জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে আওয়ামী সরকার যে কয়টা অবাস্তব যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করেছে, তার মধ্যে একটি হলো ভারতে তেল পাচার হয়ে যাওয়ার কাহিনী। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে কম দামে তেল বিক্রি হওয়ায়, ভারতে তেল পাচার হয়ে যায়। এজন্য পাচার রোধে তেলের মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই আওয়ামী সরকারের এই যুক্তির অসাড়তা প্রমাণ হয়ে গেছে।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের মতে, যেকোনো স্মাগলড জিনিস অনেক হাত ঘুরে যায় – তাদের সবাইকেই আবার খুশি রাখতে হয়। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশে ডিজেলের মূল্যের যে ব্যবধান, তাতে এই চোরাচালান ব্যবসায় লাভবান হওয়ার সুযোগ কম। তাছাড়া, ফেনসিডিল বা অন্যান্য চোরাচালানের বস্তুর মতো এই জ্বালানি তেল পাচার এতটা সহজ নয়।
বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান স্পষ্টভাবে বলেছেন, “সীমান্ত দিয়ে কোনো ধরনের জ্বালানি তেল পাচার হচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচারের চেষ্টা খুবই অপ্রতুল। এই পাচারের চেষ্টাগুলো সাধারণত ১০-১২ লিটার হয়। এ কারণে আমি মনে করি না যে, সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচার হচ্ছে। ডিজেল ব্যাগে করে পাচার করা যায় না। যদি ব্যারেল ব্যারেল জ্বালানি তেল সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়, তবেই অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে। সীমান্তে তো আর বাতাস দিয়ে ব্যারেল ব্যারেল জ্বালানি তেল পাচার হতে পারবে না।’
ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচারের গল্প শুনিয়ে তেলের মূল্যবৃদ্ধি আওয়ামী সরকারের অযৌক্তিক ও কপট সিদ্ধান্ত। তবে যদি ধরেও নেওয়া হয়, ভারতে বা প্রতিবেশী দেশে তেল বা অন্য কোনো দ্রব্যের মূল্য কমে যাওয়ায় দেশ থেকে সেসব দ্রব্য ঐ দেশগুলোতে পাচার হচ্ছে; তবুও কি এই সমস্যার সমাধান করতে নিজ দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিতে হবে? এটা কি কোনো যৌক্তিক সমাধান হতে পারে?
সরকার এতদিন ধরে আমাদেরকে উন্নয়নের গালগল্প শুনিয়ে আমাদের কাছে চেতনা বিক্রি করেছে, আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিজেদের ও বন্ধু দেশের পকেট ভারি করেছে। সরকারের রাঘব বোয়ালেরা আমদানী-রপ্তানীর প্রকৃত মূল্যের চেয়ে কম-বেশি মূল্য দেখিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাচার করেছে; গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির হিসাব মতে, গত দশ বছরে যার পরিমাণ ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আবার এক ভারতের আদানি গ্রুপকেই বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ২৫ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে ১ লাখ আট হাজার ৩৬১ কোটি টাকা, বা ১১.০১ বিলিয়ন ডলার; যে অর্থ দিয়ে কমপক্ষে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এছাড়াও রূপপুরের মতো নানান মেগাপ্রজেক্ট’এর নামে মেগা-দুর্নীতির হাট খোলা হয়েছে সারা দেশে। মূলত এসব কিছুর পরিণতিতেই আমাদের দেখতে হচ্ছে বর্তমান জ্বালানী তেলের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধি। কাজেই, সরকারের এই ‘তেল পাচারের ভাষ্য’ নির্জলা মিথ্যা ছাড়া কিছুই নয়।
দুর্নীতি, লুটপাট আর পাচারের চাপে পরে- এতদিন যে রিজার্ভ রেকর্ড ছাড়িয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছে- সেই রিজার্ভের ঘাটতির জন্যই এখন করা শর্তে ও উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে আইএমএফ থেকে। যদিও উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে দেশের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ইতিমধ্যে ৯৬ হাজার টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর আইএমএফ’এর করা ব্যয় সঙ্কচনের শর্তসমুহের মধ্যে অবধারিতভাবেই থাকে খাদ্য, জ্বালানী ও অন্যান্য খাতে সরকারের ভর্তুকি হ্রাস ও মূল্য বৃদ্ধির পরামর্শ। তবে কোন কোন সেক্টরে সরকারের ব্যয়সংকোচন বা মূল্যবৃদ্ধি কার্যকর করা হবে, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সরকারই।
বর্তমান জ্বালানী তেলের রেকর্ড মূল্য বৃদ্ধির হাত ধরে আবার বাড়ানোর আলোচনা চলছে বিদ্যুতের দামও। সুতরাং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ইতিমধ্যে নাভিশ্বাস উঠে যাওয়া জনগণকে আরও এক দফা মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সইতে হবে।
মূলত আমরাই আমাদের উপর এই জালেম সরকার ও তাদের জুলুমের সিস্টেমকে চেপে বসতে দিয়েছি। আমরাই আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত বিধানকে ছুঁড়ে ফেলে জুলুমের গণতান্ত্রিক বিধানকে আকরে ধরেছি, মানবরচিত সংবিধানের গোলামি করেছি। এই জুলুমের সিস্টেম আমদেরকে প্রতিদিন অজগরের মতো একটু একটু করে চেপে ধরতে ধরতে আজ নিঃশ্বাস আটকে অসহায় মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। আমরা এখন এর ফল ভোগ করছি; উত্তরণের উপায়টাও তাই আমাদেরকেই তালাশ করতে হবে।
লিখেছেন : সাইফুল ইসলাম
তথ্যসূত্র :
১। সীমান্ত দিয়ে জ্বালানি তেল পাচার হয় না: পরিচালক অপারেশন, বিজিবি
https://tinyurl.com/2p8r5sy9
২। বাংলাদেশ থেকে ভারতে জ্বালানি তেল পাচার হঠাৎ বাড়লো কেন?
https://tinyurl.com/5n8d4s52