পর্যাপ্ত সহায়তার ব্যবস্থা না করে ভাসানচরে ২৯ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। ওই রোহিঙ্গারা সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে। দুই মাস সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় থেকে ফিরে এসেছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) সংক্রমণ রুখতে তাদের ভাসানচরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন ২রা মে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভাসানচরে পাঠানো ওই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করেছিল। তবে এইচআরডব্লিউ তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়ে জানতে পেরেছে, তাদের মধ্যে অন্তত সাতজন বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরের নিবন্ধিত বাসিন্দা। মোমেন বলেন, এখন থেকে সকল নতুন আগত রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হবে।
যদিও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, চরটি বসবাসের উপযুক্ত নয় এবং সেখানে জাতিসংঘ বা ত্রাণ সংস্থাগুলোর পক্ষে সহায়তা পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেছেন,কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের মধ্যে নৌকায় করে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেয়া বাংলাদেশের জন্য কঠিন এক সমস্যা। তবে তাদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ছাড়া বন্যাপ্রবণ দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়াটা কোনো সমাধান নয়। তিনি বলেন, কোয়ারেন্টাইনে থাকা প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে ত্রাণ সংস্থার সহায়তা ও ঝড় থেকে নিরাপত্তা এবং মূল ভূখণ্ডে তাদের পরিবারের কাছে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে হবে। প্রসঙ্গত, দুই মাস আগে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় রোহিঙ্গাদের নৌকাবোঝাই বেশ কয়েকটি দল। অনেকে সমুদ্রেই মারা যান। ১৫ই এপ্রিল বাংলাদেশ উপকূল রক্ষীবাহিনী একটি নৌকা থেকে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে। এখনো সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় রয়েছে ৭০০ রোহিঙ্গাবোঝাই দুটি নৌকা। ২রা মে সকালে একটি নৌকা থেকে ৫০ জন রোহিঙ্গার পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণের বিনিময়ে তাদের বাংলাদেশ উপকূলে পাঠায় পাচারকারীরা। শরণার্থীদের পরিবার এইচআরডব্লিউকে জানায়, তাদের আত্মীয়-স্বজনের মুক্তির জন্য পাচারকারীদের প্রাথমিক সফরের খরচ বাদে জন প্রতি ৩৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা করে পরিশোধ করতে হয়েছে তাদের। এদের মধ্যে অনেকেই শিবিরে মিশে যেতে পেরেছে। তবে ২৯ জনকে আটক করেছে কর্তৃপক্ষ। ধারণা করা হচ্ছে, শিগগিরই আরো রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ উপকূলে এসে পৌঁছাবে। কুতুপালং শিবিরের এক শরণার্থী জানান, পাচারকারীদের অর্থ পরিশোধ করে পাচারকারীদের কাছ থেকে তার দুই কন্যাকে মুক্ত করে এনেছেন তিনি। কিন্তু তাদের দুজনকেই এখন ভাসানচরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মেয়েদের নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। তারা আমাকে জানিয়েছে যে, তারা আর কখনো ফিরে আসতে না পারার ভয়ে আছে। এটা খুবই বেদনাদায়ক। তিনি জানান, তার মেয়েদের ভাসানচরে পাঠানোর আগে তাকে জানায়নি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। বলেন, আমার মেয়ে আমাকে জানিয়েছে যে, কিছু সরকারি কর্মকর্তা তাকে বলেছে যে, ‘তোমার বাবা-মাকেও চরে নিয়ে আসা হবে।’ অপর এক শরণার্থী জানিয়েছেন, ৫৪ দিন আগে শিবির ছেড়ে গিয়েছিল তার বোন। অবশেষে পাচারকারীরা তাকে ফিরিয়ে এনেছে। ওই ব্যক্তি তার বোনকে দেখতে পুলিশ স্টেশনে গেলে তাকে জানানো হয় যে, তার বোনকে ভাসানচরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দাবি, করোনা মহামারির সময় রোহিঙ্গা শিবির ‘দূষিত’ করতে চান না তারা। কিন্তু একইসঙ্গে নতুন আগতদের ভাসানচরে পাঠানোর আগে তাদের জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তার ব্যবস্থা করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচআর-এর এক প্রতিনিধি জানান, তারা কক্সবাজারে আগত যেকোনো শরণার্থীকে শিবিরের কাছে নিরাপদ কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কক্সবাজারে করোনা পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা রয়েছে। এপ্রিলে উদ্ধার করা প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে কোয়ারেন্টাইনের ব্যবস্থা করে দিতে সহায়তা করেছে মানবিক সহায়তাদানকারী সংস্থাগুলো। পরীক্ষা শেষে তাদের ফলাফল নেগেটিভ আসলে তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। এইচআরডব্লিউ বলেছে, জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় না করে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে কোয়ারেন্টিন করা উচিত নয় বাংলাদেশের। তাদের যথাযথ মেডিক্যাল ও খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করা উচিৎ। কোয়ারেন্টাইনের নির্ধারিত সময় শেষ হলে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে ফিরিয়ে আনা উচিৎ। উল্লেখ্য, মিয়ানমারে নির্যাতন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন শিবিরে বাস করছে। তাদের ফিরে যাওয়ার জন্য যথাযথ পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। এদিকে, বাংলাদেশ আর রোহিঙ্গা শরণার্থী নিতে পারবে না বলে জানিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন জানান, দেশের নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষীবাহিনী সকল নতুন শরণার্থীবাহী নৌকা ফিরিয়ে দিতে সতর্ক রয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সমুদ্রে বিপদগ্রস্তদের বাঁচানোর ব্যাপারে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নিয়মের প্রতি আনুগত্যের বিরোধী। এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এডামস বলেন, রোহিঙ্গাদের পলায়নে মিয়ানমারের অপরাধ বাংলাদেশকে ওইসব শরণার্থীদের এমন কোনো দ্বীপে পাঠানোর অনুমোদন দেয় না, যে দ্বীপে তাদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। প্রসঙ্গত, ভাসানচরে শরণার্থীরা শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিতে আছে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র: মানবজমিন