১৭) হাদিসটি সহীহহাইনে এসেছে। একজন শহীদ কতবার দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করবে? দুইবার? তিনবার? না; বরং দশবার! একজন শহীদ মৃত্যুর পর দশবার দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে। কেননা, সে শাহাদাতের সম্মান ও মর্যাদা স্বচক্ষে দেখেছে।
লক্ষ করুন! আলেম, ফকীহ, মুহাদ্দিস, খতীব, দাঈ, আবেদ কেউ-ই মৃত্যুর পর পুনরায় দুনিয়াতে ফিরে আসতে চাইবে না। একমাত্র শহীদ-ই পুনরায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে শাহাদাতের সম্মান ও মর্যাদা। সুবহানাল্লাহ! দুনিয়ার কলম এই সম্মানের বর্ণনা লিখতে ব্যর্থ! মানুষের আকল এর বাস্তব চিত্র অঙ্কন করতে অক্ষম! শাহাদাতের সম্মান ও মর্যাদা আশ্চর্যজনক। অনেক, অনেক, অনেক বেশি আশ্চর্যজনক এই সম্মান!
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর কাছে শহীদের ছয়টি পুরস্কার রয়েছে”, অপর এক বর্ণনায় সাতটির কথা এসেছে। এরমধ্যে প্রতিটি পুরস্কার-ই মহান। এই পুরস্কারগুলো শহীদদের জন্যই নির্ধারিত। অন্য কেউ তাঁদের এই পুরস্কারের অংশীদার হতে পারবে না। প্রথম পুরস্কার হচ্ছে, “শহীদের রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ামাত্র-ই তাঁর গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। আল্লাহু আকবার! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্য হাদীসে বলেছেন: “শহীদের সকল গুনাহ মাফ করা হবে”। এখানে “كل” (সকল) শব্দ এসেছে। শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। অর্থাৎ, শহীদের ছগীরা-কবীরা সকল গুনাহ মাফ করা হবে শুধু “ঋণ ব্যতীত”। যদি শহীদের কাঁধে ঋণের বোঝা থাকে, তাহলে পাওনাদার মাফ করা বা আল্লাহর পক্ষ থেকে মাফ করানোর ব্যবস্থা করার আগ পর্যন্ত তা তার কাঁধে লটকে থাকবে। শহীদের রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ামাত্র তাঁর সকল গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। সুতরাং, কেয়ামতের দিন তাঁর কোনও হিসাব হবে না। সে বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাঁর কোনও গুনাহ থাকবে না। আল্লাহর কাছে শাহাদাতের মহান মর্যাদা লাভের প্রার্থনা করছি।
দ্বিতীয় পুরস্কার, “শহীদের সাথে বাহাত্তরজন হুরের সাথে তাঁর বিবাহ হবে”। তৃতীয় পুরস্কার, “সত্তরজন নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করা হবে”। আল্লাহু আকবার! কেয়ামতের দিন ঠিকই শহীদের আত্মীয়-স্বজনের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। চতুর্থ পুরস্কার, “তাঁকে ইয়াকুত পাথরের সম্মানজনক মুকুট পরানো হবে, যার এক একটি পাথর দুনিয়া ও এর মাঝে বিদ্যমান সকল বস্তু থেকেও শ্রেষ্ঠ। পঞ্চম পুরস্কার, “কেয়ামতের দিন বা হাশরের দিন ‘প্রচণ্ড ভয়-ভীতি’ থেকে নিরাপদ থাকবে”। ষষ্ঠ পুরস্কার, “কবরের আযাব থেকে মুক্তি লাভ করবে”। (তিরমিজি, হাদিস নং-১৬৬৩)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “মুজাহিদের উপর তরবারির ঝলক তাঁকে সকল ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট”। জিহাদের ময়দানে যদি মুজাহিদ সবরের সাথে অটল থাকে তাহলে সকল ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য এটিই তাঁর জন্য বড় সহায়ক। শহীদদের এই মহান, বিশাল ও গৌরবময় ফজীলতগুলো নিয়ে চিন্তা করুন! তবুও কি মানুষ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার রাহে জীবনোত্সর্গ করে শহীদ হতে আগ্রহী হবে না?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “শহীদ তিন প্রকার। এক ব্যক্তি জান-মাল নিয়ে বের হয়েছে। অতঃপর যখন শত্রুর মুখোমুখী হয়েছে, তার সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছে। এই ব্যক্তি পরীক্ষিত শহীদ। পরীক্ষিত মানে হলো, তাঁকে গুনাহ থেকে পাক-সাফ করা হয়েছে। সে আল্লাহর আরশের নীচে আল্লাহর তাঁবুতে অবস্থান করবে। শুধুমাত্র নবুওয়াতের মর্যাদা ছাড়া এই ব্যক্তির উপর নবীদের ভিন্ন কোনো মর্যাদা থাকবে না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১৭৬৯৩)
