একাধিক ফ্লাইওভার ও ইউটার্ন নির্মাণের পরও সড়কে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি কাটছেই না। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতায় বছরজুড়ে লেগে আছে খোঁড়াখুঁড়ি। কোনো কোনো ভাঙা সড়কে দুই-তিন বছরেও নজর দিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত সড়কে তৈরি হয়েছে এক-দেড় ফুট গর্ত। গতি কমিয়ে হেলে-দুলে চলছে যানবাহন। বৃষ্টি এলেই গর্তগুলো পানির নিচে হারিয়ে যাওয়ায় মৃত্যুফাঁদে পরিণত হচ্ছে এসব সড়ক। সড়কের কোথাও মাথা উঁচু করে রয়েছে ম্যানহোলের ঢাকনা, কোথাও এসব ঢাকনা সড়ক থেকে ৫ থেকে ৬ ইঞ্চি নিচু। বছর ঘুরলেও শেষ হচ্ছে না অনেক সড়কের সংস্কার কাজ। এতে একদিকে যেমন ঘটছে দুর্ঘটনা, সেই সঙ্গে যানবাহনের গতি কমে যাওয়ায় তৈরি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে ঢাকার রাস্তার। মিরপুর টু আগারগাঁও : মিরপুর-১২ নম্বর থেকে আগারগাঁও রাস্তায় ছোট-বড় দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। বিশেষ করে বৃষ্টি হলে এই রাস্তায় সিএনজি-রিকশা উল্টে যাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। গত সপ্তাহে এই রাস্তায় দুর্ঘটনার শিকার হন শরিফ আহমেদ। তিনি জানান, রাস্তার গর্তে পড়ে হঠাৎ সিএনজি উল্টে যায়। সিএনজিচালক তার গেট খুলে বের হতে পারলেও আমি বের হতে পারছিলাম না। আবার চালক একাই সিএনজিটা সোজা করতে পারছিলো না। আমি চিৎকার করছিলাম। পরে কিছু মানুষ এসে আমাকে উদ্ধার করেন। আমি এই রাস্তায় নিয়মিত চলাচল করি। গত এক বছরে এই রাস্তায় অনেক দুর্ঘটনা দেখেছি। কবে যে এই রাস্তা ঠিক হবে! আরিফুল নামের একজন সিএনজি চালক বলেন, বর্ষার শুরু থেকেই এই রাস্তার বেহাল দশা। ঠিক করার কোনো উদ্যোগও নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১২ নম্বর পর্যন্ত রাস্তায় ছোট-বড় খানাখন্দে ভরপুর। গাড়িগুলোর চাকা ডুবে যায় একটু বৃষ্টি হলেই। রাস্তার বেহাল দশার কারণে মাঝে মাঝে শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত রাস্তায় যানযট লেগেই থাকে। এ ছাড়া মিরপুর ১০ নম্বর গোলচক্কর থেকে মিরপুর ১২ নম্বর ও পল্লবী অংশের রাস্তারও বেহাল দশা। এই রাস্তায় বৃষ্টি হলে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। অনেক স্থানেই বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে।
ইটের সুরকিতেও কাজ হয় না : ঢাকার হানিফ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর অংশের নিচের রাস্তা বেহাল হয়ে পড়েছে। রাস্তার মাঝে গভীর গর্তও তৈরি হয়েছে। এই বেহাল রাস্তায় ঝুঁঁকি নিয়ে প্রতিদিন ভারী যানবাহন থেকে শুরু করে প্রায় সব ধরনের গাড়ি চলে। দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দাদের অভিযোগ, এক বছরের বেশি সময় হয়েছে মেরামত হয়নি এই রাস্তা। গর্ত হলেই ইটের সুরকি দিয়ে দায়সারা কাজ হয়। হানিফ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী অংশের নিচের এই রাস্তায় তিন মাস আগে ইটের সুরকি ফেলে ভরা হয়েছিল গর্ত। এখন আবার ফিরেছে আগের দুর্দশা।
শ্যামলী রিং রোডের বেহাল দশা : বেহাল দশা শ্যামলী রিং রোডের। শ্যামলী সিনেমা হল থেকে শিয়া মসজিদ পর্যন্ত এই রাস্তার দুই পাশে খানাখন্দে ভরা। প্রায় ছয় মাসেও এই রাস্তা সংস্কারে কাজ হয়নি। মাঝে মাঝে বালু ফেলানো হলেও তা আবার বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়, আবারও গর্ত হয়। এই রাস্তায় চলাচলকারীদের অভিযোগ, লেগুনা বা রিকশায় এই রাস্তায় চলাচল করতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। রাস্তায় গর্তে অনেক সময় রিকশা আটকে দুর্ঘটনা ঘটে। লেগুনায় চলাচল করলে কোমরে ব্যথা হয়। এ ছাড়া মোটরসাইকেলেও চলাচল করা কষ্টকর।
আবদুল্লাপুর-হাউজবিল্ডিং সড়ক যেন মরণফাঁদ : আবদুল্লাপুর থেকে হাউজবিল্ডিং সড়ক দুই পাশের রাস্তায় খানাখন্দ আর বড় বড় গর্ত। বাস-ট্রাকের পাশাপাশি অন্যান্য যান চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। খানাখন্দে পড়ে হঠাৎ বন্ধ হয় সিএনজিসহ অন্যান্য ছোট যানবাহন। তুরাগ বাসের চালক শফি জানান, বিমানবন্দর থেকে আবদুল্লাহপুরের রাস্তার বেহাল দশা। গাড়ি চালানো কঠিন। বিশেষ করে আবদুল্লাহপুর থেকে হাউজবিল্ডিং পর্যন্ত রাস্তায় দুইপাশে বড় বড় গর্ত। গাড়ি চালাতে গেলে দোল খায়। দ্রুত ব্রেক করাও সমস্যা। বৃষ্টি হলে তো রাস্তার গর্ত দেখা যায় না। তখন বেশি কষ্ট হয় গাড়ি চালাতে। সিএনজিচালক আবুল হোসেন বলেন, গত সপ্তাহে এই রাস্তার গর্তে গাড়ি নিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তিন দিন হাতপাতালে থাকতে হয়েছে। আল মামুন প্রতিদিন আবদুল্লাহপুর থেকে গুলশানে অফিস করেন। তিনি এই রাস্তায় মোটরসাইকেলে চলাচল করেন। তার অভিযোগ- আবদুল্লাহপুর থেকে গুলশান অফিসে যেতে সব চেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় আবদুল্লাহপুরে থেকে হাউজবিল্ডিং পর্যন্ত যেতে। এই রাস্তাটুকু পার হতে সময় লাগে অনেক বেশি। কেননা রাস্তায় খানাখন্দে ভরা। বৃষ্টি হলে মোটরসাইকেল চালানো কষ্ট কর হয়। বড় বড় গর্তে আটকে যায় বাইক।
মূল রাস্তায় মৃত্যুফাঁদ ড্রেনের ঢাকনা : মালিবাগ-রামপুরা-বাড্ডা সড়কের মাঝে মাঝে বেশ কয়েকটি ড্রেনের ঢাকনা মূল সড়ক থেকে ৪-৫ ইঞ্চি নিচু। এগুলো দূর থেকে দেখা না যাওয়ায় মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটে। এই গর্তগুলোর কারণে সড়কে যান চলাচলের গতিও অনেক কম। এই সড়কে ডিভাইডার রেলিং না থাকায় যত্রতত্র সড়ক পার হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া সিদ্ধেশ্বরী রোড়ের খেলার মাঠের সামনে ছোট-বড় খানাখন্দ রয়েছে। সুয়ারেজ লাইনের সমস্যার কারণে এই অংশে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে থাকে। এ ছাড়া এই রাস্তার কিছু অংশের উন্নয়ন কাজ কয়েক মাস আগে শুরু হলেও তা এখনো শেষ করা হয়নি। মধ্যবাড্ডা পোস্ট অফিস রোডের প্রায় এক কিলোমিটার সড়কের অবস্থা আরও খারাপ। দীর্ঘদিন থেকে এই সড়কে কোনো সংস্কার করা হয়নি। এই রাস্তার মাঝখানে রয়েছে কয়েকটি গর্ত। এ ছাড়া হাতিরঝিলের গুদারাঘাট থেকে ভারতীয় দূতাবাস যাওয়ার মুখেই বেশ কিছু স্থানে রাস্তার খোয়া উঠে গেছে। মগবাজার ওয়্যারলেস থেকে হাতিরঝিল সড়কে দীর্ঘদিন ধরে চলছে উন্নয়ন কাজ।
সংস্কার শেষই হয় না বনশ্রীর রাস্তাগুলোর : বছরের পর বছর ঘুরলেও শেষ হয় না বনশ্রী এলাকার রাস্তাগুলোর সংস্কার কাজ। প্রধান সড়কগুলো মোটামুটি চলাচলের উপযোগী থাকলেও শাখা সড়কগুলোর বেহাল দশা। সড়কজুড়ে পড়ে আছে ছোট-বড় ইটের খোয়া। অনেক সড়কের বিটুমিন উঠে তৈরি হয়েছে খানাখন্দ, কোথাও বিটুমিনের ওপর দেড়-দুই ইঞ্চি মাটি জমে ঢাকা পড়েছে রাস্তা। স্থানীয়রা জানান, গত এক-দেড় বছর ধরে বিভিন্ন সড়কের সংস্কার কাজ চললেও শেষই হচ্ছে না। করোনা সংক্রমণের পর থেকে চলমান কাজগুলোও বন্ধ আছে। এতে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। সড়কজুড়ে ইটের খোয়া ও পাথরের সুরকি পড়ে থাকায় মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা দক্ষিণ বনশ্রীর। এই এলাকার অধিকাংশ সড়কই ভাঙাচোরা। গতকাল সরেজমিন দক্ষিণ বনশ্রীর জি, এইচ ও কে ব্লক ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ সড়কেই নেই কার্পেটিং। কিছু সড়কে সংস্কার কাজ শুরুর পর এখন থেমে আছে। স্থানীয়রা জানান, মেরাদিয়া বাজার থেকে মাদারটেক যাওয়ার প্রধান সড়কটি গত পাঁচ বছরেও ঠিক হয়নি। দীর্ঘদিন ভোগান্তির পর বছর দুই আগে একবার কার্পেটিং করা হয়েছিল। কিন্তু সরু সুয়ারেজ লাইনের কারণে বৃষ্টি এলেই এলাকা তলিয়ে যেত। কাজ শেষ হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই সড়কের বিভিন্ন জায়গা দেবে যায়। বড় বড় গর্ত তৈরি হয়। এখন আবার বড় সুয়ারেজ লাইনসহ নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। সেটাও চলছে বছরব্যাপী। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর থেকে কাজ বন্ধ আছে।
বিডি প্রতিদিন