প্রিয় ভাই, কেউ কেউ প্রশ্ন করে যে, কীভাবে আমি আল্লাহর শোকরগুজার বান্দা হব?
একটি বস্তু সবসময় একজন মুসলিমের সাথে প্রতিটি দিনে-রাতে প্রতিমুহূর্তে সকল ক্ষেত্রে বারবার আসতে থাকে। তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নেয়ামত। আমাদের উচিত সব সময় আল্লাহ তাআলার এই নেয়ামতের স্মরণ করা এবং শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَئِن شَكَرْتُمْ لأَزِيدَنَّكُمْ-
অর্থ: যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর তাহলে তোমাদেরকে নেয়ামত বাড়িয়ে দেব।
এটা আল্লাহ তাআলার ওয়াদা। তিনি কখনও ওয়াদা ভঙ্গ করেন না।
তিনি আরও বলেন, ثُمَّ لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيمِ
অর্থ: সেদিন তোমাদেরকে নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
আল্লাহ তাআলা কেয়ামত দিবসে তাঁর নেয়ামত সম্পর্কে আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। সেই নেয়ামতগুলো কী? উলামায়ে কেরাম বলেন, শরীরের সুস্থতা একটি নেয়ামত, ঠাণ্ডা পানি একটি নেয়ামত। যেই নেয়ামত সম্পর্কে কেয়ামতের দিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উলামাগণের মাঝে ইখতিলাফ হয়েছে। তাবেঈ বকর ইবনে আব্দুল্লাহ আল-মুজানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, “হে বনী আদম, যদি তুমি তোমার উপর আল্লাহ তাআলার নেয়ামত সম্পর্কে জানতে চাও, তাহলে শুধু দুচোখ বন্ধ কর”। এক ঘণ্টা বন্ধ রাখার কথা বলছি না; মাত্র পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখুন। তারপর চিন্তা করুন, এই দুনিয়া কেমন দেখছেন। এটি কেবল চোখের নেয়ামত।
আল্লাহর নেয়ামত সম্পর্কে তিনি বলেন, وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَتَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا
অর্থ: যদি তোমরা আল্লাহর নেয়ামতরাজি গণনা কর তাহলে শেষ করতে পারবে না।
আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার কতগুলো নেয়ামত রয়েছে? এক বিলিয়ন? না; শতশত বিলিয়ন। এক আলেম বলেন, একজন ব্যক্তি দৈনিক চব্বিশ হাজারবার নিঃশ্বাস গ্রহণ-ত্যাগ করে। এখানেই চব্বিশ হাজার নেয়ামত। চোখের নেয়ামত, হাতের নেয়ামত, পায়ের নেয়ামত, যবানের নেয়ামত, কানের নেয়ামত ইত্যাদি আরও কত নেয়ামত। এই নেয়ামতগুলো মহান ও বিশাল। আমরা কি আল্লাহর এই নেয়ামতগুলো অনুধাবন করব না? আমরা প্রতিদিন কত খবর শুনি, আপনি কত খবর শুনেন। প্লাবন, ভূমিকম্প, যুদ্ধ, সংকট, ঘুর্ণিঝড়, মহামারি, রোগ ইত্যাদি কতকিছুর খবর শোনেন। এগুলো পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে শোনেন। এই খবরগুলো শুনে আপনার অবস্থান কী হওয়া উচিত? আপনার উচিত আপনার নিরাপত্তালাভের জন্য আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করা। সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার, তিনি আমাদেরকে এসকল বিপদ-মুসীবত থেকে নিরাপদ রেখেছেন।
আপনি মসজিদে যাওয়ার পথে আল্লাহ তাআলার নেয়ামতের কথা স্মরণ করুন। তিনি দয়া করে আপনাকে নামাযী বানিয়েছেন। বিশেষ করে ফজরের সময় দেখবেন মুসলিমদের ঘরগুলো কেমন নিস্তব্দ, সকলে ঘুমে আচ্ছন্ন, যেন তারা মৃত। লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। এটি আল্লাহর নেয়ামত। এটি কেবল আপনার চেষ্টা ও আপনার বুদ্ধির মাধ্যমে লাভ করেননি। এটি একমাত্র আল্লাহ তাআলার তাওফীকে হয়েছে। তিনি আপনাকে এই নেয়ামত দিয়েছেন, এর তাওফীক দিয়েছেন। ফলে মুসলিমদের সাথে মসজিদে যেয়ে নামায আদায় করতে পেরেছেন।
আমাদের উপর আল্লাহর নেয়ামত অসংখ্য, অগণিত। আপনি যখন রাস্তায় চলাচল করেন, তখন কত দুর্ঘটনা দেখেন। এগুলো দেখে আল্লাহর প্রশংসা করুন যে, তিনি আপনাকে নিরাপদ রেখেছেন। কিছু মানুষ এসব দেখে চুপ থাকে। না ভাই, চুপ না থেকে বলুন,
