প্রিয় ভাই, একজন মুসলিম জীবনের প্রতিদিন ও প্রতিক্ষণ হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। এজন্য আল্লাহ তাআলা আমাদের উপর প্রত্যেক নামাযে -اهدِنَا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ- পড়া ফরজ করেছেন। যার অর্থ: আমাদেরকে সুদৃঢ় পথের হেদায়াত দান করুন। নিশ্চয়ই একজন মুসলিম প্রতিদিন হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। কিছুলোক আছে যাদের জিজ্ঞাসা করলে বলে, আলহামদুলিল্লাহ, আমি হেদায়াতপ্রাপ্ত। আমি নামায, রোযা, তাযকিয়া ইত্যাদি সবই করি। তাহলে কেন -اهدِنَا الصِّرَاطَ المُستَقِيمَ- বলব? আমি বলি, এজন্য বলতে হবে যেন আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই পথে অটল রাখেন ও হেদায়াত বৃদ্ধি করে দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আলী ইবনে আবু তালেব রাযিয়াল্লাহু আনহুকে এই দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন,
“قل اللهم اهدني وسددني”, وفي رواية: “اللهم إني أسألك الهُدَى والسَّدَادَ”.
অর্থ: (হে আলী) বল, হে আল্লাহ, আমাকে হেদায়াত ও সঠিকতা দান করুন। অপর বর্ণনায় এভাবে এসেছে, হে আল্লাহ, আপনার কাছে হেদায়াত ও সঠিকতা চাই। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-২৭২৫)
লক্ষ করুন! আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে “ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ” শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। তিনি এই দোয়ায় দুইটি শব্দ বলেছেন; হেদায়াত ও সাদাদ। সুবহানাল্লাহ! শব্দদুটি অনেক বিষয়কে একসাথে যুক্ত করে। “সুদৃঢ় পথের হেদায়াত” শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক ও সমন্বয়ক একটি শব্দ। আমরা সবসময় ও সর্বাবস্থায় হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। আমাদের জাহেরি-বাতেনি সর্বাবস্থায় হেদায়াতের প্রয়োজন। বর্তমানে অনেক মানুষই অন্যদের সামনে বাহ্যিকভাবে হেদায়াতপ্রাপ্ত। সে যখন মানুষের সাথে থাকে তখন মাশাআল্লাহ তাকে সুদৃঢ় পথের পথিক ও হেদায়াতপ্রাপ্ত দেখতে পাবেন। কিন্তু যখন মানুষ থেকে পৃথক হয় এবং সে ও আল্লাহ ছাড়া কেউ থাকে না, তখন আল্লাহ তাআলার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। এই ব্যক্তির ব্যাপারে বলব, আপনি মানুষের সাথে থাকলে হেদায়াতপ্রাপ্ত থাকেন। কিন্তু, মানুষ থেকে আলাদা থাকলে হেদায়াত থেকে দূরে থাকেন।
দ্বিতীয়ত: আমাদের জাহেরি-বাতেনি তথা বাহ্যিক-আভ্যন্তরিক সর্বাবস্থায় হেদায়াতের প্রয়োজন। কত মানুষ বাহ্যিকভাবে দ্বীনদার, অটল ও হেদায়াতপ্রাপ্ত। কিন্তু অভ্যন্তরীণভাবে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর নেই। সে অহঙ্কার, প্রতারণা, আত্মম্ভরিতা, মুমিনদের প্রতি ঘৃণা, নিফাকি, হিংসা-বিদ্বেষ ইত্যাদি নানাবিধ আত্মিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। এই ব্যক্তির ব্যাপারে বলব, আপনি বাহ্যিকভাবে হেদায়াতের উপর আছেন। কিন্তু, অভ্যন্তরীণভাবে হেদায়াতের উপর নেই। আপনার অন্তর নানাবিধ ব্যাধিতে আক্রান্ত। এর সুস্থতার জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন।
তৃতীয়ত: অন্যদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও আমরা হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। অনেক মানুষই অন্যদের সাথে সম্পর্ক ও লেনদেনের ক্ষেত্রে সততা, স্পষ্টতা ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখে না। বরং অন্যদের সাথে ধোঁকা, প্রতারণা, মিথ্যা, মারপ্যাঁচ, ঘুরানো-ফিরানো ও ছলচাতুরি করে।
চতুর্থত: আমরা পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্কের ক্ষেত্রেও হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। কীভাবে? কিছু মানুষ মাশাআল্লাহ পিতামাতার অনুগত সন্তান। তাঁদের সাথে সদাচারী। এক্ষেত্রে সে হেদায়াতের উপর আছে। আল্লাহ তাকে জাযা দান করুন। কিন্তু স্ত্রীর সাথে সে সদাচরণ করে না। তাকে প্রহার করে, তাচ্ছিল্য করে, গালাগালি করে, তার উপর জুলম করে। এ ব্যক্তির ব্যাপারে বলব, সে পিতামাতার ক্ষেত্রে হেদায়াতের উপর আছে। কিন্তু, স্ত্রীর ক্ষেত্রে হেদায়াতের উপর নেই।
পঞ্চমত: আমাদের চোখ, কান, যবান ইত্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রেও আমরা হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। অনেকের চোখ মাশাআল্লাহ হেদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত। সে হারাম দেখে না, নারীর দিকে তাকায় না, মুভি দেখে না। কিন্তু তার যবান হেদায়াতের উপর নেই। তার যবানে অন্যদের গীবত, পরনিন্দা, মিথ্যা, প্রতারণা, গালি, তাচ্ছিল্য, হেয়জ্ঞান ইত্যাদি বিদ্যমান। এই ব্যক্তির চোখ হেদায়াতের উপর থাকলেও যবান হেদায়াত থেকে দূরে রয়েছে।
প্রিয় ভাই, আমরা সবসময় ও সর্বাবস্থায় হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। আজ, আগামীকাল, পাঁচ-দশ বছর পর, সবসময় সুদৃঢ় পথের হেদায়াতের মুখাপেক্ষী। এজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোয়া করতেন,
“يا مقلّب القلوب ثبّت قلبي على دينك”
অর্থ: হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী, আমার অন্তর আপনার দ্বীনের উপর সুদৃঢ় করে দিন।
কত মানুষ রমাদানে হেদায়াতের উপর থাকে। কিন্তু রমাদান শেষে শয়তান হয়ে যায়! আমাদের উচিত “সুদৃঢ় পথের হেদায়াত” শব্দটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করা উচিত,
يَا رَبّ اهدِنِي فِي جَمِيعِ أمُورِي, فِي جَمِيعِ أَحوَالِي الدِينِيةِ وِالدُنيويَة, فِي أَفْكَارِي, فِي آرَائِي, فِي موَاقَفِي
অর্থ: হে রব, আমাকে দ্বীনী-দুনিয়াবী, ফিকির-গবেষণা, রায়-মতামত, অবস্থান ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে হেদায়াত দান করুন।
এই সকল বিষয়াদিতে আপনি আল্লাহর তরফ থেকে হেদায়াতের প্রতি খুবই মুখাপেক্ষী।
হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুকে শেখানো দোয়ার মাঝে ব্যাপক অর্থবোধক দ্বিতীয় শব্দটি হচ্ছে, “وسدّدني” অর্থাৎ, আমাকে সঠিকতা দান করুন। السداد শব্দটির অর্থ হচ্ছে সঠিক হওয়া। “اللهم اهدني وسدّدني” এই দোয়াটি মুখস্থ করে নিন। اهدني অর্থাৎ, আমাকে হেদায়াতের তাওফীক দিন, আমার জন্য হেদায়াত সহজ করে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি দোয়া ছিল,
“اللهم اهدني ويسّر الهدى إليّ”
অর্থ: হে আল্লাহ, আমাকে হেদায়াত দিন এবং আমার জন্য হেদায়াত সহজ করে দিন।
কত মানুষ আছে যাদের জন্য হেদায়াত লাভের আসবাব সহজ নয়। আল্লাহর কাছে এই দোয়াটিও করুন “اللهم اهدني ويسّر الهدى إليّ”।
হেদায়াত সহজ করেন কে? একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সহজ করেন। তিনি সহজ করে দিলে আনুগত্য-ইবাদত সবকিছু আপনার কাছে সহজ লাগবে।
যেমনটি বলেছি, السداد শব্দটির অর্থ হচ্ছে সঠিক হওয়া। দোয়াটি করলে আল্লাহ তাআলা আপনার কথা, কাজ ইত্যাদি সঠিক করে দেবেন। আপনার কথা ও কাজে বাতিলের মিশ্রণ থাকবে না। কোনও মন্দ থাকবে না, কোনও হারাম থাকবে না।
আমরা সর্বদাই এই দোয়াটির প্রতি মুখাপেক্ষী। আমাদের নামাযে, সিজদায়, নামাযের বাইরে, আসা-যাওয়ায় এই দোয়াটি করব,
“اللهم اهدني وسددني”, “اللهم إني أسألك الهداية وأسألك الهدى والسداد”,
সর্বদা হেদায়াত ও সাদাদের দোয়া করব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হেদায়াত দান করুন। সকল ক্ষেত্রে সঠিক হওয়ার তাওফীক দান করুন, আমীন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম