ইসরায়েলকে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলায় যুক্তরাজ্যের এমপি’র ক্ষমাপ্রার্থনাঃ ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণ কতোদূর পৌঁছেছে?

0
955

ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লেবার পার্টির এক সদস্য ইসরায়েলকে “বর্ণবাদী রাষ্ট্র” এবং নবনির্বাচিত ইসরায়েলি সরকারকে “ফ্যাসিবাদী” বলার জন্য গত ১ ফেব্রুয়ারি বুধবার ক্ষমা চেয়েছে। তার দল লেবার পার্টি এর কিছু সময় পূর্বেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘সত্য’ বলে দেওয়ার কারণে প্রকাশ্যে তার নিন্দা করেছিল।

কিম জনসন নামক ঐ সদস্য তার মন্তব্যে বলেছিল, “গত বছরের ডিসেম্বরে ফ্যাসিবাদী ইসরায়েলি সরকারের নির্বাচনের পর থেকে শিশু সহ ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে গেছে।”
তখন সে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাককে প্রশ্ন করেছিল, “তাহলে, প্রধানমন্ত্রী কি আমাদের বলতে পারেন যে অ্যামনেস্টি এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলি ‘একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ হিসাবে উল্লেখ করাকে তিনি কীভাবে চ্যালেঞ্জ করছেন?”

২০১৫ সাল থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক মাস হয়ে উঠা জানুয়ারিতে ইসরায়েলি বাহিনী এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইহুদিদের হাতে মোট ৩৫ জন ফিলিস্তিনি মুসলিম নিহত হয়েছেন। আর ইসরায়েলের নতুন অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ নিজেকে “ফ্যাসিস্ট হোমোফোব” হিসাবে বর্ণনা করেছে।

তবে জনসনের এই বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী সুনাক এবং অন্যান্যদের প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়।

জনসনের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছিল যে, জনসন “ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বেসামরিক নাগরিকদের উপর ভয়াবহ হামলার কথা উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এই বিষয়ে শান্ত থাকা এবং শান্তির জন্য সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো গুরুত্বপূর্ণ।”

আবার জনসন প্রশ্ন উত্থাপন করার পর একজন লেবার মুখপাত্র বলেছে, “জনসনের মন্তব্য সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযোগ্য… লেবার পার্টি ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ককে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে দেখে, এবং লেবার পার্টির এক নেতা কেয়ার স্টারমার এই সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”

আশ্চর্যজনকভাবে এর ঠিক কয়েক ঘন্টা পরেই, জনসন হাউস অফ কমন্সে একটি পয়েন্ট অফ অর্ডারে তার সেই প্রশ্ন ও মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেয়। সে এই বলে ক্ষমাও চায় যে, “আমি প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রশ্নোত্তরের সময় যে ‘অসংযত’ ভাষার ব্যবহার করেছি তার জন্য আমি অসংযতভাবেই ক্ষমা চাইতে চাই।…আমি ইসরাইল সরকার সম্পর্কে ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করে ভুল করেছি এবং বুঝতে পেরেছি যে, কেন এটি ইসরায়েল রাষ্ট্রের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই শব্দগুলো ব্যবহার করা বিশেষভাবে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।…এবং যদিও ইসরাইল সরকারের মধ্যে অনেক ডানপন্থী উপাদান রয়েছে, তথাপি আমি স্বীকার করছি যে সরকার প্রসঙ্গে এই শব্দটি ব্যবহার করা ভুল ছিল। আমি ‘বর্ণবাদী রাষ্ট্র’ শব্দটি ব্যবহারের জন্যও ক্ষমা চাই। যদিও তখন আমি অ্যামনেস্টির উদ্ধৃতিই শুধু হুবহু তুলে ধরেছিলাম, তবে আমি এখন এই শব্দের ব্যবহারকে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করছি এবং আমি এটি প্রত্যাহার করে নিচ্ছি।”

উল্লেখ্য, অ্যামনেস্টি ইউকে এক বিবৃতিতে বলেছিল, “নেতৃস্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এবং ক্রমবর্ধমান সংখ্যক দেশ স্বীকার করেছে যে ইসরায়েল এমন একটি ব্যবস্থা পরিচালনা করছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বর্ণবৈষম্যের অপরাধের শামিল। অ্যামনেস্টি ইউকে আরও বলেছে, “যদিও ধারাবাহিকভাবে যুক্তরাজ্যের সরকারগুলো ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি উভয় বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার যথাযথ নিন্দা করেছে, যুক্তরাজ্য ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে তাদের গুরুতর এবং পদ্ধতিগতভাবে কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করতে ব্যর্থ হয়েছে।”

ইহুদি প্রভাব কতদূর

জনসন লিভারপুল রিভারসাইডের লেবার পার্টির এমপি এবং ২০১৯ সালে শহরের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলে। পার্লামেন্টে প্রবেশের আগে জনসন ট্রেড ইউনিয়নবাদী ছিলেন এবং এখন লেবার সোশ্যালিস্ট ক্যাম্পেইন গ্রুপের সদস্য।

এখন বাস্তবতা হচ্ছে, তার মতো এতো প্রভাবশালী একজন নারী কথিত ‘বাকস্বাধীনতা’র তীর্থভূমি যুক্তরাজ্যে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আংশিক সত্য বলেও স্থির থাকতে পারেনি। আর কথাগুলো তো তার নিজেরও ছিল না, বরং সে অ্যামনেস্টি ইউকে’র একটি বিবৃতি থেকে কোট করে কথাগুলো বলেছিল। আর কথাগুলো বলার কয়েক ঘণ্টা পরেই তাকে তার কথা প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে হলো।
জেরুজালেম পোস্ট বলছে যে, তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়েছে।

শুধু এই একটি ঘটনাই নয়, এর আগে ২০২০ সালে ইসরাইলকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলার কারণে এবং জায়নিজমকে একটি “বিপদজনক জাতীয়তাবাদী ধারণা” বলার কারণে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়েছিল লেবার পার্টিরই সংসদ সদস্য লয়েড রাসেল। সে লেবার পার্টির ছায়া পরিবেশ মন্ত্রী হয়েও ইসরাইলের বিরুদ্ধে সত্য বলার অপরাধে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। অথচ সে তার এই মন্তব্য করেছিল ২০১৭ সালে সাংসদ নিরবাচিত হওয়ার অনেক আগে।

তাহলে কি এটাই প্রমাণিত হয় না যে, ‘অ্যামেরিকা ও যুক্তরাজ্যের মতো ক্ষমতাশালী দেশগুলোর রাজনীতি ইহুদিবাদী ইসরাইল নিয়ন্ত্রণ করে’ বলে যে কথা প্রচলিত আছে, সেটাই আসলে বাস্তব সত্যি! আর ইহুদি নিয়ন্ত্রিত এই বিশ্বব্যবস্থায় মুসলিমরাই সর্বত্র নির্যাতন-নিপিড়নের শিকার হবে, এটাও এখন একটা রুটিনমাফিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আর এখানে নিজেদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার বিকল্প কোন পথ মুসলিমদের সামনে আছে বলেও প্রতীয়মান হয় না।

লিখার শেষাংশে কিছুটা ভিন্ন একটি বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টিপাত করা জরুরী মনে করছি; কেননা ইহুদি নিয়ন্ত্রণ এখন শুধু পশ্চিমা বিশ্বে সীমাবদ্ধ নেই, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে এই বিষাক্ত প্রভাব।

‘Friends of Zion’ (জায়নবাদের বন্ধু) সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মাইক ইভানস একটি সেমিনারে প্রকাশ্যে বলেছে যে, সে আরব আমিরাতের এমবিজেড এবং সৌদির এমবিএস- এদের সাথে কথা বলে দেখেছে যে, তারা অন্য অনেক ইহুদির চেয়ে বেশি মাত্রায় ইসরাইল সমর্থক।

তার ভাষায়, “আমি আমিরাতে এমবিজেডের সাথে দেখা করেছি, আমি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স এমবিএসের সাথে দেখা করেছি। এবং আমি আপনাদেরকে অবাক করা একটি বিষয় বলতে যাচ্ছি, এই নেতারা অনেক ইহুদের থেকে বেশি মাত্রায় ইসরাইল সমর্থক।”

“যখন আমি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের সাথে দেখা করলাম, আমি তাকে বললাম, ‘ইহুদিদের ব্যপারে আপনার ধারণা কি? আর খ্রিস্টানদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?’ সে বললো,’হ্যাঁ, আমি উভয়কেই পছন্দ করি।’
আমি জিজ্ঞেশ করলাম, ‘’কেন?’ সে বললো, ‘কারণ আমার মা একজন ইহুদি’।”

“আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি কি বলছেন?’
সে বললো, ‘আমার বাবার গৃহপরিচারিকা, যে আমাকে লালন-পালন করে বড় করেছে, সে ছিল একজন ইথিওপিয়ান ইহুদি-ইভেঞ্জেলিকাল।’”

“এখন আমি আপনাদেরকে আড়াই ঘণ্টা ধরে বলতে পারি যে, আমি ক্রাউনপ্রিন্সের কাছ থেকে ইসরাইল সম্পর্কে যা সুনলাম, যা এতই চমকপ্রদ ছিল যে, সেটা আমি হোয়াইট হাউজ এবং প্রধানমন্ত্রীকে (ইসরাইলের) জানিয়েছিলাম। আর এই কথাটা অবশ্যই আপনার হৃদয়কে হতবাক করে দিবে।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফিলিস্তিনিরা এখন কি করতে পারে?’

সে বললো, ‘ও, এটা খুবই সাধারণ বিষয়। তাদের উচিৎ ইসরাইলকে অনুসরণ করা। এটাই সমাধান’!”

তাই এমবিএস বা এমবিজেডরা যে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, কিংবা তাদের নির্দেশে নামধারী শায়েখরা যে ইহুদিদের সাথে ভাল আচরণ করার সবক দিবে, কিংবা ইয়েমেন-সিরিয়া ও আফ্রিকায় মুসলিমদের উপর তারা টনকে টন বোমা ফেলবে, কিংবা উইঘুর-কাশ্মীর-ভারত ও আরাকানে মুসলিম হত্যাযজ্ঞ দেখেও না দেখার ভান করবে, সেটাও স্বাভাবিক নয় কি?

এবার আপনাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই পাকিস্তানের দিকে।

বর্তমানে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ইমরান খান কিছুদিন আগে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আবার তারও আগে গত বছর তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন।

আমরা একটু ভাল করে খেয়াল করলে দেখতে পাই যে, ইমরান খান যদি ঐ সময় অপসারিত না হতেন, তাহলে আজকের পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্পূর্ণ দায়ভার কিন্তু তার উপরেই গিয়ে পরতো। তবে ‘সৌভাগ্যবশত’ তার আগেই তিনি অপসারিত হয়েছেন। গুলিতে আহত হওয়ার পর তার জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। আবার বর্তমান ক্ষমতাসীন অজনপ্রিয় শাহবাজ নেতৃত্বাধিন সরকার কিন্তু পাকিস্তানের আর্থিক বিপর্যয়ের জন্য ইমরান সরকারের লাগামহীন খরচ ও ভর্তুকিকেই দায়ি করছে। তবে অজনপ্রিয় হওয়ায় শাহবাজের দাবি ধোপে টিকছে না।

এদিকে ইমরান খান আবার রাশিয়া সফর করে এসে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সফল ভাবেই পাকিস্তানিদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই সার্বিক ঘটনাপ্রবাহ ইমরান খানের জনপ্রিয়তা এতটাই তুঙ্গে নিয়ে গেছে যে, বিশ্লেষকরা এখন অকাট্যভাবে দাবি করছেন যে, পাকিস্তানের পরবর্তী নির্বাচনে ইমরান খান নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে।

এখন, কেন হঠাৎ পাকিস্তান ও ইমরান খানের প্রসঙ্গ এসেছে!
ইমরান খানের সাবেক স্ত্রী, ব্রিটিশ ইহুদি জেমাইমা গোল্ডস্মিথ, তিনিই বর্তমানে ইমরানের সন্তানদের লালন-পালন করছেন। জেমাইমার পিতা উইলিয়াম গোল্ডস্মিথ ব্রিটেনের সেরা ধনকুবেরদের মধ্যে একজন, ব্রিটিশ রাজনীতির উপরে যার রয়েছে ব্যাপক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ।

বোদ্ধা মহলে একথা প্রচলিত আছে যে, ইমরান-জেমাইমার বিচ্ছেদ নাকি গোল্ডস্মিথ নিজে করিয়েছেন পাকিস্তানের মতো দেশে ইমরানের রাজনৈতিক কেরিয়ার বিবেচনা করে। আবার বিচ্ছেদের সময় ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী জেমাইমার সম্পত্তির অর্ধেক ইমরানের পাওয়ার কথা ছিল, যা ইমরান ফিরিয়ে দেয়।

ইমরান-জেমাইমার দুই ছেলে সোলায়মান ইসা খান এবং কাসিম খান ইহুদি মাতা জেমাইমা গোল্ডস্মিথের তত্ত্বাবধানেই বেড়ে উঠেছে, ঠিক এমবিএসের মতোই। ইমরানের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাদের পদার্পণের ক্ষেত্র ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে বলে কথিত আছে।

এখান থেকে বাকি হিসেব পাঠকবৃন্দ নিজের মতো করে মিলিয়ে নিতে পারেন ইনশাআল্লাহ্‌।

আমাদের বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের পরবর্তী প্রজন্মের একটা অংশও কিন্তু আধা-খ্রিস্টান বা আধা-ইহুদি হয়ে বেড়ে উঠছে! এবিষয়টিও সচেতন মুসলিম মাত্রই দৃষ্টিগোচর হওয়া উচিৎ।



লেখক : আব্দুল্লাহ বিন নজর



 

তথ্যসূত্র:
1. UK Labour MP apologises for calling Israel ‘fascist’ during Prime Minister’s Questions
https://tinyurl.com/yck6dmdc
2. Kim Johnson: Labour MP apologises for calling Israeli government ‘fascist’
https://tinyurl.com/4cyy29e8
3. British Labour MP forced to apologize for calling Israel a terrorist state
https://tinyurl.com/29v9adf2
4. ‘MBS: Palestinians need to copy Israel’
https://tinyurl.com/yc8pxwmd
5. Family of Imran Khan
https://en.wikipedia.org/wiki/Family_of_Imran_Khan

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধহামা গণহত্যা: মুসলিম ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়
পরবর্তী নিবন্ধবুরকিনান বাহিনীতে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের অতর্কিত হামলা: নিহত ২৬ শত্রু সেনা