হিন্দুত্ববাদীদের অন্তরে লুকায়িত আজন্ম মুসলিম বিদ্বেষ ধীরে ধীরে তীব্র আকার ধারণ করছে। ভারত জুড়ে সর্বত্রই মুসলিমরা হিন্দুত্ববাদীদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছেন।
নামাযকেন্দ্রিক মুসলিম ধার্মিকতার চর্চা জনসমক্ষে দেখতে পাওয়া যাবে ভারতের বিভিন্ন শহর-উপশহর ও গ্রাম-গঞ্জে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের সবুজ মিনারে, ব্যস্ত রাস্তায় মুসলিমদের জমায়েতে এবং আযানের সুললিত উচ্চমধুর স্বরে। এর মধ্যে ভারতজুড়ে বহু মসজিদকে পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে বা নতুন করে কিছু মসজিদ গড়ে উঠেছে।
কিন্তু রাম মন্দির পরবর্তী প্রেক্ষিতে এই নামাযকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিবিদরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
ইদানিং প্রায়ই দেখা যাচ্ছে– স্কুল, কলেজ, রেল স্টেশন, পার্ক বা নির্জন ফাঁকা জায়গায় মুসলিমরা নামায আদায় করতে গেলেই বজরং দল– বিশ্বহিন্দু পরিষদ জাতীয় সংগঠনগুলি তাদের শান্তিপূর্ণ নামাযে হামলা চালাচ্ছে।
নামায পড়ার জন্য মুসলিমদের শান্তিপূর্ণভাবে জড়ো হওয়া জমায়েতকে হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসী গুণ্ডারা ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। এখন বিভিন্ন স্থানে এটি একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে দিল্লির নিকটস্থত গুরুগ্রামে (গুরগাঁও) প্রায় প্রতি জুম্মাবারেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে।
হিন্দুত্ববাদীরা শুধুমাত্র বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে নামাযকে সমস্যা হিসাবে তুলে ধরছে। নামাযকে ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে একটি ধারণা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছে তারা। তবে দুঃখজনক হল, ভারতজুড়ে তাদের এই হিংসাত্মক উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
হিন্দুত্ববাদীদের সেই পুরনো দাবি– মুসলিমরা কেবলমাত্র আল্লাহর উপাসনা করে, দেশের পূজা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাদের আলাদা করে দেশভক্তির প্রমাণ দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত– নামায পাঠ করাকে একটি নতুন ধারণায় পরিচিত করানোর প্রচেষ্টা হচ্ছে। ধারণাটি হল, হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে ও বিপরীতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুসলিমদের এই নামায পাঠ। জামাতবদ্ধভাবে রাস্তায় নামায পড়াকে যাতে এভাবেই দেখা হয়, তার জন্যই মুলত এসব চেষ্টা চলছে। যেন প্রকাশ্যে নামায পড়া অনুমোদনযোগ্যই নয়।
ঠিক এই যুক্তিই উত্তরাখণ্ডেেউগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্বহিন্দু পরিষদ ও বজরং দল দিয়েছে। তারা উত্তরাখণ্ডের ক্যাবিনেট মন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়ে ‘তদন্ত’ দাবি করেছে। অভিযোগ– বদ্রীনাথধামে কিছু মুসলিম শ্রমিক ঈদ-উল-আযহার নামায আদায় করেছিল। এই মামলায়, উঠে আসে সেই প্রাচীন হিন্দুত্ববাদী শুচিতার যুক্তি। হিন্দুদের কথিত পবিত্র এলাকা ও শহরেও নামায পাঠ করা চলবে না। তাতে এলাকার এবং সেখানের মন্দিরের শুচিতা নষ্ট হয়।
হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করছে, আল্লাহর একত্ববাদ তাদের কথিত দেশাত্মবোধের সম্পূর্ণ বিরোধী। নামায হচ্ছে একটি অপবিত্র হিন্দুবিদ্বেষী কাজ এবং নামায নাগরিক এলাকায় জায়গার সংকট তৈরি করছে।
