গত ২৫ নভেম্বর ভারতের কথিত সুপ্রিম কোর্ট দিল্লির বায়ুদূষণকে কেন্দ্র করে বলেছিল, এভাবে মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট দেওয়ার বদলে বোমা ফাটিয়ে সবাইকে একবারে মেরে ফেলা ভালো। মজার ব্যাপার হলো, ওই দিন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরটি ছিল ঢাকা। দিল্লি ছিল চতুর্থ।
কয়েক মাস ধরে বায়ুদূষণে ঢাকা নিয়মিত ফার্স্ট-সেকেন্ড বয়। রিপোর্ট বলছে দেশের শতভাগ মানুষ বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করে। আর ২০১৭ সালে সোয়া এক লাখ মানুষ মারাও গেছে বায়ুদূষণে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার, ২০১৯)। এই যে এক লাখেরও বেশি মানুষ শেষ পর্যন্ত বাঁচতেই পারল না এই বিষাক্ত শহরে, সেই দায় কার? এই শহরটা পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহর হলো কী করে? কেন একটা শহরের বাতাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০০ গুণ বেশি ক্যাডমিয়াম থাকবে? দ্বিগুণের বেশি সিসা থাকবে? তিন গুণের বেশি ক্রোমিয়াম থাকবে? মারাত্মক ক্ষতিকর ‘পিএম ২.৫’ বিপৎসীমারও ১০ গুণ বেশি থাকবে কেন? আমাদের মন্ত্রীরা বলে, দেশ কানাডা হবে, সিঙ্গাপুর হবে। তো সিঙ্গাপুর, কানাডার বাতাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০০ গুণ বেশি ক্যাডমিয়াম ভাসে?
ঢাকার বায়ুদূষণের অর্ধেকটা হয় ইটভাটার কারণে। বাকিটা ট্রাক, বাস, শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া, হড়বড়িয়ে গড়ে ওঠা কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি, আর মাশরুমের মতো গজিয়ে ওঠা মেগা উন্নয়ন। প্রশ্ন করুন, ইটের ভাটার বিকল্প কী? কালো ধোঁয়ার বিকল্প কী? বিল্ডিং কোড না মানা বিল্ডিংগুলোর বিকল্প কী? আপাতদৃষ্টিতে বিকল্প নেই। রদ্দি আমলের উন্নয়ন মডেলে এ রকম মানুষ মেরে মেরেই শহর–বন্দর হয়েছে। কিন্তু আমাদের মন্ত্রীদের না রোল মডেল সিঙ্গাপুর, লাস ভেগাস? সৌরবিদ্যুৎ, বর্জ্যবিদ্যুৎ, লোকাল শিল্পায়ন আর টেকসই উন্নয়নের উত্থানের দিনে এবং সর্বোপরি ‘ডিজিটাল’ বাংলাদেশের এই ‘স্বর্ণযুগে’ এই সব মানুষ মারা রদ্দি উন্নয়নের চিন্তা তাঁদের মানায়?
আসল কথা হলো, দেশে মেগা ‘উন্নয়ন’ চলছে ন্যূনতম সমন্বয় ছাড়া। একটা বসবাসের অনুপযোগী ভাগাড় আমাদের রাজধানী। একটা শহরের সবকিছু ভেঙে পড়ছে, তবু বিকেন্দ্রীকরণের ন্যূনতম ইচ্ছা নেই। এই শহরে বছরব্যাপী খাওয়ার পানির জন্য তীব্র হাহাকার। পানির স্তর ২০০ ফুটের নিচে নেমে গেছে! গায়ে গায়ে লাগানো বিল্ডিং। শতকরা ৬৭ ভাগ দালানের বিল্ডিং কোডের বালাই নেই। ফায়ার সার্ভিস ঢোকার রাস্তা নেই। ৭০ ভাগ গ্যাস পাইপলাইনের মেয়াদ নেই। ট্রাফিকের গড় গতি কমতে কমতে ঘণ্টায় মাত্র ৭ কিলোমিটার! এই শহরে না আছে একটা সবুজ খেলার মাঠ, না আছে একটা পরিষ্কার খালের পাড়, না আছে একটা সচল ড্রেন, না আছে একটা নিরাপদ ‘ফায়ার এক্সিট’, না আছে একটা ঠিকঠাক জেব্রা ক্রসিং। বাতাসের লেভেল ‘মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর’। এরই মধ্যে শিশুরা ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায়, খোলা বাতাসে কাজ করে নির্মাণশ্রমিক, রিকশাচালক, ট্রাফিক পুলিশ, সিএনজি অটোরিকশাচালক, বাসের হেলপার, অফিসগামী হাজারো মানুষ। তারপরও এই মুমূর্ষু মেট্রোপলিটনের চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন ট্রাক ভরে ভরে ইটের চালান ঢোকে।
এই সব ইটের সাপ্লাই, এই সব বিল্ডিং কোড না মেনে দাঁড়িয়ে যাওয়া গাদা গাদা বিল্ডিং, এই সব খোলা বাতাসে উড়তে থাকা মহা বিপজ্জনক পার্টিকেল আমাদের ঢোল পেটানো জিডিপির সবচেয়ে বড় খোরাক। ইটভাটা আমাদের জিডিপির ১ শতাংশ। আর নির্মাণশিল্প জিডিপির ১৪ শতাংশ। এই ১৪-১৫ শতাংশ জিডিপি মানে ঢাকার বাতাসে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়া কার্বন মনো–অক্সাইড, আর প্রবল হাঁপানিতে ভোগা কয়েক লাখ ইটশ্রমিক। এই ১৫ শতাংশ জিডিপির বদলে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় দেড় বছর, আর রাজধানীর এক–চতুর্থাংশ বাচ্চা ছেলেমেয়ের ছোট্ট ফুসফুসগুলোও ক্ষয়ে গেছে।
এই উন্নয়নের দেশে বড় বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয় জিডিপির একেকটি শতাংশ।
২.
ঢাকার মানুষের রোগবালাই বাড়ছে। বাড়ছে অ্যাজমা অ্যাটাক, বাড়ছে হার্টের অসুখ, হার্ট ফেইলিউর, রেসপিরেটরি ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, ডায়াবেটিস আর ফুসফুসের ক্যানসার। বছর বছর এই সব রোগবালাই বাড়ে কেন?
দেশে ওষুধের বাজার সাড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ওষুধশিল্প আমাদের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ। দেশে অসুখবিসুখ বেড়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া বেড়েছে, ইনহেলার ও মাস্কের বিক্রিবাট্টা বেড়েছে, ব্যাঙের ছাতার মতো ফার্মেসির সংখ্যা বেড়েছে, ওষুধের রপ্তানিও বেড়েছে। এদিকে বাতাসে বাড়ছে সালফার ডাই-অক্সাইড, ধুলায় ক্যাডমিয়াম আর পানিতে সিসা। শহরের কোনায় ঘুপচিতে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে, প্রাইভেট চেম্বারের ব্যবসা বাড়ছে, মোড়ে মোড়ে বাড়ছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। তো এই সব অসুখবিসুখ, ঘা-পাঁচড়া, হাঁপানি, ক্যানসার নিয়ে রমরমা বাণিজ্য খুব ভালো খবর? গবেষণা বলছে, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে হার্টের অসুখে। আর প্রতিবছর ১৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারে (ডব্লিউএইচও, ২০১৮)। এই উন্নয়নের দেশে মরণব্যাধিগুলো প্লেগের মতো ছড়িয়ে পড়ছে কেন? মরে যাওয়া মানুষগুলোর ময়নাতদন্ত করুন না, বেঁচে থাকা রোগীগুলোর হার্ট আর ফুসফুসের সিটি স্ক্যানটাও করুন, টের পাওয়া যাবে এর সঙ্গে ‘মেগা’ উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক।