الحمد لله الذي عافاني
অর্থ: সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে নিরাপদ রেখেছেন।
আমরা যেন শোকরগুজার বান্দা হতে পারি সেজন্য শোকরের ব্যাখ্যা করে ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, “শোকরের রোকন তিনটি: অন্তরের শোকর, যবানের শোকর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর।
অন্তরের শোকর কীভাবে আদায় করবেন? এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিছুলোক বিস্মিত হয়ে বলে, অন্তরের শোকর কীভাবে আদায় করব? ইবনুল কাইয়্যিম বলেন, মনের গভীর থেকে এটা স্বীকার করুন যে, আপনি যত নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছেন সবই লা-শরীক আল্লাহর পক্ষ থেকে। যদি রাতে নামাযে দাঁড়ান তাহলে এই অনুভূতি সজাগ রাখুন যে, এটি আল্লাহর নেয়ামত। তিনি আপনাকে এর তাওফীক দান করেছেন। তাঁর সামনে দাঁড়ানোর তাওফীক দিয়ে তিনি আপনাকে সম্মানিত করেছেন। যদি কুরআন পড়েন বা হজ্জে যান, যদি আপনার হাতে সম্পদ আসে, যে-ই নেয়ামতই আপনার কাছে আসুক আপনি অনুভূতি জাগ্রত রাখবেন যে, এটি আল্লাহর নেয়ামত। এজন্য সকাল-সন্ধ্যার একটি দোয়া আছে, এ দোয়াটি পড়ার মাধ্যমে আপনি আল্লাহর নেয়ামতের কথা স্মরণ করে শুকরিয়া আদায় করতে পারেন,
“اللهم ما أصبح بي من نعمةٍ أو بأحدٍ من خلقك فمنك وحدك لا شريك لك, فلك الحمد ولك الشكر”
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি ও আপনার সকল মাখলুক যেই নেয়ামতসহ সকালে উপনীত হয়েছি, সেই সকল নেয়ামত একমাত্র আপনার পক্ষ থেকেই এসেছে। আপনি এক, আপনার কোনো শরীক নেই। সুতরাং, আপনারই প্রশংসা ও শোকরিয়া আদায় করছি।
সকালে এই দোয়া পড়লে সারাদিনের নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলেন, সন্ধ্যায় পড়লে সারারাতের নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করলেন। এভাবে আপনার অন্তরের মাধ্যমে আল্লাহর শোকর আদায় করবেন। যেকোনও নেয়ামত লাভ করবেন বা যেকোনও কাজ করবেন তখনই আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের কথা অন্তরে জাগ্রত করবেন। বলবেন না, এটি আমার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও বুদ্ধির মাধ্যমে অর্জন করেছি। না ভাই; আপনি যেই কাজই করেন বলবেন, এটি আল্লাহর অনুগ্রহে করেছি। সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার। হে আল্লাহ, আপনার জন্য প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করছি। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে এই কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন। আপনি যেই নেক আমলই করুন না কেন এভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন।
যবানের শোকর কীভাবে আদায় করব? যবানের শোকর হচ্ছে, যবান দিয়ে আল্লাহর নেয়ামতের কথা আলোচনা করা, সবসময় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَمَّا بِنِعْمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثْ
অর্থ: আপনার রবের নেয়ামতের কথা আলোচনা করুন।
আল্লাহর নেয়ামতের কথা আলোচনা করুন। তিনি আপনাকে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করেছেন তখন বলুন, আলহামদুলিল্লাহ। আপনার যবানে সর্বদা আলহামদুলিল্লাহ জারি রাখুন। ভুলে যাবেন না, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আলহামদুলিল্লাহ মীজান [নেকিতে] পূর্ণ করে ফেলে”। অনেকের মুখ থেকেই এই শব্দটি উচ্চারিত হয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলার মীজানে এর কী মূল্য তা অনুধাবন করে না। “আলহামদুলিল্লাহ মীজান [নেকিতে] পূর্ণ করে ফেলে।
আল্লাহর নেয়ামতের আলোচনা অহঙ্কার, লোকদেখানো কিংবা প্রশংসা কুঁড়ানোর মনোভাব নিয়ে করবেন না। আল্লাহ পানাহ! আমরা নেয়ামতের আলোচনা করব সেই নেয়ামতকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করে। আল্লাহ তাআলা আমাকে এর তাওফীক দিয়েছেন। উলামাগণ বলেছেন কিংবা আছারে এসেছে যে, আল্লাহর নেয়ামতের আলোচনা করাও নেয়ামতের শোকর আদায়ের মাধ্যম। বান্দা সবসময় আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করবে ও শুকরিয়া আদায় করবে— এটা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়।
উদাহরণস্বরূপ, দুনিয়ার কোনও বাদশাহ যখন কোনো মজলিসে বসে, আর জনগণ সেই মজলিসে তার প্রশংসা করে যে, বাদশাহ আমাদের ঘর দিয়েছেন, বেতন বাড়িয়েছেন, ঋণ পরিশোধ করে দিয়েছেন, কর মাফ করেছেন। বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোতে কী পরিমাণ কর বসানো হয়েছে। এগুলো শুধু কিছু প্রথা নয়; বরং মানুষের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করার একটি মাধ্যম। যদি এভাবে বাদশাহর সামনে প্রশংসা করে তাহলে সেই বাদশার অবস্থা কী হবে? আল্লাহর শপথ! বাদশাহ খুশি হয়ে বলবে, জনগণ আমার অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা আদায় করেছে। আল্লাহর জন্য সকল শ্রেষ্ঠ উপমা। আমরা আল্লাহর সাথে মাখলুকের সাদৃশ্য বর্ণনা করছি না। আল্লাহ পানাহ! শুধু এটা বুঝাতে চাচ্ছি যে, আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন, বান্দা সবসময় যবানে তাঁর হামদ-সানা, প্রশংসা ও শুকরিয়া আদায় করতে থাকুক।
শোকরের তৃতীয় রোকন হচ্ছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর। চোখ, কান, যবান, হাত-পা ইত্যাদির সুস্থতা ও নিরাপত্তা লাভের কারণে শোকরা আদায় করা। এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর কীভাবে আদায় করব?
উলামাগণ বলেন, এই অঙ্গগুলোকে আল্লাহ তাআলার আনুগত্যে পরিচালনা করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালনা করা এগুলোর শোকর আদায় করার মাধ্যম। যে ব্যক্তি এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো আল্লাহর অবাধ্যতায়, গুনাহের কাজে ব্যবহার করে, হারাম স্থানে দৃষ্টি ফেলে, তাকে বলব, আপনি আল্লাহর নেয়ামতের না-শুকরি করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি বলেন,
“يُصبح على كل سُلامى من الناس صدقة”
অর্থ: মানুষের প্রত্যেক অঙ্গের জন্য রয়েছে সাদাকা।
প্রত্যেক মানুষের দেহে তিনশত ষাটটি হাড় আছে। এর মাঝে কিছু বাহ্যিক আর কিছু অভ্যন্তরীণ। মানুষের এই সকল হাড়ের জন্যও রয়েছে সাদাকা। প্রতিটি তাসবীহ এক একটি সাদাকা, প্রতিটি তাহমীদ সাদাকা, প্রতিটি তাকবীর সাদাকা। হাদিসের শেষে এসেছে,
“ويجزئ من ذلك ركعتان يركعهما الضحى”
অর্থ: সালাতুদ্দোহার দুই রাকাত নামায এই অঙ্গগুলোর সাদাকা আদায়ের জন্য যথেষ্ট।
আপনি যদি মাত্র দশ মিনিট সময় নিয়ে এ সময়ের ভেতরে ওযু করে দুই রাকাত সালাতুদ্দোহার নামায আদায় করেন, যদিও মাত্র দুই রাকাত নামায, এর মাধ্যমে আপনি আপনার সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর আদায় করে নিলেন।
নামাযের মাধ্যমে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর আদায় হয় কীভাবে? উলামাগণ বলেন, নামাযের মাঝে মানুষের সকল অঙ্গ নাড়াচাড়া করে। সুবহানাল্লাহ! নামাযে আপনার দেহের সকল অঙ্গ নাড়াচাড়া করে। রুকু, সিজদা, কেরাত ইত্যাদির মাধ্যমে সকল অঙ্গ নাড়াচাড়া করে।
মজলিসের শেষে বলছি, যদি আমরা শোকরগুজার বান্দা হতে চাই, তাহলে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, কলবের শোকর, যবানের শোকর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শোকর আদায় করা। এগুলোকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে পরিচালনা করা।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শোকরগুজার বান্দা হবার তাওফীক দান করুন, আমীন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম