দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসার পর থেকে তাকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা চলছে। দুর্নীতির জন্য তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি উঠছে বিভিন্ন মহল থেকে। বেনজীর আহমেদ এখন কোথায় আছে, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কারও কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে, বেনজীর আহমেদ দেশে নেই।
বেনজীর আহমেদ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ৬২১ বিঘা জমি, ঢাকার গুলশানে ৪টি ফ্ল্যাট, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ৩টি বিও হিসাব (শেয়ার ব্যবসা করার বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রের সন্ধান পেয়েছে দুদক। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব সম্পদ জব্দ করার আদেশ দিয়েছে আদালত।
আদালতের ওই আদেশ আসার আগেই গত ৪ মে বেনজীর আহমেদ দেশ ছেড়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই সূত্র জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে বেনজীর আহমেদ এখন সিঙ্গাপুরে আছে। তবে সে আসলেই সিঙ্গাপুর আছেন নাকি অন্য কোনো দেশে আছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত ২৭ মে প্রথম আলোর প্রতিনিধি বেনজীর আহমেদের গুলশান-১ নম্বরের বাসায় যান। সেখানে তার বাসার নিরাপত্তাকর্মী সবুজ মিয়া জানিয়েছিলেন, দুই সপ্তাহ ধরে বেনজীর আহমেদকে তিনি দেখেননি। পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা ও তার পরিবারের কেউ বাসায় আছে কি না, সে বিষয়েও তিনি নিশ্চিত নন।
এ ছাড়া মঙ্গলবার গোপালগঞ্জে বেনজীর আহমেদের পরিবারের মালিকানাধীন সাভানা ইকো রিসোর্ট অ্যান্ড ন্যাচারাল পার্কে গেলেও সেখানকার কেউ তার অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেনি।
বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি দুই পর্বে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১ ও ২) প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত প্রথম পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্ট। এই রিসোর্টের পাশে আরও ৮০০ বিঘা জমি কিনেছে তার পরিবার। এ ছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের ২ লাখ শেয়ারও রয়েছে তাদের। ঢাকার বসুন্ধরায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও রয়েছে বেনজীরের পরিবারের। এসব সম্পত্তি অবৈধ টাকায় কেনা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’ প্রকাশ করা হয় ২ এপ্রিল। এই পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুর সদরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর ভাওয়াল রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এই রিসোর্ট করতে বনের ২০ বিঘা জমি দখল করা হয়েছে। এই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীর পরিবারের। এ ছাড়া দুবাইয়ে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা, সিঙ্গাপুরে সোনার ব্যবসা এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় তার পরিবারের জমি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কালের কণ্ঠ-এর প্রতিবেদনের পর ২০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করে বেনজীর আহমেদ। ভিডিওতে সে দাবি করে, তার পরিবারের যে সম্পদ রয়েছে, তা বৈধ এবং এর হিসাব ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ রয়েছে। অবৈধ যেসব সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে, তা কেউ প্রমাণ করতে পারলে ওই ব্যক্তি বা গ্রুপকে সেই সম্পত্তি সে বিনা পয়সায় লিখে দেবে বলেও ভিডিওতে দাবি করে।
তবে বেনজীর ও তার স্ত্রী-সন্তানদের সম্পদ জব্দে দুদকের আবেদন এবং আদালতের আদেশ নিয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি সে। এই ঘটনার পর থেকে অনেকটা লাপাত্তা পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা।
বর্তমান অবস্থান এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে বেনজীর আহমেদের মুঠোফোন নম্বর, হোয়াটসঅ্যাপ ও ই-মেইলে যোগাযোগ করা হলেও সে সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছে প্রথম আলো।
বেনজীর পরিবারের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক। বেনজীর যদি দেশেই না থাকে, দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে লাভ কী হবে? দেশ ত্যাগের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদক কার্যালয়ে তাকে তলব করেও কোনো ফল পাওয়া যাবে না। সে সিঙ্গাপুর থেকে এসে দুদক কার্যালয়ে এসে জবানবন্দী দেবে, এটা কেউ বিশ্বাস করে না। দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালিয়েছে অনেক দিন ধরে। সরকার চাইলে আগেই তার বিদেশ যাত্রার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারত। কিন্তু দেয়নি। তাই বেনজীরের পালিয়ে যাওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের দিকে আঙ্গুল তুলছেন অনেকে।
বেনজীর আহমেদকে যখন শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, তখন সে নিরপরাধ ছিল কি না, এমন প্রশ্ন তুলেছে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। দলটি বলছে, সে (বেনজীর) তো এক দিনে গড়ে ওঠেনি। সরকার হীনস্বার্থে বেনজীরকে ব্যবহার করেছে। পাশাপাশি তাকে দেশ থেকে পালাতে সুযোগ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ তাদের।
তথ্যসূত্র:
১. বেনজীর আহমেদ দেশে নেই – https://tinyurl.com/45ewswa7
২. বেনজীরকে দেশ থেকে পালাতে সুযোগ করে দিয়েছে সরকার: রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন – https://tinyurl.com/s8vt53cs
৩. বেনজীরকে দেশ ছাড়ার সুযোগ দিল কে – https://tinyurl.com/4ahsh6rk