একদিকে ধমাধম কোটিপতি বৃদ্ধির এই বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আবার অন্যদিকে দেশের ৬০ লাখ মানুষ প্রতিবছর চিকিৎসার খরচ বইতে গিয়ে আরও গরিব হয়ে পড়ছে (আইসিডিডিআরবি, ২০১৪)। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের (২০১৫) গবেষণা দেখাচ্ছে, বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসার খরচ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি। মাথাপিছু আয় বাড়া নিয়ে কত অহমিকা, তো মাথাপিছু সালফার ডাই-অক্সাইড গেলার পরিমাণ বেড়ে যাওয়া আর মাথাপিছু চিকিৎসার খরচ আট বছরে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা আছে? বায়ুদূষণ কমাতে আদালতের আদেশের পর কেউ কিছু করে? চিকিৎসার খরচ কমাতে বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ চোখে পড়ে? উল্টো জনস্বাস্থ্যে আমাদের বাজেট এশিয়ার মধ্যে তলানির দিকে (মাত্র ০.৮ %)। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এমনকি আফগানিস্তানেরও স্বাস্থ্য বাজেট (জিডিপির অনুপাতে) আমাদের চেয়ে বেশি! অসংখ্য মানুষ জমি বেচে, গয়না বেচে, ধারদেনা করে চিকিৎসার অস্বাভাবিক খরচ জোগাচ্ছে। এতে দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনটাও বাড়ছে। আর শেষমেশ ফুসফুসে ঘা-ওয়ালাদের এই সব বেচাবেচিতে ধপাধপ জিডিপিও বাড়ছে।
কিন্তু ভাবুন, হার্টে ঘা, ফুসফুসে ঘা, কিডনিতে ঘা, সারাক্ষণ খুকখুক কাশি, চোখ জ্বালাপোড়া, ক্রনিক মাথাব্যথা, চামড়ার ঘা–পাঁচড়া—এই সব একটা সুস্থ, সুন্দর, ‘ডিজিটাল’ জাতিকে মানায়? লাস ভেগাস হওয়ার খায়েশ আর জিডিপির ২ শতাংশের বদলে আপনার শিশুসন্তানের ছোট্ট ফুসফুসটি, ছোট্ট হৃদ্যন্ত্রটি বেচতে পারবেন আপনি?
৩.
কথা ছিল, একটি স্মার্ট শহর। কথা ছিল সবুজ খেলার মাঠ আর শহর ঘিরে বহতা নদী। কথা ছিল সিঙ্গাপুরের মতো দক্ষ চিকিৎসাব্যবস্থা। বিপুলসংখ্যক নার্স। কানাডার মতো ঝকঝকে বাতাস, নল খুললেই পরিষ্কার পানি। কথা ছিল গণপরিবহন। দেশজুড়ে রেল নেটওয়ার্ক। বাইসাইকেল লেন। কথা ছিল
স্থানীয় পর্যায়ে শিল্পায়ন। শত শত পাটকল। ধান-সবজি-আলুর কোল্ডস্টোরেজ। উপকূলজুড়ে বায়ুবিদ্যুৎ। মাঠেঘাটে সৌরবিদ্যুৎ, বর্জ্যবিদ্যুৎ,
প্লাস্টিক রিসাইক্লিং। গ্রামে গ্রামে জৈব খামার। ধানখেতে, সবজিখেতে কারখানার কেমিক্যাল উপচে পড়লেই জরিমানা।
অথচ এর বিপরীতে আমরা পেয়েছি ২৯টি কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি। অনিয়ন্ত্রিত ইটের ভাটা, কারখানার বর্জ্য। পেয়েছি খেত-খামার নষ্ট করে দেওয়া ডাইং ইন্ডাস্ট্রি। পদ্মা থেকে বঙ্গোপসাগরে দৈনিক ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক। আমরা পেয়েছি ফরমালিন, ভেজাল খাবার, দুধের বদলে ডিটারজেন্ট, আর গরুর মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক। আমরা পেয়েছি একটি রোগশোকে ভোগা রুগ্ন জাতি, ১০ হাজার জনে মাত্র একজন নার্স, ১ হাজার জনে মাত্র একটি হাসপাতাল বেড, আর শত শত রিকশাচালক ও নির্মাণশ্রমিকের স্রেফ কাশতে কাশতে মরে যাওয়া।
শুধু বায়ুদূষণজনিত রোগে এক বছরেই মরে গেল বাংলাদেশের ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ! ভাবা যায়? এসব এপিটাফে কোনো দিন লেখা থাকবে কি একটি ‘রোল মডেল’ রাষ্ট্রের উন্নয়ন নামক লুটপাটতন্ত্রের ডাইরেক্ট বলির পাঁঠা হয়েছিল তারা?
এরপর কী? ভারতের মতো বোতলে ভরে ফ্রেশ বাতাস বিক্রি হবে এই দেশে? ওজন মেপে মেপে? সেটাও একখানা নতুন ‘বিজনেস মডেল’ বটে। জিডিপির কয়েক বেলার খাদ্য।
এভাবে উন্নয়নের দেশে মানুষ মরে, জিডিপি বাড়ে। জিডিপি বাড়ে, মানুষ মরে।
সুত্রঃ প্রথম আলো