আল্লাহ তাআলার কাছে শহীদের মাকাম ও অবস্থান সুমহান। আল্লাহর কাছে তাঁদের জন্য বিশাল সম্মান রয়েছে। এজন্য আমরা দেখি যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রেষ্ঠ নবী, রাসূলদের সর্দার হওয়া সত্ত্বেও শাহাদাতের তামান্না ও আকাঙ্ক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন: “আমি চাই আল্লাহর পথে জিহাদ করে শহীদ হতে”। তিনি বলেননি “আমি চাই আল্লাহর পথে কিছু সাহায্য করতে”। বরং তিনবার বলেছেন, “আমি চাই জিহাদ করে শহীদ হতে”। উলামায়ে কেরাম এই হাদীসের উপর প্রশ্ন তুলেছেন— নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কীভাবে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা করেছেন? অথচ নবুওয়াত ও রিসালাতের মরতবা শাহাদাতের মরতবা থেকে উঁচুস্তরের? উলামায়ে কেরাম নানাবিধ মতামত বর্ণনার পর এর সারমর্ম বের করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই হাদীসে মূলত আল্লাহ তাআলার কাছে শহীদের ফজীলত বর্ণনা করতে চেয়েছেন।
শহীদের মরতবা অনেক উঁচু ও মহান। আপনারা জানেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। সহীহ বুখারীতে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান্নাতে প্রবেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, জান্নাতে এমন একটি ঘরে প্রবেশ করেছি, যারচেয়ে সুন্দর ও মনোরম আর কোনও ঘর জান্নাতে দেখিনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করেন, এটা কার জন্য? (ফেরেশতারা) তাঁকে বলেছেন: “এটি শহীদদের ঘর”। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২৭৯১) আল্লাহু আকবার! জান্নাতের সর্বোত্তম, মনোরম, জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটি শহীদদের জন্য বরাদ্দ থাকবে!
জিহাদে বাধাদানকারী ও বিলম্বকারী কিছুলোক এসে আপনাকে শহীদদের এই বাড়ি থেকে বঞ্চিত করতে চেষ্টা করবে। তারা এটা করবে আপনাকে জিহাদ থেকে দূরে সরানোর মাধ্যমে। কেননা জিহাদ হচ্ছে শাহাদাতলাভের মাধ্যম আর জিহাদের ময়দান শাহাদাতের ক্ষেত্র। সাবধান! আল্লাহ তাআলা আপনাকে রক্ষা করুন! জিহাদে বাধাদানকারী ও বিলম্বকারী এই লোকগুলো থেকে সাবধান থাকুন। তারা আপনাকে জিহাদ থেকে দূরে সরিয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের সুবিশাল মরতবা অর্জন থেকে বঞ্চিত করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাদিসে বর্ণিত জান্নাতের সর্বোত্তম, মনোরম, জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটি থেকে আপনাকে মাহরুম করবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
إنَّ في الجنَّةِ مائَةَ درجةٍ أعدَّهَا اللَّه للمُجَاهِدينَ في سبيلِ اللَّه مَا بيْن الدَّرجَتَينِ كَمَا بيْنَ السَّمَاءِ والأَرْضِ
অর্থ: জান্নাতে একশটি মর্যাদার স্তর আছে, আল্লাহ্ তাআলা সেই স্তরগুলো মুজাহিদদের জন্য প্রস্তুত করেছেন। একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরের দূরত্ব আকাশ-যমীনের দূরত্বসমান। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৭৪২৩)
আকাশ-যমীনের দূরত্ব কতটুকু? এক হাদীসে এসেছে পাঁচশ বছরের দূরত্ব। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তাআলা জান্নাতে মুজাহিদদেরকে পঞ্চাশ হাজার বছরের দূরত্ব সমপরিমান উঁচু মর্যাদায় আসীন করাবেন।
আপনি যদি নিজ ভূমিতে সুখে-শান্তিতে থেকে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকেন, তাহলে কখনও শহীদের মর্যাদার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবেন না।
রব্বে কারীমের কাছে তাঁর মহানত্বের দোহাই দিয়ে প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে শাহাদাতের মাধ্যমে এই বিশাল ও উঁচু মর্যাদা লাভ করার তাওফীক দান করেন, আমীন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম