মুমিনদের জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে আল্লাহর যিকর। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে আমাদেরকে যিকরের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। শুধু যিকরের প্রতি নয়; বরং অধিক পরিমাণে যিকরের প্রতি উৎসাহ দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا اللَّهَ ذِكْراً كَثِيراً * وَسَبِّحُوهُ بُكْرَةً وَأَصِيلاً
অর্থ: হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকর কর। সকাল-সন্ধ্যা তাঁর তাসবীহ পাঠ কর।
লক্ষ করুন! আল্লাহ তাআলা কেবল যিকরের আদেশ দিচ্ছেন না, বরং অধিক পরিমাণে যিকরের আদেশ দিচ্ছেন। অপর আয়াতে তিনি বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا لَقِيتُمْ فِئَةً فَاثْبُتُواْ وَاذْكُرُواْ اللّهَ كَثِيراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلَحُونَ
অর্থ: হে মুমিনগণ, যদি তোমরা শত্রুদলের মুখোমুখী হও, তাহলে দৃঢ় থেক এবং অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকর কর, যেন তোমরা সফল হতে পার।
আহলে ইলম আলেমগণ বলেন, শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমগুলো হচ্ছে, দৃঢ়তা, বীরত্ব, সাহসিকতা ও অধিক পরিমাণে আল্লাহর যিকর। অধিক পরিমাণে যিকর মানুষকে নিয়ত ও কাজের দৃঢ়তা, শক্তি এবং সাহসিকতা দান করে।
তৃতীয় আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা হযরত মুসা ও হারুন আলাইহিমাস সালাম সম্পর্কে উল্লেখ করেন। যখন তাঁরা ফেরাউনের কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করে তখন বলে,
كَيْ نُسَبِّحَكَ كَثِيراً * وَنَذْكُرَكَ كَثِيراً
অর্থ: যাতে আমরা বেশি করে আপনার তাসবীহ ও যিকর পাঠ করতে পারি।
আল্লাহ তাআলা অধিক পরিমাণে তাসবীহ ও যিকর পাঠের বিষয়টি জোর দিয়ে বলেছেন।
সুরা জুমুয়ার আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ: যখন নামায শেষ হয় তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়ে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং বেশি বেশি আল্লাহর যিকর কর, যেন তোমরা সফল হতে পার।
আল্লাহ তাআলা এই আয়াতগুলোতে বেশি বেশি যিকর করার কথা জোর দিয়ে বলেছেন। একজন মুমিনের জন্য কেবল সকাল ও সন্ধার যিকর-ই যথেষ্ট নয়; বরং তার উচিত অধিকাংশ সময়ই যিকর করে কাটানো। যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী দেখি তাহলে দেখব যে, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবসময় যিকর করতেন। অর্থাৎ, বসে, দাঁড়িয়ে, শুয়ে সর্বাবস্থায় যিকর করতেন।
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ وَاخْتِلاَفِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآيَاتٍ لِّأُوْلِي الألْبَابِ*الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللّهَ قِيَاماً وَقُعُوداً وَعَلَىَ جُنُوبِهِمْ
অর্থ: নিশ্চয়ই আকাশ-যমীনের সৃষ্টি এবং দিনরাতের পরিবর্তনের মাঝে জ্ঞানীদের জন্য আল্লাহ তাআলার নিদর্শন রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহর যিকর করে।
আমাদের উচিত বেশি বেশি যিকর করা। বেশি বেশি যিকর করলে অন্তরে কোমলতা, প্রশান্তি, সাহসিকতা ও স্থিরতা পাওয়া যায়। ইমাম ইবনে কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ “আল-ওয়াবিলুস সাইয়িব” কিতাবে যিকরের প্রায় একশ উপকারিতা উল্লেখ করেছেন।
বেশি বেশি যিকরের একটি ফায়দা হচ্ছে, মুনাফিকদের গুণ থেকে নিরাপদ থাকা। আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের গুণ উল্লেখ করেছেন যে, তারা খুব কমই আল্লাহ তাআলার যিকর করে। মুনাফিকদের এই গুণ থেকে সাবধান হোন।
আপনার মাঝে বরং সৌভাগ্যশীলতার গুণ থাকা উচিত। তা হচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে, ঘরে-বাইরে, প্রতিষ্ঠানে যেখানেই থাকুন সর্বদা যিকর জারি রাখা। যবানকে যিকরে অভ্যস্ত করে তুলুন। যিকরের অভ্যাস তৈরি করুন। সহীহাইনে হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,
“كلمتان خفيفتان على اللسان …”
অর্থ: দুটি কালিমা বা বাক্য যা যবানে উচ্চারণ করা সহজ।
সুবহানাল্লাহ! যিকর করা যবানের জন্য সহজ। যদি কেউ এক-দুই ঘণ্টা বসে আল্লাহর যিকর করে তাহলে সে ক্লান্তিবোধ করবে কি? সে কি বলবে, আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। কেননা আমার জিহ্বা যিকর করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে? জিহ্বা ক্লান্ত হয় না। হয় তা ভালো কাজে নতুবা মন্দ কাজে ব্যস্ত থাকে।
