আজকের আলোচ্য বিষয়টিও আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন। মালিকুল মুলক তথা সকল বাদশার বাদশা, আকাশ-যমীনের উপর প্রতাপশালী আল্লাহ, যিনি আমাদের স্রষ্টা ও রিযকদাতা, যিনি আমাদের হায়াত-মওতের মালিক, সেই মহান সত্তার সাথে কীভাবে আদব বজায় রেখে চলব? সুবহানাল্লাহ! প্রিয় ভাই, অনেককে দেখবেন খালিকের চেয়ে মাখলুকের সাথে অনেক বেশি আদব বজায় রেখে চলে, খালিকের চেয়ে বেশি লজ্জা পায় মাখলুককে। খালিকের চেয়ে অধিক সম্মান করে মাখলুককে। এটি এক মহা সমস্যা। মানুষ দুনিয়ার রাজা-বাদশাদের সাথে আদব বজায় রাখে। যদি দুনিয়ার কোনও বাদশার সাথে দেখা করতে যায় তাহলে পোশাক-পরিচ্ছদ পরিপাটি করে, নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে। নিজেকে দুনিয়ার বাদশার সামনে খুব আদবওয়ালা, যোগ্য ও সুন্দর হিসেবে পেশ করতে যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে। অথচ এই বাদশার সৃষ্টির শুরু হয়েছে একফোঁটা নাপাক বীর্য থেকে, আর তার শেষ পরিণতি হবে দুর্গন্ধময় পঁচা লাশ। এর মধ্যখানে দুনিয়াতে জীবন-যাপনের সময়টুকুতে সে পেটে ময়লা-আবর্জনা বহন করে চলাফেরা করে। এই তুচ্ছ বাদশার সাথে দেখা করার জন্য খুব গুরুত্বসহকারে সবকিছু ব্যবস্থা করে। এই দিনগুলোকে খুব গুরুত্ব দেয়। বলে, এক সপ্তাহ পর আমার সাথে প্রধানমন্ত্রী, বাদশা বা আমীরের দেখা হতে যাচ্ছে। তাই সে নিজেকে প্রস্তুত করে। কীভাবে কথা বলবে, কী বলবে, কীভাবে বসবে…।
সুবহানাল্লাহ! মাখলুকের জন্য কত বিশাল ও মহান গুরুত্বের সাথে নিজেকে তৈরি করে! কিন্তু, এই ব্যক্তি কি এত বিশাল ও মহান প্রস্তুতি আল্লাহর জন্য গ্রহণ করবে? আল্লাহর সাথে আদব বজায় রাখতে নিজেকে এভাবে তৈরি করবে?
কিছু সুবোধ ভাই প্রশ্ন করেন যে, কীভাবে আল্লাহর সাথে আদব বজায় রেখে চলব? তাদের জবাবে এই বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে তিনটি পয়েন্ট আলোচনা করব।
প্রথম পয়েন্ট: আল্লাহ তাআলার সকল বাণী ও সংবাদ সত্য বলে স্বীকার করা। আল্লাহ ও রাসূল থেকে যেই সংবাদই আপনার কাছে পৌঁছবে, আবশ্যিকভাবে আপনি তা সত্য বলে স্বীকার করবেন। বলবেন, “শুনলাম ও মেনে নিলাম”। এতে আপনার কোনও সংশয়-সন্দেহ নেই। উদাহরণস্বরূপ, পরকাল সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা যাকিছু বলেছেন সরাসরি সবকিছু নির্দ্বিধায় মেনে নিবেন। ‘এটা কীভাবে হবে’, ‘এটা কীভাবে ঘটবে’— এমন প্রশ্ন করবেন না। এর কোনো সুযোগ নেই। “শুনলাম ও মেনে নিলাম” এর বাইরে কিছু বলার সুযোগ নেই। কেননা, সংবাদটি স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে, যিনি নিজের ব্যাপারে বলেছেন,
وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللّهِ قِيلاً
“আল্লাহর চেয়ে অধিক সত্যবাদী আর কে হতে পারে!”।
আল্লাহ তাআলার সকল সংবাদ সত্য বলে স্বীকার করবেন। তিনি অতিতের জাতি সম্পর্কে যা বলেছেন সব সত্য বলে স্বীকার করুন। আখেরাত সম্পর্কে যা বলেছেন তা সত্য বলে স্বীকার করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ জান্নাতের একটি সাধারণ গাছের ছায়া অতিক্রম করতে একজন অশ্বারোহীর একশ বছর লাগবে”। কল্পনা করুন! ঘোড়া ছুটিয়ে গাছের ছায়া শেষ করতে লাগবে একশ বছর! আমরা বলব “শুনলাম ও মেনে নিলাম”। বলবেন না যে, ভাই, এটা কীভাবে সম্ভব! একটি সাধারণ গাছের ছায়া অতিক্রম করতে একশ বছর লাগবে? আমরা বলব, “নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম”। তাই, আমরা “শুনলাম ও মেনে নিলাম”।
মনের সকল প্রশ্ন মূল্যবান এই মূলনীতির পানিতে ঠাণ্ডা করে নিন, “আখেরাতের বিষয়ে ‘কীভাবে’ প্রশ্ন করা যাবে না”। কেননা মানুষের আকল সীমাবদ্ধ ও অক্ষম। মানুষের আকল আখেরাতের বিষয়ের বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারবে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের পরীক্ষা করছেন যে, আমরা কি সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী? আল্লাহর দেওয়া সকল সংবাদ সরাসরি সত্য বলে স্বীকার করে নিন। এর প্রতি নিঃসন্দেহে নিঃসংকোচে আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা দেখাবেন। বলবেন না যে, এটা কীভাবে হবে, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে, এটি মাথায় ধরছে না।
কিছুলোক ঠুনকো দর্শন নিয়ে আসে। কিছু সেক্যুলার দর্শন পেশ করে বলে, হে ভাই, এটা মাথায় ধরছে না, মানুষকে কীভাবে কবরে আযাব দেওয়া হবে? আমরা তো কবর খুঁড়ে কিছুই দেখতে পাই না। পাশ্চাত্যের কিছু নির্বোধ আপনাকে বলবে, তারা মানুষ মারা যাওয়ার পর তার কবরে ক্যামেরা ফিট করেছে, যেন প্রশ্নকারী ফেরেশতাদ্বয়কে দেখতে পারে। এই নির্বোধরা তাঁদের দেখতে পাবে না। কেননা এটি পরকালীন জগতের বিষয়। যদি তারা কোনও জীবিত ব্যক্তিকেও মৃত ব্যক্তির কবরে রাখে, তাহলে সেও ফেরেশতাদের দেখতে পাবে না। মৃত ব্যক্তির সাথে কী হচ্ছে তা সে জানতে পারবে না। কেননা ফেরেশতা জীবিত ব্যক্তির কাছে আসবে না; বরং মৃত ব্যক্তির কাছে আসবে। এটি পরকালীন বিষয়।
এসম্পর্কে গভীরে প্রবেশ করা বা অনুসন্ধান করা আমাদের কাজ নয়। আমাদের কাছে আল্লাহ ও রাসূল থেকে এসম্পর্কে যে সংবাদ এসেছে, আমরা নির্দ্বিধায় তা মেনে নেব। যদি এসব বিষয়ে আমরা সংশয়-সন্দেহ পোষণ করি তাহলে তা হবে আল্লাহ তাআলার সাথে বেআদবির শামিল। আল্লাহর সাথে পূর্ণ আদবের প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহর সকল সংবাদ নিঃসন্দেহে নিঃসংকোচে সত্য বলে স্বীকার করা। এটি হচ্ছে আল্লাহ তাআলার সাথে আদব বজায় রাখার প্রথম ভিত্তি ও মূলনীতি।