নামায বা সালাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান এই নামাজে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নামাজির সংখ্যা বর্তমান ভারতে এতটাই বেড়েছে যে, মসজিদে জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত বড় শহর ও মফস্বলগুলিতে। ফলস্বরূপ নতুন মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে। আর এটাই হয়তো হিন্দুত্ববাদীদের উদ্বেগ ও জিঘাংসাকে অন্য মাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে।
এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে শ্রমিকদের চলে আসাও এই নামাযকেন্দ্রিক ধার্মিকতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গ্রাম থেকে আসা মুসলিম শ্রমিক– কারিগর– দক্ষ বা আধপটু কর্মীরা শিল্পাঞ্চলের নানা কারখানায় নিযুক্ত হচ্ছে। কিন্তু তাদের যথাযথ কোনও মসজিদ নেই। এই শ্রমজীবী মুসলিমরা ঘটনাচক্রে ফাঁকা জায়গায় বা নির্জন রাস্তায় নামায আদায় করে। কেননা নামায ছহীহ হওয়ার জন্য মসজিদ শর্ত নয়। পুরো পৃথিরীকেই আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের নামাযের জায়গা বানিয়ে দিয়েছেন।
বিশেষ করে শুক্রবারের ২০-৩০ মিনিটের জন্য জুমুয়ার নামাযে বড় জমায়েত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই দৃশ্য ভারতে একটি স্বাভাবিক দৃশ্য হিসাবে দেখা হয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের নামায পড়া নিয়ে সব সময় গাত্রদাহ রয়েছে। তাদের এটা মেনে নিতে অসুবিধা হয়। তারা এটা মানতে নারাজ যে, যে ভারতকে ৬০০ বছর মুসলিমরা শাসন করতে পেরেছে, আজ সেখানে শুধু নামাজ পড়াতা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।
হিন্দুত্ববাদী যুক্তি হল– সমস্ত ভারতীয়ই হিন্দু যদিও, তাদের উপাসনার পদ্ধতির মধ্যে ফারাক রয়েছে। এই যুক্তি থেকে প্রমাণ হয় যে– নামায নিয়ে হিন্দুত্ববাদীদের এই ইচ্ছাপূর্বক অস্বস্তি দূর হবার নয়। মুখে কথিত গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার কথা বললেও, নিজেদের কথিত বাণী অনুযায়ীই মুসলিমদের মেনে নিতে এদের যথেষ্ট অসুবিধা।
এই ইস্যু নিয়ে এতদিন হিন্দুত্ববাদীদের কৌশলী নীরবতার পিছনে ছিল নামাযের প্রতি সাধারণ হিন্দুদের মনোভাব। শুধুমাত্র নামায পড়ার কারণে মুসলিমদের ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে তুলে ধরা যেকোনও হিন্দুত্ববাদী দলের কাছে ছিল কঠিন। কারণ– একজন সাধারণ হিন্দুর কাছে নামায আর পাঁচটা হিন্দু ধর্মীয় আচার আরাধনা মতোই বিবেচ্য হতো।
কিন্তু হিন্দুত্ববাদীদের ছড়ানো ক্রমাগত বিদ্বেষ, প্রোপাগান্ডায় এখন সকল হিন্দুরাই মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। হিন্দুত্ববাদীদের সাথে তাল মিলিয়ে মুসলিমদের নামায়ে বাধা দিচ্ছে সকল শ্রেণী-পেশার হিন্দুরা। মুসলিমদের উপর হামলা চালাতেো এখন তারা কুণ্ঠাবোধ করছেনা।
কেউ জানে না, মুসলিম সম্প্রদায় নামাযের বিরুদ্ধে এই নয়া অপপ্রচারের প্রতিক্রিয়ায় কী করবে। তবে ভারতীয় মুসলিমদের স্মরণ রাখতে হবে, এই সমস্যার জন্য মানবরচিত তন্ত্র মন্ত্রের কথিত সমান অধিকারে আইনি ব্যবস্থার আশ্রয়নিলে কোন লাভ হবে না। হিতে তা বিপরীত ফলই বয়ে আনবে। এর প্রমাণ মুসলিমরা বাবরি মসজিদ মামলার রায়েই পেয়েছে।
তাই এসব সমস্যার সমাধান মুসলিমদেরকে কুরআন-হাদিসেই খুঁজতে হবে বলে মনে করেন ইসলামি চিন্তাবীদগণ ও উলামায়ে হক্কানি-রব্বানি।
লিখেছেন : মাহমুদ উল্লাহ্