বাজারে দফায় দফায় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে। তেল আমদানি ও বাজারজাতকারী শীর্ষস্থানীয় একটি কোম্পানি গত সপ্তাহে এক লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) নির্ধারণ করেছে ১৪০ টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে বিপণনকারী।
শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল নয়, খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দামও ব্যাপক চড়া। চারজনের একটি পরিবারে মাসে পাঁচ লিটারের মতো তেল লাগে। ফলে একটি পরিবারে ছয় মাস আগের তুলনায় এখন মাসে তেলবাবদ খরচ ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা বেশি। বাজারে এখন চালের দাম চড়া। গত সপ্তাহে পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, মসুর ডাল ও অ্যাংকর ডালের দাম কিছুটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিপাকে সাধারণ মানুষ।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, ‘দারিদ্র্য নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, করোনায় আয় কমে যাওয়া মানুষ খাওয়ার অন্যান্য খরচ কমিয়ে শুধু কয়েকটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে বাজার ব্যয় সীমিত করে এনেছে। চাল ও ভোজ্যতেল তাদের খাদ্যতালিকার সবচেয়ে জরুরি পণ্যের মধ্যে থাকে। দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের কষ্ট আরও বাড়বে।’
এটাই কি সর্বোচ্চ দর
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এর আগে ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ দাম ছিল ২০১২ সালের মাঝামাঝিতে। ওই বছর বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি মেট্রিক টন ১ হাজার ৪০০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। তখন আমদানি কম হওয়ায় বাজারে তেলের ঘাটতিও তৈরি হয়েছিল।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১৩৩ টাকা ৫০ পয়সা। দুটি কোম্পানির দুজন কর্মকর্তা ও একজন পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, তখন (২০১২ সালে) বোতলজাত সয়াবিন তেলের এক লিটারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩৫ টাকা। এখন সর্বোচ্চ দাম ১৪০ টাকায় নির্ধারণ করার মধ্য দিয়ে আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেল। একটি কোম্পানির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ভোজ্যতেল খাতে তাঁর ২৫ বছরের চাকরিজীবনে বোতলজাত তেলের এত দাম দেখেননি।
এক বছরে ১৯-২৬% বেড়েছে
করোনাকালে গত মে মাসে শীর্ষস্থানীয় দুই ভোজ্যতেল কোম্পানি মেঘনা ও সিটি গ্রুপ সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমিয়ে ১০৫ টাকা নির্ধারণ করে। এই দাম মোটামুটি আগস্ট পর্যন্ত একই ছিল। এরপর থেকে বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড তাদের রূপচাঁদা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেলের দাম সর্বশেষ বাড়িয়েছে গত ২৪ জানুয়ারি। ওই দিনের তারিখ দিয়ে ১৪০ টাকা লিটারের তেল বাজারে ছাড়া হয়েছে।
বাজারে ফ্রেশ ও তীর ব্র্যান্ডের এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতলের এমআরপি এখন ১৩৫ টাকা এবং পুষ্টি ও বসুন্ধরা ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে তা ১৩০ টাকা। পাঁচ লিটারের বোতলের ক্ষেত্রে রূপচাঁদার তেলের ৬৮৫, ফ্রেশ, তীর ও পুষ্টির ৬৫৫ এবং বসুন্ধরার ৬৫০ টাকা এমআরপি নির্ধারণ করা হয়েছে। বড় বাজারে ব্যবসায়ীরা এমআরপির চেয়ে দাম কিছুটা কমিয়ে বিক্রি করেন। তবে সুপারশপে বোতলের মোড়কে লেখা মূল্য অনুযায়ী তেল বিক্রি করতে দেখা যায়।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বলছে, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৯ থেকে ২৬ শতাংশ বেশি।
বিশ্ববাজারে দাম বাড়রেও সরকার কর কম নিচ্ছে না। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ভোজ্যতেলের ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) এক স্তরের বদলে তিন স্তরে আরোপ শুরু হয়। সব মিলিয়ে যে করকাঠামো, তাতে এক লিটার তেলে প্রায় ২৫ টাকা করবাবদ পায় সরকার। বর্তমান কাঠামোয় বিশ্ববাজারে দাম যত বাড়ে, ভোজ্যতেলের ওপর ভ্যাটের পরিমাণও বাড়ে।
দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ তেল আমদানি করতে হয়। কোম্পানিগুলো অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করার পর পরিশোধন করে তা বাজারজাত করে।
পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী গোলাম মাওলা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে ছয়টি মিল ভোজ্যতেল সরবরাহ করে। এখন তিনটি দিতে পারছে না। তাই সরকারের উচিত আগামী রমজান মাস মাথায় রেখে বাজারে তেলের সরবরাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া। তিনি বলেন, এখন বড় উদ্যোগ নিতে হবে। দেরি করা যাবে না।