দ্বিতীয় পয়েন্ট: আল্লাহর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলা। যখনই আল্লাহ ও রাসূলের কোনও আদেশ-নিষেধ আপনার কাছে আসবে তখনই তা অন্ধভাবে অনুসরণ করা শুরু করুন। বর্তমানে মানুষ মানুষকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে, কিন্তু আল্লাহকে অন্ধভাবে অনুসরণ করে না। যদি ডাক্তারের কাছে যায় আর ডাক্তার বলে যে, এই ট্যাবলেট আট ঘণ্টা পরপর খাবেন, এটি খাবার আগে, এটি খাবার পরে, এটি ঘুমের আগে, এটি দিনে একবার খাবেন। কেউ ডাক্তারকে প্রশ্ন করে না যে, ডাক্তার সাহেব, এটি আট ঘণ্টা পর না খেয়ে দশ ঘণ্টা পর হলো না কেন? এটি খাবারের আগে না হয়ে পরে হলো না কেন? এটি খাবারের আগে হলো না কেন? কেউ ডাক্তারের কথার উলটো করে না। বলে না যে, ডাক্তার এটি খাবারের আগে বলেছে, আমি এটি খাবারের পর খাব বা পরেরটা আগে খাব। সুবহানাল্লাহ! মানুষ ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। কেন? সে বলবে, ভাই, ইনি ডাক্তার, তিনি ভালো জানেন, তিনি অধিক প্রজ্ঞাবান। সে বলবে, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? আপনি ডাক্তারের ব্যাপারে আপত্তি করছেন কেন?
ডাক্তারের কথা মেনে চলছেন ভালো কথা। আল্লাহর আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে আপনার কী অবস্থান? আমরাও আল্লাহর যেকোনও আদেশ-নিষেধ নিঃসন্দেহে মেনে চলব। কিছুলোক আছে যারা সকল বিষয়ে সন্দেহ করে। ফজরের নামায দুই রাকাত কেন? মাগরিবের নামায তিন রাকাত কেন? কাবার চারপাশে সাতবার চক্কর কাটব কেন? মীনায় সাতবার পাথর মারব কেন? ছয়বার বা আটবার মারলে অসুবিধা কী? আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন।
আপনার কাছে আল্লাহর কোনো আদেশ-নিষেধ এসেছে, আল্লাহ যেভাবে আদেশ করেছেন আপনি সেভাবে অনুসরণ করুন। আল্লাহ চান তাঁর বান্দাকে তিনি যেভাবে আদেশ করেছেন বান্দা সকল বিষয়ে সেভাবে তা অনুসরণ করুক। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ নিজের জীবনে প্রয়োগ করা আল্লাহকে সম্মান করার প্রমাণ। অর্থাৎ, আল্লাহ যেভাবে চান বান্দা সেভাবেই তা পালন করবে। আল্লাহ যেভাবে আদেশ করেছেন সেভাবে পালন না করে অন্যভাবে, অন্য পন্থায় তা পালন করার কোনও সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা নামাযকে সময়ের সাথে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন:
إِنَّ الصَّلاَةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ كِتَاباً مَّوْقُوتاً
অর্থ: মুমিনদের উপর নির্ধারিত সময়ে নামায পড়া ফরজ করা হয়েছে।
আপনার মনমতো ফজরের নামায সূর্যোদয়ের পর বা আসরের নামায সূর্যাস্তের পর পড়লে হবে না। বরং আল্লাহ তাআলা যেভাবে আদেশ করেছেন সেভাবেই পড়তে হবে।
আল্লাহর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে অনুসরণ করা আল্লাহ তাআলাকে সম্মান করার প্রমাণ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
مَا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا وقار يعني عظمة
অর্থ: তোমাদের কী হলো, তোমরা আল্লাহর সম্মান রক্ষা করছ না কেন?
আল্লাহর সাথে উত্তমরূপে আদব বজায় রাখার মাধ্যম হচ্ছে, আল্লাহর আদেশ-নিষেধ তৎক্ষণাৎ পালন করা। সাহাবাগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুমের কাছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনও আদেশ আসলে জিজ্ঞাসা করতেন না যে, এটি কি ওয়াজিব না মুস্তাহাব? বরং তৎক্ষণাৎ তা কার্যকর করতেন।
তৃতীয় পয়েন্ট: আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের সামনে সন্তুষ্টচিত্তে আত্মসমর্পণ করা। আপনার ব্যাপারে আল্লাহর ফায়াসালা চূড়ান্ত হয়েছে, আপনার কোনও বিপদ এসেছে, সরাসরি সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর তাকদীরের সামনে আত্মসমর্পণ ও বশ্যতা স্বীকার করুন। এটি আল্লাহর সাথে আপনার আদব বজায় রাখার পরিচয় বহন করে। মানুষ যদি বিপদ-মুসীবত, দারিদ্র ও অসহায়ত্বের সময় বিরক্তিবোধ করে ও রাগান্বিত হয়, তাহলে এটি আল্লাহর সাথে তার আদব বজায় না রাখার প্রমাণ।
আল্লাহ তাআলা আমাদের কত নেয়ামত দান করেছেন। তিনি আমাদেরকে অনেক নেয়ামত দিয়েছেন। যেমন ধরুন, এক ব্যক্তি প্রতি মাসে আপনাকে এক মিলিয়ন ডলার দান করে। কিন্তু প্রতি মাসেই সে আপনাকে কিছু দায়িত্ব ও কাজ দেয়। আপনি আনন্দের সাথে সেই দায়িত্ব ও কাজ গ্রহণ করবেন। সে আপনাকে রাতে বারো ঘণ্টা সজাগ থাকতে বলল। আপনাকে বলল যে, আমি চাই তুমি আমার সাথে সফর কর বা আমার জন্য অমুক কাজটি কর। তাহলে এই কাজ আপনার কাছে খুবই সহজ মনে হবে। কেন? বলবেন, ভাই এই ব্যক্তি আমাকে প্রতি মাসে এক মিলিয়ন ডলারের চেক দিচ্ছেন। আপনি এই ব্যক্তির অনুগ্রহের কদর করেছেন। আল্লাহ তাআলা প্রতিদিন আমাকে-আপনাকে কী পরিমাণ নেয়ামত-অনুগ্রহ দান করছেন?
وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا
“যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা করতে শুরু কর তাহলে গণনা করে শেষ করতে পারবে না”।
আল্লাহ তাআলা আপনার উপর দিনে-রাতে প্রচুর পরিমাণে নেয়ামত বর্ষণ করেন। অতঃপর আপনাকে সহজ একটি পরীক্ষায় আপতিত করেছেন। কোনও রোগ, সমস্যা, গাড়ি দুর্ঘটনা বা কোনও মুসীবত দিয়েছেন। তবুও কিছু মানুষকে আল্লাহর উপর রাগ করে বলতে শোনবেন, আল্লাহ সবসময় আমাকেই দেখেন। সে অস্থির হয়ে যায়, ঘাবড়ে ওঠে। আমরা বলি, এটি আল্লাহর সাথে আদবহীনতা। আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালো-মন্দ যা-ই তাকদীরে আসুক, আপনি সবকিছু সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নিন। এটি আল্লাহর সাথে আদব বজায় রাখার পরিচয় বহন করে। কেননা তা তো আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। আর তিনি তাকদীরে যা লিখেন তা-ই কল্যাণকর। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “إنّ أمر المؤمن كله خير” “মুমিনের সকল বিষয়ই কল্যাণকর”। হাদিসে উল্লিখিত “كل” শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। অতঃপর তিনি বলেন,
“إن أصابته ضراء صبر فكان خيرًا له وإن أصابته سرّاء شكر فكان خيرًا له وليس ذلك إلا للمؤمن”.
অর্থ: যদি তার কোনও বিপদ আসে তাহলে সে সবর করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। আর যদি কোনও সুখকর বস্তু লাভ করে তাহলে সে শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। এমনটি একমাত্র মুমিনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-২৯৯৯)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর মহানত্বের শান মোতাবেক আদব বজায় রেখে চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম