তালেবান আল- কায়েদার মধ্যে এই সহযোগিতা পর্ব শুরু হলে তালেবানরা একে একে উত্তরাঞ্চলীয় জোটের বিরুদ্ধে সফল অভিযান চালাতে শুরু করেন। কেননা আল-কায়েদা তখন যোদ্ধা, অস্ত্র, অর্থ আর পরামর্শ দিয়ে তালেবানদের সর্বাত্মক সহায়তা করে যাচ্ছিল।
এদিকে তালেবান তাঁদের শাসনামলে ঐতিহাসিক কিছু সিদ্ধান্ত ও কাজ সম্পূর্ণ করেন। এরমধ্যে রয়েছে আফিম ও পপি চাষসহ মাদকদ্রব্য চাষাবাদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। ফলে ২০০০ সালে তালেবান শাসনামলে আফগানিস্তানে এসব মাদকদ্রব্য চাষাবাদ বা উৎপাদন ৯৭% হ্রাস পায়। বিশ্বের মাদক ব্যবসা একটি বড় সংকটে পড়ে যায়। একই সময়ে আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বে, যা রাশিয়া, ইরান ও আমেরিকার মদদপুষ্ট মাসউদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন- সেখানে মাদক উৎপাদন অব্যাহত ছিল এবং তা মাসউদ বাহিনীর অর্থায়নে ব্যবহৃত হত।
১৯৯৯ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের উন্নয়নের উপর কাতার ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরা একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করে। এসময় সংস্থাটির কাতারের রাজধানী দোহার স্টুডিওতে হিজব-ই-ইসলামীর নেতা হেকমতিয়ারের প্রতিনিধি আব্দুল হাকিম, প্যারিস থেকে জাতিসংঘের মুখপাত্র হিসেবে লাহদার ইব্রাহিমি, লন্ডন থেকে বিখ্যাত ইসলামপন্থী সাংবাদিক তৈসির আল্লুনি উপস্থিত ছিল। তারা উক্ত অনুষ্ঠানে আফগান যুদ্ধ, ওসামা বিন লাদেনের উপস্থিতি, তালেবানদের কার্যকলাপ, কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রচেষ্টা এবং ঐক্যের আহ্বান নিয়ে আলোচনা করে।
এসময় তৈসির আল্লুনি আফগানিস্তান ধ্বংসের জন্য তালেবান-পূর্ব গোষ্ঠীর মধ্যকার গৃহযুদ্ধকে দোষারোপ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে তালেবানরা দেশে স্থিতিশীলতা এনেছে। জাতিসংঘের পক্ষে কথা বলা সত্ত্বেও ইব্রাহিমিও নিশ্চিত করেছেন যে, তালেবানরা দেশে স্থিতিশীলতা এনেছে এবং জীবনযাত্রার উন্নতিতে অবদান রেখেছে। অপরদিকে হেকমতিয়ারের প্রতিনিধি আবদুল হাকিম তালেবানকে ঐক্যের আহ্বান করে এবং জোট সরকার গঠনের পরামর্শ দেয়। তখন তৈসির আল্লুনি হেকমতিয়ারকে স্মরণ করিয়ে দেন যে এটা বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু দলগুলো একটি সমঝোতায় আসতে না পেরে বরং আফগানিস্তানকে ধ্বংস করেছে। আয়োজক হেকমতিয়ারকে বলেন যে, তালেবান তাদের সব বিরোধীদের ক্ষমা করে দিয়েছে, তাই হেকমতিয়ার আফগানিস্তানে ফিরে এসে তালেবানদের সাথে তার চিন্তা ভাগাভাগি করতে পারেন। এদিকে লাহদার ইব্রাহিমি ব্যতীত অন্যান্য অংশগ্রহণকারীরা বলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে ইসলামী প্রশাসন চায় না, ফলে আমেরিকা এই কাজে জাতিসংঘকে তাদের স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছে।
এই অনুষ্ঠানের এক মাস পরেই অর্থাৎ অক্টোবরে ক্রুসেডার আমেরিকা জাতিসংঘে “সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন” করার ভিত্তিতে আফগানিস্তানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিল উত্থাপন করে। কুফ্ফার জাতিসংঘের পাঁচটি স্থায়ী প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স, সবাই তালেবান বিরোধী হওয়ায় আইনটি সর্বসম্মতিক্রমে এবং সহজেই পাশ হয়ে যায়। তালেবানদের নিয়ন্ত্রণাধীণ আফগান বিমান সংস্থাও নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তালেবানদের নিকট বিমান এবং সরঞ্জাম বিক্রি নিষিদ্ধ করে জাতিসংঘ নামক কুফ্ফার সংঘটি। এই নিষেধাজ্ঞার সাথে সাথে খাদ্য সরবরাহেও সমস্যা শুরু হয়।
এরপর ২০০০ সালে ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালেবানকে সন্ত্রাসী হিসেবে ঘোষণা করে। তালেবানদের উৎখাতের জন্য যুদ্ধরত দলগুলোর প্রতি আমেরিকা সমর্থনের ঘোষণা দেয় এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, রাশিয়া, ইরান এবং ভারত কর্তৃক উত্তরাঞ্চলীয় জোটের কাছে পাঠানো অস্ত্র ও অন্যান্য ধরনের আর্থিক সহায়তার ফলে তালেবানরা কিছুদিন উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকেন।
এছাড়াও ২০০০ সালে, চীন এবং রাশিয়া আফগানিস্তানে বোমা হামলার হুমকি দেয় এই ভিত্তিতে যে “এটি ইসলামী জিহাদের একটি ঘাঁটি যা তাদের দেশের জন্য হুমকি”।
২০০১ সালের শুরুতে, উত্তরাঞ্চলীয় জোট বিদেশী সমর্থন পেয়ে তালেবানদের উপর আক্রমণ শুরু করে। এরপর ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালেবানরা বৌদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করেন। এই ঘটনার পরের মাসে আফগানিস্তান, ইরান এবং উজবেকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষ হয়। এবছরের মে মাসে রশিদ দোস্তাম, তুরস্ক থেকে উত্তর-পূর্ব আফগানিস্তানে ফিরে আসে এই আশায় যে, তালেবানের বিরুদ্ধে উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থায়ন করা হবে।
১৯৯৮ থেকে শুরু করে, আহমদ শাহ মাসউদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , রাশিয়া, ইরান এবং ভারতের তীব্র সমর্থন পায়, যা তাকে দীর্ঘদিন ধরে তালেবানদের বিরুদ্ধে টিকিয়ে রেখেছিল। মাসউদ সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বছরগুলোতে ইউরোপে সাপোর্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। এই সব দেশগুলো মাসউদ (উত্তরাঞ্চলীয় জোট) বাহিনীকে প্রচুর অর্থ এবং হেলিকপ্টারসহ ভারী অস্ত্র সরবরাহ করছিল। এই সময়কালে বুরহান উদ্দিন রব্বানীও মাসউদ বাহিনীর রাজনৈতিক শাখায় যুক্ত হয়। সবমিলিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে পশ্চিমা বিশ্বসহ অন্যান্য দেশগুলোও তালেবানদের বিরুদ্ধে সহায়তা করতে থাকে।
মাসউদের প্রতি বিভিন্ন দেশের তীব্র সমর্থন এসবই ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মার্কিন প্রকল্পেরই অংশ। যাদের লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলে সরাসরি সৈন্য পাঠিয়ে এবং যুদ্ধে জড়িত হয়ে তালেবানকে উৎখাত করা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মাসউদের সাথে বিভিন্ন চুক্তি করে। এবং বিভিন্ন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য তার সাথে দীর্ঘ আলোচনায় লিপ্ত হয়।
২০০১ সালের এপ্রিল মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বক্তৃতাকালে মাসউদ বলেছিল যে আফগানিস্তান “মৌলবাদী ইসলামপন্থীদের” দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং সমগ্র বিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসময় সে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড’কে আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ এবং তাদের সমর্থন করতে বলে। সেই লক্ষ্যে মাসউদ ইইউ কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা ও চুক্তি করে।
এরপর রশিদ দোস্তাম ২০০১ সালের মে মাসে আফগানিস্তানে মাসউদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ফিরে আসে। তখন সে বলে, ‘আমার বন্ধু বলেছে যে, সে তার বাহিনী পুনর্গঠন করতে চায় এবং তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, রাশিয়া, ইরান এবং ভারতের সহায়তায়’।
উত্তরাঞ্চলীয় জোটের এসব কর্মকান্ড তালেবানদের নিকট তাঁদের ভবিষ্যত স্পষ্ট করে দেয়। তালেবান ও আল-কায়েদা বুঝতে পারে যে, আফগানিস্তানে ক্রুসেডার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ খুব শীঘ্রই আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর সাথে মাসউদের সহযোগিতার সম্পর্ক ইমারতে ইসলামিয়ার জন্য অনেক বেশি বিপদজনক হবে। তাই এই জোট ও মাসউদকে শেষ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন আল-কায়েদার মুজাহিদরা।
সেই লক্ষ্যে আল-কায়েদা, মাসউদকে একটি বড়িতে দীর্যদিন ধরে দু’জন ছদ্মবেশী সাংবাদিকের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণে রাখেন। এবং ৯/১১ হামলার দুমাস আগে আল-কায়েদার দুজন তিউনিশিয়ান মুজাহিদ (ছদ্মবেশী সাংবাদিক) আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে মাসউদ ও তার সাথীদের ঐ বাড়িতে হত্যা করেন। এরমধ্য দিয়ে ক্রুসেডাররা ইমারতে ইসলামিয়াকে ধ্বংস করার যেই পরিকল্পনা করেছিল, তা ভেস্তে দেন আল-কায়েদার মুজাহিদগণ। এরপর খুব সহজেই উত্তরাঞ্চলীয় জোটকে ধ্বংস ও তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহন করেন তালেবান মুজাহিদগণ।
চলবে ইনশা আল্লাহ…
লেখক: ত্বহা আলী আদনান, প্রতিবেদক: আল ফিরদাউস নিউজ।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-