বহু গোষ্ঠী, দেশ আর মতবাদের বিরুদ্ধে একনাগাড়ে যুদ্ধ করা পৃথিবীর এক পরাক্রমশালী সাম্রাজ্যের নাম সেলজুক সাম্রাজ্য। তারা বিজয় করেছেন একের পর এক দেশ। যেখানে তারা কায়েম করেছিলেন ন্যায়, ইনসাফ, সমতা ও সহবস্থানের অপূর্ব সমন্বয়। সেখানে ছিল না কোনো বিশৃঙ্খলা কিবা হানাহানি।
আজ থেকে ঠিক সাড়ে নয়শ বছর আগে ১০৭১ সালের ২৬ আগস্ট এই সাম্রাজ্যেরই মহান পুরুষ সুলতান আলপ আরসালান এর নেতৃত্বে ঈমান ও কুফরের মাঝে সংঘটিত হয় ভাগ্য নির্ধারণকারী এক সমর যুদ্ধের। মানযিকার্ট/মালাযগির্ত এর প্রান্তরে সংঘটিত এই সমরে সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে অনেক কম মুসলিম বাহিনী আল্লাহ রাব্বুল ইযযাত এর সাহায্যে বিজয় লাভ করেন শক্তিশালী সম্মিলিত কুফফার বাইযান্টিন বাহিনীর উপর। ইতিহাসবিদগণ এই যুদ্ধকে নামকরণ করেছেন ‘দ্বিতীয় ইয়ারমুক’ নামে।
কি হয়েছিল সেই যুদ্ধে? কিভাবে কুফফারদের বিশাল ফৌজের উপর জয়লাভ করল মুসলিম বাহিনী? যুদ্ধের ফলাফলই বা কি ছিল? চলুন, তার সবই জানা যাক। তবে আগে জেনে নেওয়া যাক এই যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দিগ্বিজয়ী বীর আবু শুজা’ মোহাম্মদ আলপ আরসালান ইবনে দাউদ, বা সংক্ষেপে আলপ আরসালান এর সম্পর্কে।
সেলজুকদের উত্থান :
হিজরি পঞ্চম শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিম উম্মাহ গাফলাত ও দুনিয়ার প্রতি মোহের কারণে অত্যন্ত নাজুক অবস্থার সম্মুখীন হয়। সেসময় মুসলিম উম্মাহের ছিল না কেন্দ্রীয় কোনো নেতৃত্ব। খিলাফাতে আব্বাসিয়া হয়ে উঠেছিল কেবল নামসর্বস্ব। খলিফা ছিলেন অসহায়, খিলাফত মূলত চলছিল বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত তুর্কি গোলামদের স্বেচ্ছাচারিতায়, যাদের নিয়োগ দিয়েছিলেন স্বয়ং খলিফাই। খিলাফত যেন ছিল কেবল বাগদাদ জুড়েই, বাগদাদের বাইরে একে একে গড়ে উঠছিল স্বাধীন আমিরাত ও সালতানাত। খিলাফাহ-এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না মেনে তারা প্রত্যেকেই চাইত কেবল নিজের ক্ষমতা আর প্রভাব জাহির করতে। খিলাফাহ এর ভিতরে ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়ে রাওয়াফেযদের প্রভাব। ফিরক্বায় ফিরক্বায় বিভক্ত হয়ে মুসলিম উম্মাহ ক্রমেই বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল।
উম্মাহর এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে আল্লাহর ইচ্ছায় ওঘুজ তুর্কদের ক্ষুদ্র এক গোত্র ‘কিনিক’ থেকে ধুমকেতুর ন্যায় আগমণ ঘটে সালতানাতে সেলজুক এর। সেলজুকদের আদি নিবাস ছিল তুর্কিস্তান-চীনের মধ্যবর্তী এলাকায়। একাদশ শতাব্দীতে কিনিক গোত্রের একটি দলের প্রধান সেলজুক ইবনে একায়েক এর সাথে তুর্কি সম্রাটের মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি হিজরত করে সীরদরিয়া নদীর নিকটে এসে আবাস স্থাপন করেন ও দ্বীনে ইসলাম কবুল করেন। তারা প্রথমে ইরানের সামানি সাম্রাজ্য ও পরবর্তীতে গজনভীর সুলতান মাহমুদের সীমান্ত