
৬০১ কোটি টাকার প্রকল্প। ১০ ভবনে নির্মিত হয়েছে ৭৩৬ আবাসিক ফ্ল্যাট। সময় পাঁচ বছরও গড়ায়নি, এরই মধ্যে ফ্ল্যাটগুলোতে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কারণ, ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে এসব ফ্ল্যাট। কোনো ভবনে ফাটল ধরেছে, টোকা দিলেই খসে পড়ছে প্লাস্টার। কোথাও আবার বৃষ্টি হলেই ছাদ চুইয়ে পড়ে পানি। স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়েছে বাথরুম ও রান্নাঘরের দেয়াল। ফ্ল্যাটের বেসিন খুলে পড়ছে, ক্ষয়ে পড়ছে টয়লেটের পাইপও। এমন বেহাল চিত্র রাজধানীর মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পের।
সরকারি পূর্ত কার্যক্রমে সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের অন্যতম উদাহরণ এই প্রকল্প। সংশ্লিষ্টরা বলেছে, মূলত মানহীন নির্মাণ উপকরণের ব্যবহার এবং ঠিকাদারের দায়সারা কাজের কারণেই পাঁচ বছর না পেরোতেই বসবাসের উপযোগিতা হারাচ্ছে প্রকল্পের ফ্ল্যাটগুলো।
প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে ভবনগুলো। দুর্নীতির দায়ে বর্তমানে কারাবন্দী ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ও তার সহযোগীরা ভবনগুলো তৈরি করেছে।
সম্প্রতি সরেজমিন প্রকল্প এলাকায় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৭৩৬টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ’ প্রকল্পের প্রধান গেটের নামফলক ভাঙা।
গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে নিরাপত্তাপ্রহরীর কক্ষ, তার সামনে মসজিদ, মসজিদের পরেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু ভবন। ভবনের আশপাশের স্থানগুলো অপরিষ্কার। ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো খোলা, রাস্তাগুলো স্যাঁতসেঁতে। ওই আবাসন প্রকল্পের ভেতরে দুটি খেলার মাঠ থাকলেও দুটির কোনোটিতে নেই স্টিলের বাউন্ডারির তারের জয়েন্ট। নষ্ট অবস্থায় পড়ে আছে লাইটগুলো।
প্রকল্পের ১ নম্বর ভবনে ঢুকতেই চোখে পড়ে ভবনের নিচতলার সামনের টাইলসগুলো ভাঙা, ওয়াল থেকে খসে পড়েছে প্লাস্টার, ভবনের বিভিন্ন জায়গায় ফাটল ধরেছে। পরিচয় দিয়ে সামনে এগোতেই নিরাপত্তাপ্রহরী বাধা দেন। তবে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভবনের কয়েকজন বাসিন্দা তাঁদের কয়েকটি ফ্ল্যাট ঘুরিয়ে দেখান। সেই ফ্ল্যাটগুলোর ভেতরে কোথাও শয়নকক্ষের দেয়াল ড্যাম্প, কোথাও বাথরুমের টাইলস খুলে পড়েছে। এক নম্বর ভবনের মতোই অবস্থা ২ ও ৩ নম্বর ভবনের বিভিন্ন ফ্ল্যাটের।
জানতে চাইলে ৩ নম্বর ভবনের তত্ত্বাবধায়ক কাজী ইমরান গণমাধ্যমকে বলে, এই ভবনের অধিকাংশ বাসিন্দা এনএসআই কর্মকর্তা। ভবনের নির্মাণকাজ এত বাজে হয়েছে যে দেয়ালে একটু আঘাত করলেই প্লাস্টার খসে পড়ছে। দরজার লকগুলো খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। ৮০ শতাংশ লাইটই নষ্ট। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ১১ তলার একটি ফ্ল্যাটের বেডরুমে প্লাস্টার খুলে পড়েছে। বাথরুম ও কিচেনের অবস্থা আরও খারাপ। এখানে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তা খালি চোখেই বোঝা যায়।’
একই চিত্র দেখা গেছে ৯ নম্বর ভবনেও। ভবনটির কয়েকটি ফ্লোরের রান্নাঘরের টাইলস খুলে গেছে। বেডরুমের দেয়াল পুরো ভিজে ড্যাম্প হয়ে গেছে।
এই প্রকল্পের ভবনগুলোর বাহ্যিক নকশা ও অবকাঠামো দৃষ্টিনন্দন হলেও অভ্যন্তরীণ গুণগত মানে কিছু ঘাটতি রয়েছে বলে উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে। গত জুলাই মাসের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের ২৫ শতাংশ ফ্ল্যাটের বাথরুমের দেয়ালে ড্যাম্প, ১০ শতাংশের টাইলস খুলে পড়েছে এবং ২০ শতাংশের বেড ও ড্রয়িংরুমে প্লাস্টার খসে পড়ছে। এতে আরও বলা হয়, ভবনের লিফট ও ওয়াটার পাম্প অকার্যকর, ইন্টারকম ও সিসিটিভি ক্যামেরা অপ্রতুল এবং অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ইন্টারকম সুবিধা ৭০ শতাংশ ভবনেই নেই। যেসব ভবনে আছে সেখানেও তা কার্যকর নয়। সব ভবনেই সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। তবে ৩ ও ১০ নম্বর ভবন ছাড়া সব ভবনের সিসি ক্যামেরা অকার্যকর। জেনারেটর সুবিধা বিদ্যমান থাকলেও ৭০ শতাংশ ভবনে তা অটোমেটিক চালু হয় না।
প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী, ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকায় দুটি জিপ গাড়ি ও তিনটি মোটরসাইকেল কেনা হয়েছিল প্রকল্পের জন্য। অথচ এই যানবাহনগুলোর কোনো হদিস নেই।
তথ্যসূত্র:
১. ৬০১ কোটির প্রকল্প ৪ বছরে বেহাল
– https://tinyurl.com/395br6xm


