হযরত ওমর ফারুক রাযি. এর রাতের টহল

0
1104

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। তিনি প্রজাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ছদ্মবেশে রাতের বেলা মদীনা মুনাওয়ারার অলি-গলিতে টহল দিতেন।

এক রাতে তিনি শুনতে পেলেন একটি বাড়ি থেকে গানের আওয়াজ আসছে, সেই সঙ্গে কিছু গ্লাস নড়াচড়ার শব্দও। ভাবলেন এ বাড়িতে হয়তো সুরা পানের আসর চলছে, সঙ্গে গান বাজনাও হচ্ছে। কিছুক্ষণ তো তিনি সব শুনতে থাকলেন।

তারপর দেওয়াল টপকে ভেতরে ঢুকলেন। দেখলেন ঠিকই সুরাপান চলছে এবং গানবাজনাও হচ্ছে। তিনি তাদের হাতেনাতে ধরে ফেলেন। জলসার কর্তা ব্যক্তিটি ছিলো চতুর। সে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি আমাদের গ্রেপ্তার করলেন কেন?

হযরত ওমর ফারুক রাযি. বললেন, তোমরা মদ্যপান করছিলে এবং গান বাজনায়ও লিপ্ত ছিলে; সেই অপরাধে তোমাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লোকটি বললো, আমরা তো একটা অপরাধই করছিলাম, আপনি যে কয়েকটা অপরাধ করলেন?

তিনি বললেন, সেগুলো কী?
সে বললো, একটি অপরাধ তো এই করেছেন যে, আপনি গোয়েন্দগিরি করেছেন, আমাদের দোষ খুঁজে বেড়িয়েছেন, ভেতরে কী হচ্ছে তা অনুসন্ধান করেছেন। এটা গুনাহের কাজ।

দ্বিতীয় অপরাধ করেছেন অনুমতি ছাড়া ভেতরে ঢুকেছেন। কারও ঘরে বিনা অনুমতিতে ঢোকা জায়েয নেই।

তৃতীয় গোনাহ এই করেছেন যে, আপনি দেওয়াল টপকে ভিতরে প্রবেশ করেছেন। অথচ কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-

وَأتُوا الْبُيُوتَ مِنْ أَبْوَابِهَا

‘তোমরা ঘরে ঢুকবে তার দরজা দিয়ে। ’

এভাবে আপনি তিন তিনটি অপরাধ করেছেন, আমরা তো করেছিলাম মাত্র একটি।

হযরত ওমর ফারূক রাযি. তার কথা শুনে এসব অপরাধের জন্যে ইস্তিগফার করলেন যে, হয়তো আমার দ্বারা বাস্তবেই এ সব গোনাহ হয়েছে। তাই আমি আল্লাহ তা’আলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

আমাদের মতো সাধারণ কেউ হলে হয়তো তাকে আঘাত করে বলতো, হতভাগা! একে তো অপরাধ করছো, আবার আমার উপর আপত্তি? চুরির উপর শিনাজুরি? কিন্তু তিনি আর আমাদের মত সাধারণ কেউ ছিলেন না। আল্লাহর রাসূলের সোহবতে থেকে নিজের নফসেরও চিকিৎসা করেছেন।

অর্ধ পৃথিবীর ক্ষমতাসীন শাসক হওয়া সত্তেও তিনি চিন্তা করলেন, অভিযোগ যেহেতু আমার নিজের সম্পর্কে, তাই রদ না করে বরং তার প্রতিকার করা উচিত। সুতরাং তিনি সঙ্গে সঙ্গে ইস্তিগফার করলেন।

অতঃপর হযরত ওমর রাযি. বিষয়টা সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে তুলে ধরে বললেন, লোকটি আমাকে এই এই কথা বলেছে। আমি নাকি তিনটি গোনাহ করেছি। তা বাস্তবিকই কি আমি গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ করেছি।
এভাবে অনুসন্ধান চালানোতে কি আমি ছিদ্রান্বেষণের গোনাহ করে ফেলেছি? দেওয়াল টপকে ঘরের ভেতর ঢোকা কি আমার জন্যে নাজায়েয ছিলো?

সাহাবায়ে কেরামের সে মজলিস আলোচনা-পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত দিলো, কোনো কর্মকাণ্ড সম্পর্কে যদি এই আশঙ্কা দেখা দেয় যে, তা জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে এবং সমাজে তার কুফল ছড়িয়ে পড়তে পারে, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্যে তাতে নজরদারি করা এবং বিনা অনুমতিতে ঘরে প্রবেশ করা, এমনকি দেওয়াল টপকে হলেও সেখানে প্রবেশ করা জায়েয হবে।

কিন্তু অপরাধটি যদি একান্তই ব্যক্তিগত হয় এবং তা দ্বারা সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, তবে এরূপ গুপ্তচরগিরি জায়েয হবে না। যেমন কোনো লোক নিজ গৃহে গোপনে কোনো অপরাধ করছে, যার ক্ষতি কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, সমাজে সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা নেই, এক্ষেত্রে সরকারি নজরদারি জায়েয নেই।

এ ব্যাপারে বিজ্ঞ ফকীহগণ বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কোন কোন অবস্থায় গুপ্তচর ভিত্তি জায়েজ এবং কোন কোন অবস্থায় জায়েজ নয় তার বিশদ ব্যাখ্যা ও তারা প্রদান করেছেন।



ঘটনার শিক্ষা:
১. কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা যাচাই বাছাই ছাড়া রদ না করে প্রতিকার করার ফিকির করা। এক্ষেত্রে নিজের পদমর্যাদা, ক্ষমতা কিংবা অহমিকার বশবর্তী হয়ে কোন হটকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়া।
২. শাসক হলে প্রজাদের খোঁজ খবর নেওয়া।
৩. শাসক শাসন কাজ চালাতে গিয়ে কোন সমস্যার সম্মুখিন হলে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের পরামর্শ নেওয়া।



লিখেছেন : উসামা মাহমুদ



তথ্যসূত্র:
১. নির্বাচিত রচনা ও বয়ান সমগ্র: মুসলিম মনীষীগণের শিক্ষনীয় ঘটনাবলী- ১৫/৩৮
মূল: শায়খুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মদ তাকী উসমানী
অনুবাদ: মাওলানা মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন
২. সূরা বাকারা ১৮৯
৩. কানযুল উম্মাল, ২ / ১৬৯

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধজায়নবাদী আগ্রাসন || এক মাসে ৩৫ ফিলিস্তিনিকে খুন
পরবর্তী নিবন্ধউগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতার দাম্ভিক স্বীকারোক্তি: ‘মুহাম্মদ ফাসিলকে আমরাই হত্যা করেছি’