আশ-শাবাব আন্দোলন, যা পূর্ব আফ্রিকা ভিত্তিক জনপ্রিয় একটি সুন্নি মতাদর্শী ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনী। দলটি প্রধানত সোমালিয়ায় তার কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। পাশাপাশি প্রতিবেশি কেনিয়াতেও নিজেদের অবস্থান মজবুত করছে। তবে বর্তমানে এর ক্রমবর্ধমান প্রভাব ইথিওপিয়া ও জিবুতিতেও বিস্তৃত হচ্ছে।
৯০-এর দশকের শুরুলগ্নে দলটি “আল-শাবাব মুভমেন্ট” নামে পরিচিত ছিলো। তবে ৯০-এর দশকের পরে সোমালিয়ায় যখন প্রতিরোধ যুদ্ধ ব্যাপক আকার ধারণ করে, তখন দলটি তাদের সাংগঠনিক কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনে এবং নতুন করে এটি “হারাকাতুশ-শাবাব মুজাহিদিন” নাম ধারণ করে।
আশ-শাবাবের ঐতিহাসিক উত্থান ও পটভূমি :
আশ-শাবাবের ঐতিহাসিক শিকড় উদঘাটনের জন্য প্রথমে আমাদের সোমালিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন।
পূর্ব আফ্রিকার অন্যতম কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত আজকের সোমালিয়া। ফলে ইতিহাস জুড়ে বিভিন্ন শক্তির মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় দেশটি।
১৭ শতকের পরে এই অঞ্চলে মুসলিম প্রশাসনগুলি ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। আর সেই সুযোগে ১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনের মধ্যদিয়ে ১৯১২ সালের মধ্যে ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া ছাড়া পুরো আফ্রিকা দখল করে নেয় ইউরোপের সাতটি দেশ। তখন সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের উপনিবেশে পরিণত হয়। আর সে সময় সোমালিয়ায় দুটি পৃথক পশ্চিমা শক্তি দখলদারত্ব প্রতিষ্ঠা করে। যার মধ্যে সোমালিয়ার উত্তর অংশে ব্রিটিশদের দ্বারা এবং দক্ষিণ অংশে ইতালীয়দের দ্বারা ঔপনিবেশিক রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
ঔপনিবেশিক দখলদারিত্বের মুখে সোমালিয়ার জনগণ বিভিন্ন ইসলামি প্রতিরোধ বাহিনীর নেতাদের চারপাশে জড়ো হতে থাকেন এবং দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রথম দিকে যে কয়েকজন নেতা সবচাইতে বেশি ভূমিকা পালন করেন, তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসান রহ. (১৮৫৬-১৯২০) অন্যতম। ‘দরবেশ আন্দোলন’ নামে আলেমদের নিয়ে গঠিত হাসান রহ.-এর সংগঠন কালক্রমে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য ‘দরবেশ আন্দোলন’ তখন এই অঞ্চলে কয়েক ডজন দুর্গ নির্মাণ করে। যা প্রতিরোধ যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এর মধ্যে কয়েকটি দুর্গ এখনো দাঁড়িয়ে আছে। দরবেশ আন্দোলন হল এমন একটি আন্দোলন, যাকে আজ সোমালিয়ায় বহিরাগত দখলদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক বলে উল্লেখ করা হয়।
১৯ শতকের শুরু থেকে নিয়ে ২০-এর দশক পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর এই অঞ্চলে দরবেশ আন্দোলনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা সাহসিকতার সাথে ব্রিটিশ ও ইতালীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এসময় তারা একাধারে দু’টি শক্তিধর ক্রুসেডার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যান। ফলে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের তীব্র হামলার মুখে ততকালীন সোমালিয়ার ওগাডেন অঞ্চল ও এর আশপাশের এলাকাগুলো ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় ক্রুসেডাররা। যেখানে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। এদিকে ১৯২০ সালে ২১ ডিসেম্বর প্রতিরোধ বাহিনীর নেতা মুহাম্মদ হাসান (রহ.) মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রতিরোধ বাহিনীটি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে এবং অল্প দিনের মধ্যেই দরবেশ আন্দোলনের প্রকৃত অস্তিত্বের অবসান ঘটে।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোমালিয়া- যা ইতালি এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে সংঘর্ষের পটভূমি ছিল, তা পুরোপুরিভাবে ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পরের বছরগুলিতে ব্রিটিশরা সোমালিয়ার মূল ভূখণ্ডকে বিভক্ত করে ফলে। এবং সোমালিয়ার বৃহত্তর ওগাডেন অঞ্চল সহ বেশ কিছু এলাকা খ্রিস্টান প্রধান দেশ ইথিওপিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। আরও কিছু এলাকা অপর খ্রিস্টানায়িত দেশ কেনিয়ার কাছে হস্তান্তর করে। এভাবে মূলত মুসলিম প্রধান দেশ সোমালিয়াকে বিভক্ত করার মাধ্যমে মুসলিমদের একতা ও শক্তিকে ধ্বংস করে দেয় ব্রিটিশরা। সোমালিয়ার বিশাল মানচিত্রকে পরিবর্তন করে একটি ছোট সীমানা ধরিয়ে দেওয়া হয়।
বৃহত্তর সোমালিয়ার অতীত ম্যাপ –
আল-ইত্তিহাদুল ইসলামিয়ার সূচনা :
সময়ের পরিক্রমায় সচেতন মুসলিম জনসাধারণের তীব্র আন্দোলন ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের ফলে ১৯৬০ সালে ক্রুসেডারদের দখলদারিত্ব থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সোমালিয়া। যার জন্য মুসলিমদের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে মূল্য দিতে হয়েছিল। এদিকে ব্রিটিশদের থেকে সোমালিয়া স্বাধীনতা লাভের পর ক্ষমতা লোভীদের কারণে দেশে স্থিতিশীলতা আর ফিরে আসেনি। জনগণ তখন দারিদ্র্যতায় গভীরভাবে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
এসময় ১৯৬৯ সালে সৈয়দ বেরির (১৯১০-১৯৯৫) নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটে। এরপর দখলদার বিদেশীদের সমর্থিত গোষ্ঠী এবং প্রশাসনের ক্ষমতার লড়াই সমগ্র দেশকে গ্রাস করে ফেলে। চলে গণহত্যা, লুণ্ঠন আর প্রভাব বিস্তারের লড়াই। অথচ ১৯ শতকের ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই দেশটি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এবং সহায়তা দেখেনি। তার উপরে, স্বাধীনতার পরপরই যে উত্তেজনা ও গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তা দেশের সংকটকে আরও গভীর করে তুলে।
যুদ্ধরত পক্ষগুলি তাদের গোষ্ঠী এবং জাতিগত বিভক্তির কারণে গণহত্যা চালায়, বসতি ধ্বংস করে, বেসামরিক লোকদের হত্যা করে। এক কথায় তখন সোমালিয়ার পরিস্থিতি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধের মতো ছিল। যে পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে তালিবানের উত্থান হয়, সোমালিয়ায় ইসলামের উত্থানও ঠিক অনুরূপ একটি প্রক্রিয়া- যা শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি আশ-শাবাব প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যায়।
এদিকে ৬০ দশকে ব্রিটিশদের সোমালিয়া ছেড়ে যাওয়ার পিছনে বেশ কয়েকটি স্বাধীনতাকামী দলের ভূমিকা ছিলো। এরমধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য, যেই তিনিটি দল সোমালিয়ায় সমস্ত ইসলামিক কাঠামোর নেতৃত্ব দিচ্ছিল। দলগুলো হলো-
১- ওয়াহদা আশ-শাবাব আল-ইসলামী,
২- জামা’তত আহলুল-ইসলামী,
৩- মুনাজামাত আন-নাহদা আল-ইসলামিয়া,
১৯৬০-এর দশকে যখন দেশে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, তখন এই দলগুলো ইসলামের আলোকে সৈয়দ বেরির কাছে একটি সমাধানের প্রস্তাব পেশ করে। কিন্তু তা কার্যকর হয় নি। এদিকে প্রস্তাবনা পেশকারী এই দলগুলি সাধারণত ইসলামি বোঝাপড়ার উপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা মধ্যপ্রাচ্যে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমিন’ (মুসলিম ব্রাদারহুড) এর কাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিল।
বর্তমানের আশ-শাবাবের ভিত্তি তখন ওয়াহদা আশ-শাবাব আল-ইসলামিয়া থেকে শুরু হয়। পরে ওয়াহদা আশ-শাবাব আল-ইসলামি গোষ্ঠীটি ১৯৭৯ সালে সোমালিয়ার দক্ষিণে প্রতিষ্ঠিত ‘সিমাকা ইসলামিয়া’ এর সাথে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তখন উভয় দল চিন্তাধারা ও শর্তের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে এই পক্রিয়ায় উভয় দলের মাঝে ঐক্যতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।
অতপর ৮০’র দশকের শুরুর দিকে সোমালিয়ায় ক্ষমতা লোভী সেক্যূলার দলগুলোর মাঝে ক্ষমতায় লড়াই ও গৃহযুদ্ধ যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন ১৯৮৩ সালে উপরোক্ত ৪টি ইসলামি দল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের উপর ঐক্যমতে পৌঁছায়। যার ভিত্তিতে ঐবছর ওয়াহদা আশ-শাবাব আল-ইসলামিয়ার মধ্যস্থতায় দলগুলো পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
লেখক : ত্বহা আলী আদনান
প্রথম কিস্তি পড়ুন –
১। সোমালিয়ায় উদয়ের পথে নিকটবর্তী বিজয়ের নতুন সূর্যোদয়
– https://alfirdaws.org/2022/07/17/58043/
Masa -Allah vai
Masa- Allah
পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায়…