ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুরে গত কয়েক মাস ধরেই হিন্দুপ্রধান মেইতেই এবং খ্রিস্টান প্রধান কুকি-জোমি জাতিগোষ্ঠীর সংঘাত চলছে। এপর্যন্ত শত শত হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, চলছে বিরোধীপক্ষের স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগ, এমনকি ধর্ষণও। ভারত সেখানে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করলেও সংঘাত দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
মনিপুরে রাজ্যে প্রায় ৩ লাখের মতো পাঙ্গাল মুসলিমের বসবাস। আর মুসলিমরা মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৯-১০ ভাগ; যেখানে ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মনিপুরের মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৪১.৩৯ ভাগ হিন্দু আর ৪১.২৯ ভাগ খ্রিস্টান।
খ্রিস্টান আর হিন্দুদের সংঘর্ষের মধ্যে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছিলেন মুসলিমরা; কিন্তু দিন গড়িয়ে সংঘর্ষ ধীরে ধীরে স্থায়ী হতে থাকলে মুসলিমরাও ধীরে ধীরে উভয় পক্ষের সন্দেহের দৃষ্টিতে পড়তে থাকে। হিন্দু-খ্রিস্টান উভয় পক্ষ থেকেই এখন আক্রমণের আশংকা করছেন মুসলিম নেতারা।
সাম্প্রতিক সংঘাত শুরুর পর থেকেই পাঙ্গাল মুসলিম নেতারা খুবই সতর্ক ছিলেন, যেন পাঙ্গাল মুসলিমরা মেইতেই-কুকি সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ে। এমনকি নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তারা মে মাসে সংঘাত শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই ইউনাইটেড মেইতেই পাঙ্গাল কমিটি মণিপুর বা ইউএমপিসি নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ইউএমপিসি নেতারা শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে আসছেন। তারা পাঙ্গাল অধ্যুষিত কোয়াকটা শহরে একটি ত্রানশিবিরও পরিচালনা করছেন।
তবে পাঙ্গাল মুসলিমরা নিজেদের মেইতেই জাতির অন্তর্ভুক্ত দাবি করলেও তারা মেইতেই বা কুকি কারও পক্ষে-বিপক্ষেই কোনও বিবৃতি দেননি, উভয় পক্ষকেই শান্তি স্থাপনের কথা বলেছেন।
মেইতেইদের সাথে বিরোধ
পাঙ্গাল মুসলিম অধ্যুষিত কোয়াকটা শহরের অবস্থান মেইতেই-প্রধান বিষ্ণুপুর জেলায়, একই সাথে শহরটি কুকি-জোমি প্রধান চূড়াচাঁদপুর জেলার সীমান্তে অবস্থিত। হিন্দু মেইতেই প্রধান বিষ্ণুপুর জেলাস্থ কোয়াকটা শহরটির ৯০ শতাংশেরও বেশি বাসিন্দা মুসলিম ধর্মাবলম্বী, ভোটারদের ৮৫ শতাংশও তারা। আর হামলার ভয়ে এই কোয়াকটা শহর থেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন পালিয়ে যাচ্ছেন পাঙ্গাল মুসলিমরা।
মণিপুরের মুসলিম তথা পাঙ্গালরা নিজেদেরকে মেইতেইদের মধ্যে গণ্য করেন; একারণে তারা নিজেদের সংগঠনের নামও দিয়েছেন ইউনাইটেড মেইতেই পাঙ্গাল কমিটি। তবে নিকট অতীতে হিন্দুপ্রধান মেইতেইদের সাথে পাঙ্গালদের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার কিছু ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৩ সালে; রাজ্যের থৌবাল জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের সাম্প্রদায়িক হামলায় শতাধিক মুসলিম নিহতের ঘটনা ঘটেছিল তখন।
এবারের মেইতেই-কুকি সংঘর্ষ শুরুর চার মাস পর গত ৬ আগস্ট পাঙ্গাল মুসলিম অধ্যুষিত কোয়াকটা শহরে তিনজন হিন্দু মেইতেই নিহতের ঘটনা ঘটে। পুলিশ বলছে, এই খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজনরা কুকি সম্প্রদায়ের। তবে মেইতেইরা সন্দেহ করেছে যে, স্থানীয় পাঙ্গাল মুসলিমরাই হয়তো এই হত্যাকান্ড ঘটাতে পার্শ্ববর্তী চূড়াচাঁদপুরের কুকি-জোমিদের সাহায্য করে থাকবে। ঘটনার পর থেকেই এমন গুঞ্জন বাতাসে ছড়িয়ে পরে। অথচ এই হত্যাকাণ্ডের সাথে মুসলিমরা কোনভাবেই জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন পাঙ্গাল নেতারা।
মেইতেইদের তরফ থেকে প্রতিশোধের আশংকায় তাই এখন পাঙ্গাল মুসলিমরা নিজেদের শহর-গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ইতিমধ্যে খালি হয়ে গেছে মুসলিম অধ্যুষিত গোটা একটি গ্রামও।
কুকিদের সন্দেহ
কোয়াকটা শহরের খুব কাছেই লেইথান নামের একটি গ্রাম, যেখানে মুসলিমরা সংখ্যায় অধিক। কোয়াকটা শহরে ৩ জন মেইতেই নিহতের পর হামলার আশংকায় গ্রামটি পুরোপুরি খালি করে দিয়ে সেখানে বসবাসকারী পাঙ্গালরা অন্যত্র পালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ থেকেই শুরু হয় মুসলিমদের প্রতি কুকিদের সন্দেহ।
মুসলিমরা লেইথান গ্রাম থেকে সরে যাওয়ার পর সেই খালি গ্রামের দখল নিয়ে সশস্ত্র মেইতেইরা সেখানে তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলেন। আর লেইথান গ্রামের ঘাঁটি থেকেই পার্শ্ববর্তী চূড়াচাঁদপুরের কুকি ও জোমিদের উপর হামলা চালাতে থাকে সশস্ত্র মেইতেইরা।
এখন খ্রিষ্টান কুকি-জোমিরা ভাবতে শুরু করেছে যে, পাঙ্গাল মুসলিমরা হয়তো মেইতেইদের সাথে হাত মিলিয়েছে, এবং তাদের ওপর হামলা করার জন্য মেইতেইদেরকে নিজেদের গ্রামে ঘাঁটি গড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। এমন গুঞ্জনও এখন জোরালোভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মনিপুরজুড়ে।
পাঙ্গাল মুসলিমরা এখন তাই কুকি-জোমিদের দিক থেকেও হামলার হুমকি অনুভব করছেন।
গত ১৮ আগস্ট তারিখে পাঙ্গাল মুসলিমের সংগঠন ইউএমসিপির নেতারা দিল্লির ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তারা মণিপুর সঙ্কটে সেখানকার মুসলিমদের দুর্দশার দিকটি জাতীয় পর্যায়ে মূল ধারার মিডিয়ায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এর আগে তারা পাঙ্গাল মুসলিমদের দুর্গতির কথা উল্লেখ করে এবং মনিপুরে শান্তি ফিরানোর আহবান জানিয়ে স্মারকপত্র পৌঁছে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কার্যালয়ে।
নিজেদের অবস্থা বর্ণনা করে ইউএমসিপি মণিপুরের আহ্বায়ক মাওলানা মুহিউদ্দিন বলেছেন, “রাজ্য জুড়ে জাতিভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে রমরমা অবস্থা শুরু হয়েছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা পাঙ্গাল মুসলিমরাও তার শিকার হচ্ছি।”
মনিপুরের মুসলিমরা এখন আতংকিত। সংঘাত শুরুর পর থেকে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন মুসলিম মেইতেই-কুকিদের গোলাগুলির মাঝে পরে হতাহত হয়েছেন; কোয়াকটা শহরের একটি ব্রিজে আইইডি বিস্ফোরণে কয়েকজন গুরুতর আহতও হয়েছেন। এখন বিবাদমান উভয় পক্ষ যদি মুসলিমদেরকে টার্গেট করতে শুরু করে, তাহলে মুসলিমরা সেখানে অস্তিত্ব সংকটে পরতে পারে। আর এমনটা ঘটার সম্ভাবনাও প্রবল বলেই মনে করা হচ্ছে।
মনিপুরের সংঘাত ছিল মূলত হিন্দুপ্রধান মেইতেই আর খ্রিস্টানপ্রধান কুকি-জোমিদের মধ্যেকার সংঘাত। এখন যদি মুসলিমদের উপর কোন এক পক্ষ হামলা চালাতে শুরু করে, তাহলে এই যুদ্ধ অচিরেই হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানদের ত্রিমুখী সংঘাতে রূপ নিবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
আর বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের যে অংশে কুকি-চিনরা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সশস্ত্র আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে, মনিপুর থেকে সেই এলাকা কিন্তু খুব বেশি দুরে নয়; সেখান থেকে খ্রিস্টান অধ্যুষিত মিজোরাম পার হলেই বাংলাদেশ।
উত্তর-পূর্ব ভারত কেন্দ্রিক পরিস্থিতির নাজুকতা এবং বাংলাদেশ ও আরাকান অঞ্চলের মুসিমদের উপর খ্রিস্টান কুকি-চিন জাতির সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে ধারণা পেতে পড়ুন আল-ফিরদাউসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় “জ্বলছে মনিপুর: উত্তর-পূর্ব ভারত কেন্দ্রিক যুদ্ধ কি তবে শুরু?“
তথ্যসূত্র:
1. After 3 Meiteis killed, town now in crosshairs of Manipur conflict
– https://tinyurl.com/4v8z93st
2. In India’s riot-hit Manipur, Muslims stuck between warring groups
– https://tinyurl.com/mvvaxkpz
3. Pangal Muslim village evacuated in Manipur amid heavy gunfights
– https://tinyurl.com/bdw4p4ae
4. মণিপুর সঙ্কটে যেভাবে দুই পক্ষের রোষের শিকার পাঙ্গাল মুসলিমরা
– https://tinyurl.com/2vuvjah4
5. Manipur News: Local Residents Hold Protest In Violence-Hit Churachandpur In Manipur
– https://tinyurl.com/y8kxn8w9
ইন্নালিল্লাহ। শুত্রু এতো কাছে অথচ আমরা গাফেল, ঘোমের ঘোরে