বিজেপি ও আরএসএস সন্ত্রাসীদের ‘স্পনসর’ হওয়া ছবি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’। ছবিটিতে ইতিহাস বিকৃত করে করে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অবস্থা দেখানো হয়েছে, যার সবই কাল্পনিক।
সিনেমার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছে অনুপম খের, দর্শন কুমার, মিঠুন চক্রবর্তী, পল্লবী যোশী। গত ১১ মার্চ ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটিতে মুসলিমদের তুলে ধরেছে সন্ত্রাসী রুপে। অভিনেতারা এটাই ফুটিয়ে তুলেছে যে, মুসলিমরা হিন্দু পণ্ডিতদের গণহত্যা করেছিল, বিতাড়িত করেছিল কাশ্মীর থেকে।
হিন্দুত্ববাদীদের মনগড়া কল্প কাহিনী ভারতে চলমান মুসলিম বিদ্বেষ গণহত্যার মোড় নিয়েছে। যে কাশ্মীর ও কাশ্মীরি হিন্দু পন্দিতদেরকে কেন্দ্র করে এই সিনেমা, সেই হিন্দু পণ্ডিতদের বড় অংশের মতে, এটি ‘উদ্দেশ্যমূলক ছবি’। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীরের মুসলিমদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর চেষ্টা।
এখানে পাল্টা প্রশ্ন করা যায় যে, হিন্দুত্ববাদী বাহিনীর গুলিতে কয়েক হাজার কাশ্মীরি নিহত, অগণিত কাশ্মীরী নিখোজ হয়েছেন, তাঁদের নিয়ে কেন কোনও সিনেমা তৈরি হয় না?
আর কাশ্মীরি পণ্ডিতরাই এখন বলছে, ছবিতে যা দেখানো হচ্ছে সবই বানোয়াট।
কাশ্মীরি পণ্ডিত সম্পাত প্রকাশ। সে বলেছে যে, চলচ্চিত্র নির্মাতা সংখ্যালঘুদের অবস্থা বেদনাদায়ক হিসেবে এককভাবে তুলে ধরেছে। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদেরকে শত্রু হিসেবে তুলে ধরেছে। যারা পণ্ডিতদের হত্যা বা বিতাড়িত করার করার জন্য কখনই দায়ী ছিল না।
কাশ্মীরের আরেকজন পণ্ডিত মহিলার নাম শিবানী ধর সেন। তাঁর টুইটারের প্রোফাইল থেকে জানা যায়, হায়দরাবাদের বাসিন্দা। দক্ষিণ ভারতের সুন্দরীদের প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। বিনোদন দুনিয়ার সাথেও তার ভাল যোগ ছিল।
সে টুইটে লিখেছে, ‘আমি এক জন ভারতীয়। কাশ্মীরি পণ্ডিতও বটে। তাও ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটি দেখব না। অনেক হয়েছে। ঘৃণা ছড়ানোর জন্য আমাদের কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ইতিহাসকে ব্যবহার করা বন্ধ করুন।’
শিবানীর এই টুইটটির ছবি নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এই বক্তব্য নিয়ে বিবেক এবং তাঁর টিমের সদস্যদের নিয়ে সমালোচনাও শুরু হয়েছে। যে উদ্দেশমূলকভাবেই তারা এমন কাজ করেছে।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আহমেদ ওয়ানির কথায়, ‘‘ভালই তো কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে সিনেমা হয়েছে। ২০১৬ সালে হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানিকে হত্যার পরে হিন্দুত্ববাদী বাহিনী শতাধিক তরুণ-যুবককে খুন করেছে। সেই ঘটনা নিয়েও তো সিনেমা হতে পারে!’’
রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়েই ওই ছবি তৈরি করা হয়েছে। ওই অধ্যাপকের সোজাসাপ্টা মন্তব্য, ‘‘এই ছবিকে গৈরিক শিবির নির্বাচনে ব্যবহার করবে এবং দেশের সম্প্রীতি নষ্ট করবে।’’
একই মত উপত্যকায় পণ্ডিতদের স্বার্থ নিয়ে লড়াই করা কাশ্মীর পণ্ডিত সংঘ সমিতির। সংগঠনের সদস্য সঞ্জয় টিকুর কথায়, ‘‘কিছু লোক এই ছবি দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায়। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই ছবিটি তৈরি করা হয়েছে।
সোম্যা লাখানি নামে জনৈক কাশ্মীরি পণ্ডিতের কথায়, ‘‘এই সিনেমা শিল্প নয়, হিন্দুত্ববাদের প্রচার। শিল্প ও প্রচারের সূক্ষ্ম ফারাক আছে। সেই পার্থক্যটা বোঝা জরুরি।’’
কাশ্মীর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক মুহাম্মদ শাকিরের মতো অনেকেই মনে করেন, সিনেমায় যা দেখানো হচ্ছে, তা সঠিক নয়। ওই অধ্যাপক বলেন, ‘‘জম্ম-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার, ডাকাতির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।’’ বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারে পরে উপত্যকায় প্রবল ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। শাকিরের অভিযোগ, ‘‘কথা বললেই সন্ত্রাস-বিরোধী আইনে জেল বন্দি করা হচ্ছে। দারুণ ভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে আমাদের মৌলিক অধিকারগুলি।’
জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রধান ডা. ফারুক আবদুল্লাহ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’কে একটি হিন্দুত্ববাদী প্রোপাগান্ডা মুভি বলে অভিহিত করেছেন।
এছাড়া ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ নিয়ে মুখ খুলেছে রামগোপাল ভার্মা।
বিবেক অগ্নিহোত্রীর এই বিতর্কিত সিনেমা নিয়ে রাম গোপাল ভার্মার মন্তব্য, “দ্য কাশ্মীর ফাইলস একেবারে জঘন্য লেগেছে। আমার চিন্তাধারাই বদলে দিয়েছে”।
রামগোপাল ভার্মা ভিডিওটি ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করেছে। ভিডিওটিতে তাকে বলতে শোনা যাচ্ছে, “আমি যা কিছু শিখেছি, জেনেছি, বুঝেছি কিংবা জীবনে একাধিকবার যা চিন্তা করেছি, তার সবটাই ধ্বংস করে দিল দ্য কাশ্মীর ফাইলস। অতীতে ফিরে গিয়ে তো আমি আমার ধ্যান-ধারণা বদলাতে পারব না। এমনকি নতুন করে আবার ভাবনা বদলাবেও না যে ও এটা তো এরকমভাবেও হতে পারত। তাই কাশ্মীর ফাইলস আমার জঘন্য লেগেছে। সে পরিচালনাই হোক, কিংবা অভিনয়-চিত্রনাট্য।”এটার সাথে জড়িত সকলকেই আমি ঘৃণা করি।
এদিকে আরজেডি জাতীয় সহ-সভাপতি শিবানন্দ তিওয়ারি বলেছে, ‘নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের নির্দেশেই এই ছবি নির্মিত হয়েছে। সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেখ আবদুল্লাহ, রাজ্যপাল ডি জগমোহন। কিন্তু হিন্দু পণ্ডিতদের নিরাপত্তার দায়িত্ব কি তখনকার জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের ছিল না? আর সেই সময় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিল। সে বিজেপির সমর্থনে সরকার চালাচ্ছিল। কাশ্মীরে যা ঘটেছে তাতে আসলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের হাত ছিল।
তিওয়ারি আরও বলেছে, আসলে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইল’স এর পরিচালক সেই রাজ্য ও কেন্দ্রের ব্যর্থতা লুকিয়ে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এই দুর্দশার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে দেখিয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা মিথ্যা তথ্যের ওপরে ভিত্তি করে ছবিটি তৈরি করেছে।’
জম্মু ও কাশ্মীরের ৩০ বছরের পুরনো ইতিহাসকে বিকত একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। যা দেশে মুসলিম বিদ্বেষকে তীব্র করে এবং হিন্দুদের মনে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা তৈরি করে’।
তিওয়ারি প্রশ্ন তুলেছে, ‘আমরা ইতিহাসকে কিভাবে ব্যবহার করছি? আগুন জ্বালানোর জন্য নাকি, শিখা নেভানোর জন্য? এই ছবির মাধ্যমে দেশে আগুন জ্বালিয়ে দিতে চাইছে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি সরকার।
আসলে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম গণহত্যার পথ সহজ করতেই একেরপর এক ইস্যু তৈরী করছে। হিন্দুদের মাঝে লুকিয়ে থাকা মুসলিম বিদ্বেষকে উসকে দিচ্ছে। আর এই কাশ্মীর ফাইলস ছিল সেই পালে জোর হাওয়া লাগানোর চেষ্টা মাত্র।
প্রতিবেদক : উসামা মাহমুদ
তথসূ্ত্র:
—–
1| Kashmiri Pandit Sampat Prakash on #TheKashmirFiles. He says that the filmmaker has singled out —the majority community which was never responsible for killing or dragging out Pandits.
https://tinyurl.com/55evfxxu
2| the-kashmir-files-a-kashmiri-pandit-alams-parwsh-rawal-over-his-promotion-of-the-vivek-agnihotri-film
https://tinyurl.com/2p8s6vwv
3| growing-anger-over-film-the-kashmir-files-jammu-and-kashmir
https://tinyurl.com/48a84es6
মুহতারাম ছবিতে বানোয়াট শব্দটা বানযোয়াট এসেছে
জাযাকাল্লাহু খাইরান।