প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। সেলজুক এর দুজন নাতি ছিলেন, তুগরিল বে ও চাগরি বে। তুগরিল বে-ই মূলত গযনবীদের কাছ থেকে যুদ্ধের মাধ্যমে অনেক এলাকা দখল করেন ও সেলজুক সালতানাতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একদিকে সেলজুকদের প্রভাব ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল, অপরদিকে শিয়াদের প্রভাবে জর্জরিত আব্বাসি খলিফা খুঁজছিলেন কোনো সুন্নি মিত্র, যে কিনা বাগদাদ আক্রমণ করে রক্ষা করবে খিলাফাহকে। অতএব খলিফা তুগরিল বে-এর সাথে মিত্রতা স্থাপন করলেন। তুগরিল বে বাগদাদ আক্রমণ করলেন, বিতাড়িত করলেন শিয়াদের। খলিফা অত্যন্ত খুশি হয়ে তুগরিল বে কে সুলতান উপাধিতে ভূষিত করলেন।
সুলতান আলপ আরসালান :
বীর মুজাহিদ তুগরিল বের কোনো সন্তান ছিলোনা। তুগরিল বের মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন তার ভাই চাগরি বে এর ছেলে, আল্প আরসালান। তাঁর প্রকৃত নাম মুহাম্মদ। সামরিক দক্ষতা, বীরত্ব এবং লড়াইয়ে পারদর্শিতার জন্য তিনি ‘আল্প আরসালান’ বা ‘বীর সিংহ’ উপাধি লাভ করেন। আল্প আরসালান তাঁর চাচার মৃত্যুর পর যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখন তাঁর রাজত্বের বিস্তৃতি ছিল আমু দরিয়া থেকে দজলা নদী পর্যন্ত – অর্থাৎ বর্তমানে প্রায় তুর্কমেনিস্তান থেকে ইরাক পর্যন্ত।
সুলতান আল্প আরসালান ক্ষমতাসীন হয়ে দু’টি বিষয়ে দৃষ্টিপাত করেন। এক – ফাতিমি রাফেযিদেরকে দমন করে তাদের প্রভাব কমিয়ে আনা। এবং দুই – উম্মাহকে জিহাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা।
ফাতিমি শিয়াদের বিরুদ্ধ সুলতান প্রথম পদক্ষেপ নেন ৪৬২ হিজরি, ১০৬৯ ঈসায়ি সনে। তিনি মক্কার তৎকালীন শাসকের দূত মুহাম্মদ ইবনে আবু হাশিম এর সাথে হওয়া এক সাক্ষাতে মক্কা-মদীনার মসজিদে ফাতিমিদের নামে জুমুআর খুতবা পড়ানো ও আযানে শিয়া রীতি-নীতি বন্ধ করার নির্দেশ দেন। মক্কার শাসক খুশিমনে তাঁর এই প্রস্তাব মেনে নেন। এরপর সুলতান সিরিয়ার আলেপ্পোতেও সামরিক চাপ সৃষ্টি করে জুমুআর খুতবায় খলিফা ও তাঁর নিজের নাম নিতে আদেশ করেন এবং আযানে শিয়া রীতি-নীতি বন্ধ করেন।
ঐতিহাসিক মানযিকার্টের যুদ্ধ :
সুলতানের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল বিক্ষিপ্ত মুসলিম উম্মাহকে জিহাদের চেতনায় উজ্জিবীত করা। এই লক্ষ্যে তিনি রোমানদের বিরুদ্ধে এনটিওক এবং এডেসায় জিহাদ পরিচালনা করেন। নিজের ছেলে মেলিক শাহ এবং প্রধান উজির নেযামুল মূলক এর নেতৃত্বে রোমানদের অনেকগুলো কেল্লা তিনি বিজয় করেন। কায়সারিতে তিনি বাইযান্টিনদের সাথে যুদ্ধ করেন।
কিন্তু সুলতান তুগরিল এবং আল্প আরসালানের একের পর এক বিজয় বাইযান্টিনদের তৎকালীন সম্রাট রোমানোস ডিওগেনেসকে চিন্তায় ফেলে দেয়। সেলজুকদের থামাতে সে ১০৬৮ সাল থেকে সেলজুকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতি ও গোত্র থেকে সৈন্য সংগ্রহ করছিল। সে সিভাস এবং মালাতইয়া শহরে দুটি সৈন্যবাহিনী পাঠায় এবং নিজে আরো একটি বাহিনী নিয়ে বর্তমান তুরস্কের হারপুত অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু সুলতান আল্প আরসালান ১০৬৯ সালে আনাতোলিয়ার কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচিত কোনিয়া শহর এবং আশেপাশের অনেকগুলো শহর বিজয় করে ফেলায় রোমানোস ভীত হয়ে সৈন্য সংগ্রহ বন্ধ করে এবং পিছু হটে ইস্তাম্বুল ফিরে যায়। অভ্যন্তরীন বিভিন্ন কোন্দলের কারণে ইস্তাম্বুল থেকে সে ১০৭০ সাল পর্যন্ত বেরই হতে পারেনি। ফলে সিভাস এবং মালাতইয়া এর সৈন্য বাহিনীদ্বয় এবং হারপুতের জন্য তৈরি করা বাহিনী নেতৃত্বের অভাবে সেলজুকদের বিরুদ্ধে কার্যত কিছুই করতে পারেনি।
রোমানোস পরিকল্পনা পরিবর্তন করলো। সে ১০৭১ সালের ১৩ মার্চ আগের চেয়েও শক্তিশালী এক বাহিনী নিয়ে হাজিয়া সোফিয়া গির্জায় বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং সেলজুকদের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্য প্রার্থনা করে। তার চিন্তা ছিল বর্তমান ইরানে অবস্থিত সেলজুক রাজত্বের কেন্দ্রে সরাসরি আঘাত হানা এবং সবকিছু তছনছ করে দেয়া। বিভিন্ন ইতিহাসবিদের বর্ণনামতে, রোমানোসের এই বাহিনীতে ছিল প্রায় ৬ লক্ষ সেনা। আবার অনেকে বলেন বাহিনীতে ২ লক্ষ সেনা ছিল, যাদের মধ্যে ছিল পেশেনেগ, উয, কিপচাক, কাসপিয়ান, বলকান অঞ্চলের তুর্ক, স্লাভ, আর্মেনিয়ান ও আরো জাতিগোষ্ঠীর সেনা। তারা ছিল তৎকালীন সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। ইমাম আয-যাহাবি এই যুদ্ধ সম্পর্কে লিখেছেন, এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সেনাদের সারি ছিল। আর ঐতিহাসিক ইয়াফেই এই যুদ্ধকে অভিহিত করেছেন ‘আল মালহামাতুল ক্বুবরা’ বা মহাযুদ্ধ নামে।
২৩ আগস্ট রোমানোসের এই বিশাল বাহিনী মানযিকার্টে পৌঁছে যায় এবং মানযিকার্ট দূর্গ দখল করে নেয়। বিশাল এই বাহিনী শুধু মানযিকার্ট ও সেলজুক ভূমি নয়, বরং স্বপ্ন দেখছিল বিশ্বজয়ের। বাহিনীর কমান্ডার ও জায়গীররা আগেভাগেই কোন এলাকা দখলের পর কে শাসনভার পাবে তা ঠিক করে নিচ্ছিল। রোমানোস তার এক সেনাপতিকে বাগদাদের শাসনভার দিয়ে নির্দেশ দেয়, বাগদাদ দখলের পর খলিফার সাথে যেন সে খারাপ আচরণ না করে।
মানযিকার্টের ময়দানে তারা যখন রাজ্য ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, সুলতান আল্প আরসালান তখন ব্যস্ত আযারবাইজানে এক অবরোধে। সুলতানের কাছে তখন মানযিকার্টের খবর এসে পৌঁছে। তিনি এত বড় বাহিনীর আগমণের খবর শুনে চিন্তায় পড়ে যান। কারণ তিনি আযারবাইজানের জন্য কেবল ১৫ হাজারের মত সেনা সাথে নিয়ে এসেছিলেন। সেলজুক ফৌজের অন্য সেনারা ছিল বিভিন্ন কেল্লা ও শহরে, যাদের স্বল্প সময়ে একত্রিত করা সম্ভব ছিল না। সুলতান আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে মানযিকার্টের দিকে রওয়ানা হলেন।
সুবহানআল্লাহ! কতই না সাহসি ছিলেন সুলতান আল্প আরসালান। কোথায় ২ লক্ষ সুসজ্জিত সেনা আর কোথায় ১৫ হাজার! এরই মধ্যে আবার যাত্রাপথে তিনি মুখোমুখি হলেন রোমানোসের সম্মুখ সারির যোদ্ধাদের, যারা সংখ্যায় ছিল ১০ হাজার। সংক্ষিপ্ত অথচ রক্তাক্ত এক যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে এই বাহিনীকে তিনি পরাজিত করে এর কমান্ডারকে গ্রেফতার করেন এবং মানযিকার্টের কাছে পৌঁছে যান। তিনি শেষবারের মত রোমানোসকে সুযোগ দিয়ে শান্তিচুক্তির আহবান করে দূত পাঠান। রোমানোস দূতকে প্রত্যাখ্যান করে এই বলে, “আমি অনেক সম্পদ ব্যয় করে এই বাহিনী তৈরি করেছি আজকের এই পরিস্থিতির জন্যই। সুতরাং আমি কোনো চুক্তির মুখাপেক্ষী হব না; আমি মুসলিম ভূমির সেই অবস্থাই করব যা তোমরা করেছিলে আমাদের ভূমির সাথে। আমি এমন এক বাহিনী নিয়ে এসেছি, তুমি যার মোকাবেলা করতে পারবে না। তাই স্বেচ্ছায় আমার আনুগত্য মেনে নাও।”
সুলতান আল্প আরসালান রোমানোসের এই জবাবে ক্ষুব্ধ হলেন। রোমানোসের পাঠানো দূতকে তিনি বললেন, “যাও, তোমার মনিবকে বল, আমার রব আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন যাতে করে আমি তাঁর শুকরিয়া জ্ঞাপন করতে পারি। আর আমার রব তোমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন যেন তোমরা মুসলিমদের খাবার রান্না কর।”
উত্তপ্ত এসব কথোপকথন নিশ্চিত করে দেয়, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবি। সেনারা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সুলতান নিজেও যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নেন।
বাহ্যত, এই যুদ্ধে মুসলিমদের জয়ের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। তবে কুফফারদের সাথে মুসলিমদের তফাত হচ্ছে এই যে – কুফফাররা নির্ভর করে অস্ত্র আর সেনার সংখ্যাধিক্যের উপর। আর মুসলিমগণ জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন শাহাদাতের প্রত্যাশায়, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে। তাঁদের বিশ্বাস – নাসরুম মিনাল্লাহ – বিজয় একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে।
সুলতানকে তাঁর সেনাবাহিনীর ইমাম ও শিক্ষক আবু নাসর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল মালিক আল বুখারি সাহস যোগান এই বলে, “আপনি আল্লাহর দ্বীনের জন্য লড়ছেন, যে দ্বীনকে তিনি পৃথিবীর অন্য সকল দ্বীনের উপর বিজয়ী করার ওয়াদা করেছেন। আমি আশা করি, আল্লাহ এই বিজয় আপনার জন্যই নির্ধারণ করেছেন। আপনি যুদ্ধের জন্য শুক্রবার দুপুরকে বেছে নিন। খতিবরা তখন থাকবেন মিম্বরের উপর, এবং তাঁরা দুয়া করবেন মুজাহিদীনদের জন্য।”
আবু নাসর মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল মালিক আল বুখারি এর এই নসীহত সুলতানের মনে সাহস যোগায় এবং তাঁকে আরো উদ্দীপ্ত ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
বিভিন্ন কেল্লা থেকে রিইনফোর্সমেন্ট আসার পর সবশেষে সেলজুক সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ হাজারে। বিপরীতে বাইযান্টিনদের ছিল ২ লক্ষ সেনা। তাদের নেতৃত্বে ছিল স্বয়ং রোমানোস, এবং নিকেফোরোস ব্রাইয়েননিওস, আলিয়েত্তেস ও এন্ড্রোনিকোস ডুকাস এর মত কমান্ডার। কিন্তু তাদের বড় একটি দূর্বলতা ছিল অনৈক্য, কেননা সম্রাট বিভিন্ন জাতির লোক তার ফৌজে শামিল করেছিল, যারা প্রত্যেকেই চাইত নিজেরা নেতৃত্ব দিতে। অপরদিকে সুলতান তাঁর সাথে আফসিন পাশা, সুনদুক, আইতেগিন, জেভেরাইন এর মত ঝানু কৌশলবিদদের নিয়ে এসেছিলেন, যারা আনাতোলিয়ার প্রতিটি কোনা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন। সুলতানের সাথে আরো ছিলেন তুতাক, দানিশমানদ, সালতুক, মেংগুচুক, চাভ্লি – এদের মত দক্ষ কমান্ডার।
৪৬৩ হিজরির ২০ যুলকাদ্দাহ, ২৬ আগস্ট ১০৭১ ঈসায়ীতে সুলতান আল্প আরসালান যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। সুলতান তাঁর লশকরের সাথে জুমুআর সালাত আদায় করলেন। সালাতের পর মুনাজাতে তিনি প্রাণ খুলে আপন রবের নিকট কাঁদলেন। তাঁর কান্না দেখে পুরো লশকর কান্নায় ভেঙে পড়ে।
তিনি যুদ্ধের আগ মূহুর্তে ফৌজকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “আমরা একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে আজ এখানে উপস্থিত হয়েছি। এই যুদ্ধে হয়তো আমি লক্ষ্য অর্জন করে গাজি হবো, নয়তো শহীদ হয়ে জান্নাতে যাবো। আমি যদি মারা যাই, তাহলে আমার পুত্র মালিক শাহ আমার উত্তরাধিকারী হবে। তোমাদের মধ্যে যার ইচ্ছা হয় আমাকে অনুসরণ কর, যার ইচ্ছা হয় এখান থেকে ফিরে যাও। আজ তোমাদের আদেশ করার জন্য এখানে কোনো সুলতান নেই। আজ আমিও তোমাদের মত একজন সাধারণ যোদ্ধা। যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজেকে সমর্পণ করবে, তার জন্য দুনিয়াতে রয়েছে গণিমত এবং আখিরাতে তার জন্য রয়েছে জান্নাত। আর যে ব্যক্তি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে পলায়ন করবে, তার জন্য দুনিয়াতে রয়েছে অপমান ও লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে তার জন্য অপেক্ষা করছে জাহান্নাম।”
সুলতান এরপর সূরা আনফালের ১৫ ও ১৬ নং আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ إِذَا لَقِيتُمُ الَّذِينَ كَفَرُواْ زَحْفاً فَلاَ تُوَلُّوهُمُ الأَدْبَارَ – وَمَن يُوَلِّهِمْ يَوْمَئِذٍ دُبُرَهُ إِلاَّ مُتَحَرِّفاً لِّقِتَالٍ أَوْ مُتَحَيِّزاً إِلَى فِئَةٍ فَقَدْ بَاء بِغَضَبٍ مِّنَ اللّهِ وَمَأْوَاهُ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কাফেরদের সাথে মুখোমুখী হবে, তখন পশ্চাদপসরণ করবে না। আর যে লোক সেদিন তাদের থেকে পশ্চাদপসরণ করবে, অবশ্য যে লড়াইয়ের কৌশল পরিবর্তনকল্পে কিংবা যে নিজ সৈন্যদের নিকট আশ্রয় নিতে আসে সে ব্যতীত অন্যরা আল্লাহর গযব সাথে নিয়ে প্রত্যাবর্তন করবে। আর তার ঠিকানা হল জাহান্নাম। বস্তুতঃ সেটা হল নিকৃষ্ট অবস্থান।”
এরপর ফৌজের সকল সদস্য একযোগে বলে উঠলেন, “হে সুলতান! আমরা আপনার সাথেই আছি। আপনার যা ইচ্ছা করুন, আমরা আপনার সাথেই আছি।”
সুলতান এরপর ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। শক্ত করে ধরলেন ঘোড়ার লাগাম। এরপর সাদা একটি কাপড় পরিধান করে বললেন, “আজ যদি আমি নিহত হই, তাহলে এই কাপড়ই হবে আমার কাফন।”
এরপর সুলতান ঘোড়া ছুটালেন কুফফার বাহিনীর দিকে।
যুদ্ধের ময়দান :
বাইযান্টিনরা তাদের বিশাল সেনা বাহিনীকে বিন্যস্ত করেছিল ৫টি পৃথক সারিতে। সুলতান আল্প আরসালান তার বাহিনীকে বিন্যস্ত করলেন অর্ধচন্দ্রাকৃতিতে, একটি সারিতে। ফলে তার সেনা সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে বেশি দেখাচ্ছিল। সুলতান আগে থেকে কিছু সৈন্যকে ছড়িয়ে দিয়ে ছোটখাটো গেরিলা কৌশলের যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে ব্যস্ত রাখেন। গেরিলা যুদ্ধের অধিকাংশেই বাইযান্টিনরা পরাজিত হচ্ছিল। চূড়ান্ত যুদ্ধের সময় সুলতান ফৌজের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে চার হাজার জানবায সৈন্যের কমান্ড নিজ হাতে নিয়ে নেন।
মুসলিম শিবিরে আলেমগণ করছিলেন কুরআনুল কারিমের তিলাওয়াত, আর কুফফার শিবিরে বাজছিল যুদ্ধের বাজনা, দামামা ও নাকারা।
তাকবিরের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে কুফফার ফৌজের দিকে এগিয়ে গেলেন সুলতান। সুলতানের কৌশল মোতাবেক মুসলিম ফারিস বা ঘোড়সওয়াররা প্রচন্ড এক চার্জ করেন কুফফারদের সম্মুখ সারিতে। ঘোড়সওয়ারদের উড়ানো ধূলিতে বাইযান্টিন সেনাদের চোখ-মুখ আচ্ছাদিত হয়ে যায়।
ঘোড়সওয়াররা কুফফার সেনাদের মাঝ বরারবর আঘাত করেই পাশে সরে যান। এরপর এগিয়ে আসেন সুলতান নিজে ও তাঁর কমান্ডে থাকা ৪ হাজার এলিট জানবায সেনা। জীবন বাজি রেখে মরিয়া হয়ে তারা লড়াই করে। সুলতান নিজে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে বারবার ছুটে যাচ্ছিলেন কুফফারদের ব্যূহের দিকে। তাঁর আক্রমণ দেখে মুসলিম সেনারা আরো মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাঁদের পাগলের মত আঘাতে সৈন্যরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, উন্মুক্ত হয়ে যায় কুফফারদের সেন্টার। যেখানে ছিল স্বয়ং রোমানোস। ৪ হাজারের এই বাহিনী এবার তার দিকেই ধেয়ে যেতে শুরু করে। রোমানোস অবস্থা বুঝতে পারে ঠিকই, তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে তার সেনাদের বাম অংশে থেকে সাহায্য চাইলেও সুলতানের ফারিস, যারা আঘাত করে পাশে সরে গিয়েছিল তারা বাম ব্যূহকে কচুকাটা করতে থাকে। আর বাইযান্টিনদের ডান ব্যূহের অধিকাংশই ছিল তুর্কি সেনাদের নিয়ে গঠিত। অবস্থা বেগতিক দেখে তাদের কমান্ডার তামিস পক্ষ বদল করে সরাসরি সেলজুক ফৌজে শামিল হয়।
এবার রোমানোস কৌশলগত কারণে তার সেনাদের আদেশ দেয় শিবিরের পিছেন আশ্রয় নিতে। কিন্তু তাকে ভুল বুঝে আর্মেনিয় সেনারা মনে করে সম্রাট পালিয়ে যাচ্ছে, তাই তারাও যুদ্ধের ময়দান ত্যাগ করে। এদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল রিজার্ভ ফোর্স।
এবার পুরো খ্রিষ্টান ফৌজের মধ্যে বিশৃঙ্খলা লেগে যায়। পলায়নরত সেনাদের ইচ্ছেমত কচুকাটা করেন মুসলিম সেনারা। সেদিন দুপুর নাগাদ দুই লক্ষের বিশাল এই বাহিনী টিকে থাকে, এরপর একে একে সবাই মারা যায় কিংবা গ্রেফতার হয়। অনেক খ্রিষ্টান কমান্ডারকে গ্রেফতার করা হয়। স্বয়ং রোমানোসকে এক সেলজুক সিপাহি সাধারণ সৈন্য ভেবে কতল করে ফেলত, কিন্তু রোমানোস এর দাস সেই সিপাহিকে অনুনয় বিনয় করায় সে তাকে বন্দী করে সুলতানের কাছে হাজির করে।
সুলতান আল্প আরসালান রোমানোসকে হত্যা করেননি। তাকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে রাখা হলেও তার সাথে খারাপ আচরণ করা হয়নি। সুলতান তাকে চুক্তি সম্পাদন করতে বলেন, যার শর্তগুলো ছিল:
– প্রথমে ১৫ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা সুলতানকে দিতে হবে।
– বার্ষিক ৩ লক্ষ ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা করস্বরূপ দিতে হবে।
– সব মুসলিম বন্দিদের মুক্ত করতে হবে।
– বাইযান্টিনরা চাহিবামাত্রই সেলজুকদের সামরিকভাবে সহায়তা করবে।
– সম্রাট তার কোনো এক মেয়েকে সুলতান আল্প আরসালানের ছেলের সাথে বিবাহ দিবে।
– আনতাকিয়া, উরফা, মানবিজ এবং মানযিকার্ট সেলজুকদের অধিকারে থাকবে।
একদিন পর সুলতান আল্প আরসালান রোমানোসকে ২ জন কমান্ডার ও ১০০ সেনা সহ ইস্তাম্বুল পাঠিয়ে দেন। আর বাইযান্টিন সিনেট এই পরাজয়ের খবর শোনামাত্রই রোমানোসকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। আর রোমানোসকে তার নিজের সেনারাই কুথায়া নামক দূর্গে বন্দী করে রাখে। আর তার দুএক বছরের মধ্যেই কিনালিয়াডা দুর্গে সে মারা যায়।
আর সুলতান আল্প আরসালান বিজয়ের পর সব মুসলিম শাসকদের বিজয়ের বার্তা পৌঁছে দেন। বিশেষ করে আব্বাসি খলিফাকে তিনি খাস করে পত্র লেখেন। পুরো মুসলিম জাহান এই বিজয়ে উল্লাসিত হয়। খলিফা কাইম বি-আমরিল্লাহ মূল্যবান তোহফা সমেত শুভেচ্ছাপত্র পাঠান সুলতানকে। এর সাথে সাথে তৎকালীন সব মুসলিম কবি ও সাহিত্যিক তাদের রচনায় সুলতানের ভূয়সী প্রশংসা করেন। অনেক মুসলিম শাসক শুভেচ্ছাপত্রের সাথে মূল্যবান উপহার প্রেরণ করেন সুলতানকে।
আর এভাবেই আল্লাহর উপর গভীর তাওয়াক্কুল বিজয়ী করেছিল এক সুলতানকে!
আজকের এই দিনের সেই বিজয় আজও মুসলিমদের অন্তরে অনুপ্রেরণা দিয়ে যায়; মুসলিমরা যেন আবার সেই রোমানোসের উত্তরসূরিদেরকে মুসলিম ভূমিগুলো থেকে বিতারিত করে উম্মাহর হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনেন। আর এখন তো শুধু মুসলিম ভূমি পুনরুদ্ধারই নয়, সেই সাথে কুফফারদের ভূমিতেও উড়ানো হবে কালেমার সম্মানের পতাকা। । বিইযনিল্লাহ। ।
লিখেছেন : ত্বহা আলী আদনান
Insaallah
আল্লাহু আকবার!
মুসলিমরা যে বিরের জাতি তা এই যুগের মানুষ ভুলেই গিয়েছিলো আর ভুলেই থাকতো যদি আল্লাহর ইচ্ছায় আল কায়দা তালিবানের উত্থান না হতো।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে হারানো সম্মান ফিরিয়ে আনার তাওফিক দান করুন!
ইতিহাসের মুসলিম বীর সেনানিদের নিয়ে ধারাবাহিক লেখনি চাই
মাশাআল্লাহ আল কায়দা, তালেবান মুজাহিদ ভাই। ইনশাআল্লাহ এভাবে ইসলামের বিজয় আসবেই।