দারসে রমাদান || দারস-২৩ || দাঈ ইলাল্লাহ হবেন কীভাবে?

0
113

প্রিয় ভাই, আপনি কীভাবে একজন দাঈ হবেন?
অনেক মুসলিমই শুধু নিজে নেককার হয়েই ক্ষান্ত থাকে। অন্যকে নেককার বানানোর ফিকর করে না। যখন তার কাছে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার ফজীলত বর্ণনা করবেন যে, আল্লাহ তাআলা দাঈ ইলাল্লাহর প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন,
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلاً مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحاً وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
তারচেয়ে উত্তম কথা কার হতে পারে, যে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়, নেককাজ করে এবং বলে, আমি একজন মুসলিম। (সুরা ফুসসিলাত)

তখন কিছুলোক বলবে, আমি দাওয়াত দেওয়ার জন্য তৈরি নই। অনেকের ধারণা হচ্ছে, আলেম, হাফেজ, ফকীহ না হলে দাঈ হতে পারবে না। যার সার্টিফিকেট আছে, যিনি মাদরাসায় পাঠদান করেন, যিনি ইজাযতপ্রাপ্ত, কেবল তিনি-ই দাঈ হতে পারবেন। এমন চিন্তা একেবারেই ভুল।
কখনও একজন মুসলিম চরম মূর্খ হয়েও দাঈ হতে পারেন। বলতে পারেন, মূর্খ হয়েও কীভাবে দাঈ হতে পারে?

আমি বলি, আলহামদুলিল্লাহ, একজন মানুষ ইসলামী বই-পুস্তক, অডিও-ভিডিও, বয়ান ইত্যাদি বিতরণ করেও দাঈ হতে পারেন। বর্তমানে অনেক বই-পুস্তক, ছোট রিসালা, দোয়ার বই, দৈনন্দিন পালনীয় মাসনূন আমলের বই ইত্যাদি পাওয়া যায়। এমনিভাবে জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা, কবরের আযাব, কেয়ামত, হাশর-নাশর ইত্যাদি নানা বিষয়ে উলামা-মাশায়েখের অনেক বয়ান ও লেকচার পাওয়া যায়।

উদাহরণস্বরূপ: কেউ যদি একমাসে ফাজায়েলে আমল, ফিতনা ও গুনাহ থেকে সচেতনতা সৃষ্টিকারী দশটি ছোট পুস্তিকা ক্রয় করে বিলি করে, তবুও তিনি দাঈ ইলাল্লাহ। আমি একশ পুস্তিকা বিলি করতে বলছি না; মাত্র দশটি পুস্তিকার কথা বলছি।

একজন বৃদ্ধার ব্যাপারে শুনেছি, যিনি লেখাপড়া জানেন না। তবুও তিনি একজন দাঈ। কীভাবে সম্ভব? এই মহিলা যখন আনন্দঘন বা বেদনাচ্ছন্ন কোনও পরিবেশে যান তখন সাথে একটি ব্যাগে করে উপকারী ছোট-ছোট কিতাব নিয়ে যান এবং উপস্থিত লোকদের মাঝে সেগুলো বিতরণ করেন। এভাবে তিনিও আল্লাহর পথের একজন দাঈতে পরিণত হন।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে মুমিনদের গুণ বর্ণনা করে বলেছেন,
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
অর্থ: মুমিন নারী-পুরুষ একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ করে ও অসৎকাজে বাধাপ্রদান করে।
এটি মুমিনদের গুণ। বিপরীতে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ
অর্থ: মুনাফিক নারী-পুরুষ একে অপরের বন্ধু। তারা অসৎকাজের আদেশ করে ও সৎকাজ থেকে বাধাপ্রদান করে।

বিষয়টি ভালো করে বুঝে নিন ও সাবধান হোন। এই উম্মত সর্বোত্তম হওয়ার কারণ কী? আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ
অর্থ: তোমরা সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে।

হে রব! কেন আমরা সর্বোত্তম জাতি হলাম, আমাদেরকে মানুষের কোন কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে? আমরা বহুতল ভবন, সুরম্য প্রাসাদ, জমকালো গাড়ি, ব্র্যান্ডেড ঘড়ি ইত্যাদি তৈরি করব, সেজন্য? না; বরং,
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ
অর্থ: তোমরা সর্বোত্তম উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণের জন্য বের করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে।

চিন্তা করুন, আপনি দোয়া, মাসনূন আমল, ফাজায়েলে আমল সংক্রান্ত কিতাবাদি মসজিদে, মাদরাসায়, বাজারে কিংবা আপনার আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বা সমাজে বিতরণ করেছেন। যতজন ব্যক্তি আপনার কিতাব পড়ে আমল করবে, দোয়া পড়বে ততজনের আমলের সমপরিমাণ নেকি আপনিও হাসিল করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“الدال على الخير كفاعله”
অর্থ: নেককাজের পথপ্রদর্শক নেককাজ সম্পাদনকারীর সমপরিমাণ নেকি লাভ করবে।

আল্লাহু আকবার! নেককাজের পথপ্রদর্শক নেককাজ সম্পাদনকারীর ন্যায়। তাহলে কেন নিজেকে এত মহান কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করছেন? এতে আপনার তেমন কোনও কষ্ট নেই, কিন্তু; আল্লাহ আপনার নাম দাঈদের খাতায় লিখবেন।

আপনার কাছে দাওয়াতের উসলুব ও পন্থা জানা নেই। কেউ কেউ বলে, আমার কাছে দাওয়াতের উসলুব নেই, আমি কথা বলতে পারি না। আমি বলি, আপনি যদি বোবা ও বধিরও হন তবুও অনেক বড় দাঈ হতে পারেন কিতাব ও বয়ান বিতরণের মাধ্যমে।

আমি আপনাদেরকে শায়খ খালেদ আর-রাশেদ ফাক্কাল্লাহু আসরাহুর বয়ান বিতরণের উপদেশ দিচ্ছি। শায়খের বয়ানের প্রভাব ও কল্যাণ অপরিসীম। শতশত মানুষ শায়খের বয়ানে জীবন পরিবর্তন করে হেদায়াতের পথে এসেছে। নিজেকে কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করবেন না। শয়তান যেন আপনাকে নিবৃত্ত না করে। আপনি ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিমাস সালামের মতো হোন। তিনি বলেন,
وَجَعَلَنِي مُبَارَكاً أَيْنَ مَا كُنتُ
অর্থ: আমি যেখানেই থাকি আমাকে করা হয়েছে বরকতময়।
অর্থাৎ, সকল হালে ও কালে তিনি ছিলেন বরকতময়। আপনিও হয়ে যান সকল হালে ও কালে একজন দাঈ ইলাল্লাহ। তাহলে আপনিও হবেন বরকতময়। কত মানুষের ব্যাপারে শুনেছি, যে হক্কানী আলেমগণের লেকচার ও বয়ান শুনে জীবন পরিবর্তন করেছে। পরবর্তীতে আলেম, শায়খ, মুজাহিদ বা মসজিদের ইমাম হয়ে গেছেন। শুধু একটি বয়ান শুনে প্রভাবিত হয়ে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয়ে গেছেন। চিন্তা করুন, এই শায়খ তাসবীহ, তাহলীল, নামায-রোযা, তিলাওয়াত, জিহাদ ইত্যাদি যত আমল করবেন এর সমপরিমাণ নেকি আপনার আমলনামায়ও লেখা হবে। কেননা এই শায়খকে আপনিই সেই প্রভাব সৃষ্টিকারী ও জীবন পরিবর্তনকারী বয়ানটি হাদিয়া দিয়েছিলেন। সুতরাং, নিজেকে এত বিশাল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত করবেন না। বলবেন না, আমি আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার মত যোগ্য নই, আমার মাঝে দাঈর বৈশিষ্ট্য নেই। এমন কথা শয়তানের পক্ষ থেকে আসে।

আল্লাহ আপনাকে সাহায্য করুন! আপনি সাহস নিয়ে আকীদা, আখলাক, সচেতনতা সৃষ্টিকারী উপকারী কিতাব, বয়ান বিতরণের চেষ্টা করুন। তাহলে আপনিও হয়ে যাবেন একজন দাঈ ইলাল্লাহ।

আপনাদের কাছে একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখ করছি, এক ব্যক্তি দাড়ি লম্বা করছে দেখে তাকে বলি, মাশাআল্লাহ, আপনি দাড়ি লম্বা করছেন কেন? সে বলে, এক ভাই আমাকে একটি প্রচারপত্র দিয়েছিলেন। তাতে দাড়ি মুণ্ডন ও লম্বা করার ব্যাপারে আলেমগণের ফতওয়া, গান-বাজনা শ্রবণের ব্যাপারে ফতওয়ার উল্লেখ ছিল। আমি যখন জানতে পারি যে, দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম, তখন থেকেই দাড়ি লম্বা করা শুরু করি। লক্ষ করুন! বিষয়টি খুব ব্যাপক ও সহজ, বিতরণ করতে আপনার তেমন কোনো কষ্ট হচ্ছে না।

আরেক ভাই আমাকে বলেন, তিনি এক ভাইকে প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখার উপদেশ দেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি প্রতিমাসে তিনটি রোযা রাখে সে যেন এক যুগ রোযা রেখেছে”। আমলটি খুব সহজ; কিন্তু আল্লাহর নিকট এর সওয়াব অনেক বিশাল। সুবহানাল্লাহ! সেই ভাই বলেন, আমার নসীহত ও হাদীসটি মুযাকারার পর তিনি বাড়িতে পরিবারের কাছে যান। তাদেরকেও হাদীসটি বলেন। ভাইয়ের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পুরো পরিবার মাসে তিনটি রোযা রাখা শুরু করে। যেই ভাই এই ব্যক্তির কাছে হাদীসটি মুযাকারা করেন সেই ভাইও তাদের সমপরিমাণ নেকি পাবেন।

কেন আমরা নিজেদের দাওয়াত থেকে বিরত রাখছি, কেন দাওয়াত দেওয়া কঠিন মনে করছি, এই সহজ বিষয়কে আমরা জটিল মনে করছি? বিষয়টি খুব সহজ। কিতাব ও বয়ান বিতরণের মাধ্যমে সহজে এটি করতে পারি। আল্লাহ তাআলা এতে অনেক কল্যাণ ও বরকত দান করবেন। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা দেখবেন আপনার অন্তরে অন্যদের কল্যাণকর কিছু করার ভালোবাসা কতটুকু। আপনি আপনার সমাজের একজন কর্মঠ অংশ হয়ে যান। আমাদের দ্বীন নেতিবাচক ব্যক্তিদের অপছন্দ করে। আফসোস! কিছু মানুষ খুব নেতিবাচক। তারা ইসলাম ও মুসলমানের কোনও উপকারে আসে না। এই ব্যক্তির এমন আচরণ ইসলামে প্রত্যাখ্যাত। আমাদের দ্বীন ও ইসলামে এই পথ প্রত্যাখ্যাত। আমাদের দ্বীন ইসলাম ইতিবাচক ও কর্মঠ ব্যক্তিদের পছন্দ করে। সে যেখানেই যায় সেখানেই কল্যাণকর কিছু করার চেষ্টা করে। উত্তম কথা, ওয়াজ-নসীহত, কিতাব বিতরণ, বয়ান বিতরণ ইত্যাদির মাধ্যমে কল্যাণের প্রসার করে।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি আমাদেরকে কল্যাণকর কিতাব, বয়ান, লিখনী প্রচার-প্রসার করে ইসলাম ও মুসলিমদের উপকার সাধনে অংশগ্রহণের তাওফীক দান করুন। আমাদেরও দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে কবুল করে নেন, আমীন।


মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধইরানের ৩টি শহরে জাইশুল আদলের অভিযানে অন্তত ২০০ সেনা নিহত
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনের জিহাদ || আপডেট – ৬ এপ্রিল, ২০২৪