“كلمتان خفيفتان على اللسان ثقيلتان في الميزان …”
অর্থ: দুটি কালিমা যবানে উচ্চারণ করা সহজ। মীজানে অনেক ভারি।
অর্থাৎ, যে কালিমাদুটি কিয়ামতের দিন আপনার মীজানের পাল্লা ভারি করে তুলবে। “حبيبتان للرحمن” “যে কালিমাদুটি দয়ালু রবের কাছে অনেক পছন্দনীয়”। কালিমাদুটি হচ্ছে,
“سبحان الله وبحمده سبحان الله العظيم”
অর্থ: আল্লাহর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করছি। মহান আল্লাহর পবিত্রতার ঘোষণা দিচ্ছি।
যিকরের ফায়দা অনেক মহান ও মূল্যবান। এজন্য আল্লাহ তাআলা ইসলামের স্তম্ভ নামাযের পর যিকর করতে বলেছেন,
فَإِذَا قَضَيْتُمُ الصَّلاَةَ فَاذْكُرُواْ اللّهَ قِيَاماً وَقُعُوداً وَعَلَى جُنُوبِكُمْ
অর্থ: যখন তোমরা নামায আদায় করে ফেলবে তখন দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর যিকর কর।
রমাদান শেষে আল্লাহ তাআলা কী করতে বলেছেন? তিনি বলেন,
وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
অর্থ: তিনি চান যেন তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদের যে পথ দেখিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
রমাদান শেষে আমাদেরকে আল্লাহ তাআলার তাকবীর পাঠ করার অর্থাৎ যিকর করার আদেশ দিচ্ছেন। নামাযের পর, রোযার পর এমনকি হজ্জের পরও যিকর করতে বলেছেন।
فَإِذَا قَضَيْتُم مَّنَاسِكَكُمْ فَاذْكُرُواْ اللّهَ كَذِكْرِكُمْ آبَاءكُمْ أَوْ أَشَدَّ ذِكْراً
অর্থ: তোমরা যখন হজ্জের কার্যাবলী শেষ কর তখন আল্লাহকে সেইভাবে স্মরণ কর যেভাবে বাপ-দাদাদের স্মরণ করে থাক। বরং তারচে বেশি আল্লাহকে স্মরণ কর।
এটি আরাফা থেকে রওয়ানা হওয়ার পর হজ্জের রোকন আদায়ের শেষে যিকরের ব্যাপারে বলা হয়েছে। পূর্বে জুমার নামায আদায়ের পর যিকরের আয়াত উল্লেখ করেছি। মোটকথা একজন মুমিনের সারাটি দিন যেন যিকরে কাটে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَلاَ بِذِكْرِ اللّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
অর্থ: জেনে রাখ! আল্লাহর যিকরের দ্বারা অন্তর প্রশান্ত হয়।
সুবহানাল্লাহ! প্রিয় ভাই, যিকরের মতো অন্য কিছুতে অন্তর এতটা প্রশান্ত হয় না। অন্য কিছুতে এতটা সৌভাগ্য, শান্তি ও নিশ্চিন্তার খোরাক পাওয়া যায় না। আল্লাহর যিকরে নিহিত রয়েছে সৌভাগ্য, শান্তি, নিশ্চিন্তা ও কোমলতা। আমাদের উচিত বেশি বেশি যিকর করে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলা। কেননা মানুষ যে জিনিসে অভ্যস্ত হয় সাধারণত সেই জিনিসের উপরই মৃত্যু হয়। আলেমগণের মূলবান এই কথাটি অনুধাবন করুন, “মানুষ যে জিনিসে অভ্যস্ত হয় সাধারণত সেই জিনিসের উপরই মৃত্যু হয়”। এর অর্থ কি?
যদি আপনি সারাজীবন যিকর করে কাটান তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি যিকর করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবেন। আপনাকে কালিমায়ে শাহাদাতের তালকীন করার জন্য কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন হবে না। কেননা কালিমায়ে শাহাদাত তো সকাল-সন্ধ্যা আপনার অন্তরে সদা জাগ্রত ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“من كان آخر كلامه من الدنيا لا إله إلا الله دخل الجنة”.
অর্থ: দুনিয়াতে যার শেষকথা হবে “لا إله إلا الله” সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (আবু দাউদ, হাদীস নং-৩১১৬)
আমাদের যবান ও কলবকে বেশি বেশি আল্লাহর যিকর করার তরবিয়ত দিয়ে বেশি বেশি যিকর করার অভ্যাস করতে হবে। এক আছারে এসেছে,
ما عمل ابن آدم عملًا أنجى له من عذاب الله من ذِكر الله سبحانه وتعالى
অর্থ: বনি আদম যত আমল করে, এর মাঝে যিকরের আমলের মতো এত বেশি আল্লাহর আযাব থেকে রক্ষাকারী কোনও আমল নেই।
আমাদের দ্বীনে ইসলামে যিকরের মর্যাদা অনেক উপরে। আল্লাহ তাআলা আপনাকে বরকত দান করুন। বেশি বেশি যিকর করার প্রতি আগ্রহী হোন। যদি কেউ যিকরের ফায়দা ও উপকারিতার ব্যাপারে আরও বেশি জানতে চান, তাহলে ইবনে কাইয়িম রহিমাহুল্লাহর “আল-ওয়াবিলুস সাইয়িব” কিতাবটি অধ্যয়ন করুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বেশি বেশি যিকর করার আদত ও তাওফীক দান করুন, আমীন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম