আফ্রিকায় বিশেষ করে পশ্চিম আফ্রিকায় আল-কায়েদা মুজাহিদদের উত্থানের ফলে দিন দিন সেখানে কর্তৃত্ব হারাচ্ছে দখলদার ফ্রান্স। আফ্রিকায় মুজাহিদদের এই উত্থান ও ক্রুসেডার ফ্রান্সের কর্তৃত্ব হারানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পূর্বে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদদের আফ্রিকা দখলের লড়াই নিয়ে সামান্য আলোচনা করা দরকার।

ক্রুসেডার ফ্রান্স কর্তৃক আফ্রিকা দখল:

ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের শতবছর পর ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররা নতুন বাজার খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠে। তখন তাদের চোখ পড়ে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোতে। ১৮৮৪-১৮৮৫ সালে বার্লিন সম্মেলন করে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে আফ্রিকা দখলের লড়াই শুরু করে ইউরোপিয়ান ক্রুসেডাররা। ১৯১২ সালের মধ্যে ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া ছাড়া পুরো আফ্রিকা দখল করে নেয় ইউরোপের সাতটি দেশ। তাদের নেতৃত্বে ছিল ক্রুসেডার ফ্রান্স। এছাড়াও ছিল— ব্রিটেন, পর্তুগাল, জার্মানি, স্পেন ও বেলজিয়াম। সময়ের পরিক্রমায় আফ্রিকার সচেতন মুসলিম জনসাধারণের তীব্র আন্দোলন ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের ফলে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষভাগে বেশিরভাগ দেশ ক্রুসেডারদের দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু এর জন্য আফ্রিকান মুসলিমদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মূল্য দিতে হয়েছিল।

কিন্তু ক্রুসেডার ফ্রান্সের দখল করা ২৪ দেশের মধ্যে ১৪ দেশে এখনো চলছে ফ্রান্সের শোষণ। টোগো, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, আইভরিকোস্ট, মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো (ব্রাজাভিলা), নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবনসহ ১৪ দেশকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সফ্রিকা বা ফ্রাংক জোন। ক্রুসেডার ফ্রান্স এসব দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোনিয়াম, স্বর্ণ, জ্বালানি, কফির উপর যেমনিভাবে একচেটিয়া দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে বিনিয়োগের উপরও রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। ফ্রাংক মুদ্রা ব্যবহারকারী ১৪টি দেশের জল বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পরিবহন, ব্যাংক, কৃষি, নির্মাণ শিল্প—সবই ক্রুসেডার ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে।

এসব দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই এখনো জমা রাখতে হয় ক্রুসেডার ফ্রান্সের কাছে। আর তাদের আয়ের প্রায় ২০ শতাংশই ব্যয় করতে হয় ফ্রান্সের নানা দেনা মেটাতে। দেশ চালাতে অর্থের প্রয়োজন হলে তাদের অর্থই ফ্রান্সের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। এই ১৪টি দেশকে ব্যবহার করতে হয় ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ফ্রাংক। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ফ্রান্সের মুদ্রা দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে জোরপূর্বক ট্রেজারিতে সম্পদ রাখা ও ফ্রাংক ব্যবহার করার চুক্তি করিয়ে নেয় ক্রুসেডার ফ্রান্স। আর এসব পরিকল্পনার মূলহোতা ছিল তৎকালীন (১৯৫৯-১৯৬৯) ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ‘দ্য গল’। তারপর সে তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী বন্ধু ‘জ্যাক ফোকার্ট’-কে দিয়ে আফ্রিকায় ‘ফ্রান্সফ্রিকা’ নামে একটি নেটওয়ার্ক দাঁড় করায়। এই নেটওয়ার্কের কাজ ছিল আফ্রিকা জুড়ে ক্যু, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও কারচুপির নির্বাচন জারি রাখা এবং মুসলিমদের উত্থানকে দমিয়ে রাখা।

ফ্রান্সের স্বার্থ বিরোধীদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ:

IMG-20210423-173141

এ বিষয়ে আমরা বেশি দূরে না গিয়ে সাম্প্রতিক কালেরই কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ২০১৯ ও ২০২০ সালে মালি সরকার বাধ্য হয়ে আল-কায়েদার সাথে কয়েকবার বৈঠকে বসতে এবং একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায়। এসবের উদ্দেশ্য ছিল আল-কায়েদা যেন যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু দখলদার শক্তির উৎখাত এবং ইসলাম প্রতিষ্ঠার পবিত্র দায়িত্ব বাস্তবায়নে যে যুদ্ধ আল-কায়েদার মুজাহিদিন শুরু করেছেন, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের পূর্বেই সেই যুদ্ধ কীভাবে বন্ধ করে দেবেন? তাই আল-কায়েদা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হননি। বরং তারা মালি সরকারের সাথে এই শর্তে বৈঠক করতে রাজি হন যে, মালি থেকে দখলদার ফ্রান্সের সৈন্যদের হটাতে হবে এবং এখানে একটি ইসলামি সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। এই বিষয়টি নিয়ে যখন মালি সরকার ফ্রান্সের সাথে আলোচনা করে তখনই ফ্রান্স মালি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চক্রান্ত শুরু করে। মনে করা হয়, সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেটি ২০২০ সালের শেষ দিকে বাস্তবায়নও করেছে ক্রুসেডার ফ্রান্স। অবশ্য মালি সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও জুলুমের কারণে অতিষ্ঠ ছিলেন দেশটির জনগণও। যার ফলে তারাও বিভিন্ন সময় সরকার হটানোর আন্দোলন করেছিলেন।

এমনিভাবে চীন ঘেঁষা আইভেরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট ‘লঁরা বেগবো’ একটি সেতু গড়তে চেয়েছিল। এই সেতু নির্মাণে ফরাসি একটি সংস্থা মার্কিন ডলারে একটি দাম হাঁকে। কিন্তু তার অর্ধেক দাম হাঁকে চীনা প্রতিষ্ঠান। তারা অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছিল আইভরি কোস্টের প্রাকৃতিক সম্পদ কোকো বিন দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঁরা বেগবোকেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়।

এর আগে সিলভানাস অলিম্পিতে ১৯৬৩ সালে টোগোতে নিজস্ব মুদ্রা চালুর লক্ষ্যে জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরের দিনই ফ্রান্সের প্রশিক্ষিত স্বদেশীয় দালালরা তাকে হত্যা করে। ১৯৬৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত ফ্রান্সফ্রিকার ১৪ দেশে ২২ জন সরকার প্রধানকে হত্যা করে ক্রুসেডার ফ্রান্স। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে ক্রুসেডার ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএসই।

পশ্চিম আফ্রিকায় আল-কায়েদার উত্থান:

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে ৯০ দশকে শুরু হয় ক্রুসেডার ফ্রান্স ও তাদের গোলাম সরকার বিরোধী বিক্ষোভ-মিছিল। যা ধীরে ধীরে পবিত্র জিহাদে রূপ নেয়। এর ধারাবাহিতায় ২০১৩ সালের মধ্যে আল-কায়েদা (AQIM) সহ কয়েকটি জিহাদী দল মালির রাজধানী বামাকো পর্যন্ত পৌঁছে যান। তাঁরা রাজধানীর রেডিও-স্টেশন ও বিমান বন্দরসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথে উত্তর মালি পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি মালির ৭৫% এলাকার উপরই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন মুজাহিদগণ। সেসময় দেশটির জাতীয় রেডিও-স্টেশন থেকে নিয়মিত সম্প্রচারিত হতে থাকে কুরআন ও হাদিসের দরস এবং মুজাহিদদের বিজয় সংবাদ। এর মাধ্যমে মুজাহিদগণ ক্রুসেডার ফ্রান্সের দখলদারিত্বের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছিলেন। আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোতেও মুজাহিদদের এই বিজয় মুসলিমদের হৃদয়ে আনন্দের ঢেউ তুলে। মসজিদগুলোতে দো’আ হতে থাকে মুজাহিদদের জন্য।

বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত মালির একটি ম্যাপ:

বিবিসি কর্তৃক প্রকাশিত মালির একটি ম্যাপে দেখানো হয়, এপ্রিল ২০১২ থেকে জানুয়ারি ২০১৩ পর্যন্ত ম্যাপের লাল অংশটুকু মুজাহিদগণ এবং একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

হলুদ অংশটুকুতে দেখানো হয় যে, জাতিগত উত্তেজনা এবং মুজাহিদদের হামলা ও অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে।
রাজধানী বামাকোসহ ম্যাপের এই অংশটুকু দেখানো হয়েছে মুজাহিদদের হামলা ও হুমকির স্থান হিসেবে। যদিও ঐবছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে মুজাহিদগণ মুপ্তি রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে রাজধানী বামাকো অবরুদ্ধ করেন এবং রাজধানীর অনেকাংশ দখল করে নেন। বাকি ম্যাপের সবুজ অংশ বা শুধুমাত্র মালির দুটি রাজ্যকে দেখানো হয়েছে ক্রুসেডার ফ্রান্সের পুতুল সরকারের কর্তৃত্বাধীন অঞ্চল হিসেবে।

 

এমন পরিস্থিতিতে ক্রুসেডার ফ্রান্স বুঝতে পারে যে, মুজাহিদদের অগ্রগতির এই ধারা আরো কিছুদিন চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই পুরো আফ্রিকায় কর্তৃক হারাবে ফ্রান্স। তাই খুব দ্রুততার সাথেই ফ্রান্স ইউরোপিয় দেশ ও আফ্রিকাতে বসিয়ে রাখা তাদের গোলাম সরকারদের নিয়ে জোট গঠন করে এবং মালিতে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। কিন্তু এতে তেমন একটা ফলাফল পাচ্ছিল না ফ্রান্স। তাই এবার কুফ্ফার জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয় ফ্রান্স। এরপর জাতিসংঘ তাদের ভাড়াটিয়া কথিত ‘শান্তিরক্ষী বাহিনী’ নিয়ে মালিতে অভিযান শুরু করে। কুফ্ফার জোটের এই মিশনে তখন ৯ শতাধিক সৈন্য নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডারদের হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে; সময়ে সময়ে সেই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ মুরতাদ সরকার। ২০২০ সালের অক্টোবরেও এই মিশনে অংশগ্রহণ করতে দেশ ত্যাগ করে প্রায় দেড় শতাধিক পুলিশ ও সেনা সদস্য।

মালিতে বাংলাদেশি সেনারা

কুফ্ফার বাহিনীর সম্মিলিত এই অভিযানের ফলে ২০১৪ সালের মধ্যে মুজাহিদগণ শহরীয় এলাকাগুলো ছেড়ে সাময়িক সময়ের জন্য তখন পিছনে সরে আসতে বাধ্য হন। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অবস্থান নেন লিরা, কাইদাল, গাও, মেনেকা ও টিসালিটের সীমান্ত ও পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে। এসময় তারা সীমান্ত রাজ্যগুলোর কিছু কিছু স্থানে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ টিকিয়ে রাখেন এবং সেখান থেকেই আশপাশের অঞ্চলগুলোতে গেরিলা অভিযান চালাতে থাকেন। এসময়ের মধ্যে মুজাহিদগণ পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চার ও কুফ্ফার বাহিনীর শক্তিক্ষয় করতে গেরিলা অভিযান চালাতে থাকেন।

সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে মুজাহিদদের অবস্থানকালের ম্যাপ:

IMG-20210711-163416-963

 

কমলা অংশ মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল এবং হালকা কমলা অংশে মুজাহিদগণ তখনও অভিযান অব্যাহত রেখেছেন।

অতঃপর ২০১৬ সালের মধ্যে মুজাহিদগণ পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ক্রুসেডার ও মুরতাদ বাহিনীর উপর ধীরে ধীরে বড় বড় হামলা চালাতে থাকেন। এক বছর পর অর্থাৎ ২০১৭ সালে আল-কায়েদা পশ্চিম আফ্রিকা ভিত্তিক মালির AQIM এর মুজাহিদিন স্থানীয় বৃহৎ ৩টি জিহাদী দল (আনসার আদ-দ্বীন, আনসার আল-মুরাবিতুন ও আনসার আল-ইসলাম) ঐকবদ্ধ হয়ে একই আমীর ও একই পতাকাতলে দ্বীন কায়েমের জন্য জিহাদের অঙ্গীকার করেন। আল-কায়েদার অধীনে বায়াতবদ্ধ হয়ে তারা গঠন করেন জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (সংক্ষেপে JNIM) নামে নতুন দল, বিলুপ্ত করেন আগের আঞ্চলিক দলগুলো।

জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন (JNIM) প্রতিষ্ঠার পরে অফিসিয়াল ভিডিও বার্তার দৃশ্য:

IMG-20210711-163408-968

 

মুজাহিদদের এই একতা তাদের শক্তি ও মনোবলকে আরো দ্বিগুণ করে দেয়। মহান আল্লাহ্ তা’আলার সাহায্য ও অনুগ্রহে মুজাহিদগণ পুনরায় মালিতে বিজয় অভিযান শুরু করেন এবং শহর ও বিভিন্ন এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকেন। এসময় মুজাহিদদের হামলায় হতাহত হতে থাকে মালি ও বাংলাদেশের মুরতাদ সৈন্যরাসহ ক্রুসেডার ফ্রান্স ও জাতিসংঘের অন্যান্য ক্রুসেডার সৈন্যরা।

 

মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে মুজাহিদগণ মালির মানচিত্র পরিবর্তন করে ফেলেন এবং দেশটির বিশাল এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে আল্লাহর দেওয়া বিধান দ্বারা বিচারকার্য পরিচালনা করা হয়, আলহামদুলিল্লাহ।

২০১৯ সালের শেষদিকে GIS নামক একটি সংবাদমাধ্যম কর্তৃক প্রকাশিত মালি, বুর্কিনা-ফাসো ও নাইজারের ম্যাপ:

IMG-20210711-163415-289

 

সংবাদমাধ্যমটিতে প্রকাশিত ম্যাপে মালির বিস্তীর্ণ হলুদ অংশকে দেখানো হয় মুজাহিদদের উপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল হিসাবে, যদিও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোকে দেখানো হয় ক্রুসেডার ফ্রান্সের দখলে। এছাড়াও নাইজার ও বুর্কিনা-ফাসোতে মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলকেও হুলুদ রং দ্বারা চিন্হিত করেছে। ম্যাপের বাকি অংশটুকু দেখানো হয় দেশটির গোলাম সরকারের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল হিসাবে।

এদিকে ২০২০ সালের অক্টোবরে মালির রাজধানী বামাকোসহ ৩টি রাজ্য ব্যতীত সম্পূর্ণ মালি এবং বুর্কিনা-ফাসোর সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোকে লাল রং দ্বারা চিহ্নিত করে অনিরাপদ ও যুদ্ধকবলিত বলে ঘোষণা করে ক্রুসেডার ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কেননা এসব অঞ্চলে আল-কায়েদা মুজাহিদিন সবচাইতে মজবুত ও দৃঢ় অবস্থানে রয়েছেন। এসব কারণে লাল চিহ্নিত এলাকাগুলোতে বিদেশী নাগরিক বিশেষ করে ফ্রান্সের নাগরিকদের ভ্রমণ নিষিদ্ধ করেছে দেশটি।

ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত মালি ও বুর্কিনা-ফাসোর ম্যাপ:

 

একই বছর আল-কায়েদা সমর্থক ‘সাবাত নিউজ এজেন্সী’ মালি, বুর্কিনা-ফাসো ও নাইজারের একটি ম্যাপ প্রকাশ করেছে। ম্যাপটাতে সাদা অংশকে আল-কায়েদা মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং কালো রেখাযুক্ত অঞ্চলকে মুজাহিদদের অভিযানের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাকি অংশটুকুকে গোলাম সরকারদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

সাবাত নিউজ এজেন্সী কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাপ:

এমনিভাবে ২০২০ ঈসায়ীর মে মাসে “পশ্চিম আফ্রিকার সর্বশেষ পরিস্থিতি” শিরোনামে মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের নতুন একটি ম্যাপ প্রকাশ করে তুর্কি সংবাদ মাধ্যম Mepa News। ম্যাপটাতে মালি, নাইজেরিয়া ও বুর্কিনা-ফাসোর তৃদেশীয় সীমান্ত অঞ্চলে বেগুনি রং দিয়ে ‘আইএস’ এর উপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দেখানো হয়েছে। তবে ঐবছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরের মধ্যে আইএস নিয়ন্ত্রিত বেগুনি অংশ পরিপূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণে নেন আল-কায়েদা মুজাহিদগণ। এরপর ম্যাপে ৬টি বিভিন্ন রং দিয়ে আল-কায়েদা পশ্চিম আফ্রিকা শাখার কয়েকটি আঞ্চলিক মুজাহিদ গ্রুপের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল দেখানো হয়েছে। এসব দলগুলো ২০১৭-১৮ সালে আল-কায়েদার হাতে বায়াতবদ্ধ হয়ে আঞ্চলিক শাখাগুলো বিলুপ্ত করেছে এবং JNIM নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এছাড়াও মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত এসব অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ক্রুসেডার ফ্রান্সের অবস্থানও দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ যেসব অঞ্চলগুলো মুজাহিদদের নিয়ন্ত্রিত দেখানো হয়েছে, তার কিছু কিছু শহরীয় অঞ্চল এখনো ক্রুসেডার ফ্রান্স ও জাতিসঙ্ঘের জোট বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। অপরদিকে মুর্তানিয়া ও আল-জাযায়ির মুজাহিদদের অগ্রগতির ও যুদ্ধের স্থানগুলোও কালো রেখা দিয়ে দেখানো হয়েছে। এই ম্যাপটি থেকে স্পষ্ট যে, আল-কায়েদা মুজাহিদগণ পুনরায় মালির রাজধানী বামাকো দখল করতে যাচ্ছেন।

Mepa news কর্তৃক প্রকাশিত ম্যাপ:

 

আফ্রিকায় কর্তৃত্ব হারাচ্ছে ক্রুসেডার ফ্রান্স:

মালিকে বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদশালী দেশ হিসাবে বিবেচিত করা হয়। মালির ইউরোনিয়ামের পুরোটাই নিয়ে যায় ক্রুসেডার ফ্রান্স। মালি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ। স্বাভাবিকভাবেই মালির বিস্তীর্ণ এলাকার উপর আল-কায়েদার নিয়ন্ত্রণ ক্রুসেডার ফ্রান্সের অর্থনীতির জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয়। কারণ ক্রুসেডার ফ্রান্স, মালি থেকেই বর্তমানে সবচাইতে বেশি স্বর্ণ চুরি করে থাকে। মালির বিশাল এলাকায় আল-কায়েদার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের ফলে সেসব স্থান থেকে এখন আর সম্পদ চুরি করা সম্ভব হচ্ছে না ক্রুসেডার ফ্রান্সের জন্য। বরং বর্তমানে এসব সম্পদ থেকে লাভবান হচ্ছে মালির জনসাধারণ।

মালি ভিত্তিক ‘বামাকো নিউজ’ গত ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে লিখে যে, JNIM এর বর্তমান বার্ষিক আয় আড়াই কোটি ডলার; যা তাঁরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে অর্জন করছে। এছাড়াও রয়েছে মুক্তিপণ, যাকাত, উশরসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সহায়তা, যার পরিমাণও অনেক। এদিকে সামরিকভাবে মালিতে আল-কায়েদা নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও অনেক দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায় গত ২০১৯ সালের অক্টোবরে ‘বামাকো নিউজ’ সহ আফ্রিকা ভিত্তিক একাধিক সংবাদমাধ্যম কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে। রিপোর্টটে বলা হয় যে, মালির উত্তরাঞ্চলের (বুর্কিনা-ফাসো সীমান্তে) প্রায় ৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথাকথিত আধুনিক (সেক্যুলার) শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করে দ্বীন-দুনিয়ার উপকারী শিক্ষা অর্জনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলছে আল-কায়েদা।

গত তিন মাস আগে, JNIM মুজাহিদিন তাঁদের হাতে বন্দী ইতালীয় জিম্মি সৌমালা সিসি (যে কোভিড-১৯-এ মারা গেছে) এবং ফরাসি সোফি পেট্রোনিনকে বন্দীবিনিময় চুক্তির আওতায় মুক্তি দিয়েছিলেন। বিপরীতে ক্রুসেডার ফ্রান্স ২০৬ জন মুজাহিদকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এ বন্দি-বিনিময় ছিল মুজাহিদদের জন্য বড় এক বিজয়। এ ঘটনার পরবর্তী দুই মাসে ক্রুসেডার ফ্রান্সের উপর হামলাও বৃদ্ধি করেছে আল-কায়েদা। এসময় ডিসেম্বরে শেষ সপ্তাহে মুজাহিদদের ২টি হামলায় নিহত হয়েছে ফ্রান্সের ৫ সৈন্য, আহত হয়েছে আরো ৭ সৈন্য। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারির প্রথম দিন ফ্রান্সের একটা সামরিক ঘাঁটিতেও ইস্তেশহাদী হামলা চালিয়েছেন মুজাহিদগ। এ হামলায় কমপক্ষে ২০ ক্রুসেডার সৈন্য নিহত হয়েছে। ক্রুসেডার বাহিনীর উপর মুজাহিদদের এসব হামলার প্রভাব পড়েছে ফ্রান্সের জনসাধারণের উপরেও। এখন ক্রুসেডার ফ্রান্স বিরোধী মনোভাব কেবল মালিতেই নয়; বরং ফ্রান্সের অভ্যন্তরেও মতভেদ ছড়িয়ে পড়ছে, চলছে নিজ দেশের গণমাধ্যমেই সমালোচনা। সংসদ সদস্যরা মালিতে ফ্রান্সের আট বছরের নিরবিচ্ছিন্ন সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছে। মালিতে ফরাসি সৈন্যদের অবস্থানের যৌক্তিকতা নিয়েও দেশটির সংসদে আলোচনা উঠছে।

‘বামাকো নিউজ’ চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছে, ফ্রান্স যখন মালিতে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে, তখনই দেশটির ৫১% সামরিক কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আর বর্তমানে মালিতে ফরাসি সৈন্যদের শোচনীয় পরাজয়ের ফলে দেশটির ৭৩% সামরিক কর্মকর্তা ও সেনা সদস্যরাই যুদ্ধ করতে নারাজ।

বুর্কিনা-ফাসো ও আফ্রিকার অন্যান্য দেশগুলোতে আল-কায়েদার ক্রমবর্ধমান বিজয়:

ফ্রান্স পশ্চিম আফ্রিকার যেসব দেশে সরাসরি সক্রিয়, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বুর্কিনা ফাসো। গত ৬ বছর ধরে বুর্কিনা-ফাসোতে উত্তর মালি সীমান্ত হয়ে যেই লড়াই শুরু করেছে আল-কায়েদা তা আটকাতে ব্যর্থ হয়েছে ফ্রান্স ও দেশটির সরকার। বরং দিন দিন সেখানে আল্লাহর অনুগ্রহে মুজাহিদগণ বিজয় ও অগ্রগতি অর্জন করেই চলেছেন। ফলে দেশটির সরকার মালি সরকারের মতোই বাধ্য হয়ে আল-কায়েদার সাথে আলোচনার টেবিলে বসতে চাচ্ছে।

যেমন গত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোজ বৃহস্পতিবার, বুর্কিনা-ফাসো সরকার-প্রধান সংসদে বক্তব্য দেওয়ার সময় আল-কায়েদা পশ্চিম আফ্রিকা শাখা ‘জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন’ এর সাথে বৈঠক করতে চান উল্লেখ করে একটি বিবৃতি প্রদান করে।

দেশটির সরকারের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, আল-কায়েদা ইতোমধ্যে বুর্কিনা-ফাসো সরকার ও তার সামরিক বাহিনীর উপর যুদ্ধক্ষেত্রে বড়ো ধরনের প্রভাব ফেলেছে এবং দেশটির উল্লেখযোগ্য অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব করছে। আর এটি সত্যিই ক্রুসেডার ফ্রান্সের জন্য বড় ধরনের একটি পরাজয়।

২০১৩ সালের পূর্বে আল-কায়েদা মালিভিত্তিক শাখাটির কার্যক্রম শুধু মালিতে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে মালির সীমান্তবর্তী দেশগুলোতেও। বর্তমানে JNIM মুজাহিদগণ নাইজার, বুর্কিনা-ফাসো, মৌরিতানিয়া, আল-জাযায়ের, গিনি ও আইভরিকোস্টসহ আরো বেশ কিছু দেশে অভিযান চালানো শুরু করেছেন। এ সবগুলো রাষ্ট্রেই বিভিন্নভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব খাটিয়ে জুলুম করছে ক্রুসেডার ফ্রান্স। এটা এখন স্পষ্ট যে, আল-কায়েদার ক্রমবর্ধমান এই অগ্রযাত্রার ফলে পশ্চিম আফ্রিকায় কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে ক্রুসেডার ফ্রান্স।

এদিকে গত ২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে ফরাসি বিদেশী গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান বেনার্ড এমিরি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মধ্য মালিতে আল-কায়েদার কেন্দ্রীয় সর্বোচ্চ ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের ভিডিও চিত্র প্রকাশ করেছে। সে দাবি করেছে যে, আল-কায়েদা নেতাদের “এই বৈঠকের উদ্দেশ্য হলো সামরিক ঘাঁটিগুলোতে বৃহৎ আকারের অভিযানের প্রস্তুতি নেওয়া”।

সে আরো দাবি করেছে যে, “এখানেই সাহেলের আল-কায়েদার নেতারা গিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর দিকে সম্প্রসারণ প্রকল্পের নকশা তৈরি করেছিলেন। তাঁরা ইতোমধ্যে তাঁদের যোদ্ধাদেরকে দক্ষিণে, কোট-ডি’ভোরে, বেনিনে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং নিয়মিত যোদ্ধাদের অর্থায়ন করছেন।”

ভিডিওটির একটি দৃশ্য:

আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এমিআইয়ের মতে, “নাইজেরিয়া, নাইজার এবং চাদ সীমান্তেও আল-কায়েদা নতুন করে তাঁদের যোদ্ধাদের প্রেরণ করেছে।” তাঁর ভাষ্যমতে, “এই সভায় উপস্থিত সবাই ছিলেন ওসামা বিন লাদেনের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী। তাঁরা তাঁর রাজনৈতিক প্রকল্প অনুসরণ করছেন, বিশেষত পশ্চিম এবং ইউরোপে হামলা চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা নতুন করে কাজ শুরু করেছেন। আর এমন পরিস্থিতি আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।”

আলহামদুলিল্লাহ, এভাবেই আল্লাহ্ তায়ালা মুজাহিদ ভাইদের মাধ্যমে ক্রুসেডার ফ্রান্সকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করছেন এবং মুজাহিদদেরকে প্রতিশ্রুত বিজয় দিচ্ছেন। আল্লাহ্ তায়ালা মুজাহিদ ভাইদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করুন । আমাদের মুসলিম যুবকদেরকেও এই বরকতময় কাফেলায় শরিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক, আল-ফিরদাউস নিউজ


তথ্যসূত্র:

[১] Mali election: Militia mayhem threatens vote- https://tinyurl.com/ieis9hta

[২] Fransa Mali’deki asker sayısını azaltacak mı?- https://t.co/y8vl8UzWLF

[৩] jihadiste en Côte d’Ivoire et au Bénin : opération de communication ou coup de pression de la DGSE ? – https://t.co/GQdFRRt5rF

[৪] Burkina Faso Başbakanı: Cihat yanlıları ile müzakere edebiliriz- https://tinyurl.com/3jkxa067

[৫] Les djihadistes ouvrent plus de 600 écoles au Mali  et au Burkina, au nez et barbe des forces onusiennes et du G5 Sahel- https://t.co/L8ZIBBTJZA

13 মন্তব্যসমূহ

  1. আলহামদুলিল্লাহ.

    আলহামদুলিল্লাহ.

    আলহামদুলিল্লাহ.

    এত ভাল লাগতেছে রিপোর্ট টা পড়ে বুঝাতে পারব না ভাই।

    আমাদেরকেও আল্লাহ কাফেলাতে শরীক হওয়ার তৌফিক দান করুন।

    আল্লাহ কবুল করুন।

Leave a Reply to taslima akhter প্রতিউত্তর বাতিল করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন