দারসে রমাদান।। দারস-২৫।। মুমিনের সময় বরকতময় হবে কীভাবে? ।।

0
114

আজকের মজলিসের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, কীভাবে একজন মুমিনের সকল সময়, সকল দিন বরকতময় হতে পারে? কীভাবে আপনার দিনটি মূল্যবান হতে পারে?
প্রিয় ভাই, অনেকেই সময়ের মূল্য দেয় না। আমরা মুসলিম। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শ্লোগান হচ্ছে, “আমাদের জীবনে কোনো বিশৃঙ্খলা নেই”। একজন মুসলিমের জীবনে বিশৃঙ্খলা থাকতে পারে না। সে তার সময়ের হেফাজত করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
“نعمتان مغبونٌ فيهما كثيرٌ من الناس الصحة والفراغ”.
অর্থ: দুটি নেয়ামতের ব্যাপারে অনেকেই উদাসীন, তা হচ্ছে সুস্থতা ও অবসরতা। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৬৪১২)

প্রিয় ভাই, আপনার জীবনের দিনগুলো হেফাজতের সবচে সহজ, সুন্দর, উত্তম ও মধুময় পদ্ধতি হচ্ছে, আপনি চেষ্টা করবেন ধারাবাহিক আমলের মাধ্যমে দিনগুলোকে বরকতময় ও মূল্যবান করে তুলতে। আপনার দৈনন্দিন কাজের রুটিন থাকবে। বর্তমানে দুনিয়ার বড় বড় মিলিয়ার্ড ও কর্পোরেশনগুলো তাদের কাজের রুটিন ও পরিকল্পনা তৈরি করে। আপনারও দৈনন্দিনের রুটিন ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। যেমন, প্রতিদিন এক পারা কুরআন তিলাওয়াত করা। এই রুটিন আপনাকে সময় কাজে লাগাতে সাহায্য করবে।

সময় কাজে লাগিয়ে একে বরকতময় করে তোলার জন্য সহায়ক হিসেবে খুব সহজ-সরল একটি উপমা পেশ করব। উপমায় উল্লিখিত পদ্ধতিটি খুবই চমৎকার। আপনি দৈনিক অবশ্য পালনীয় কিছু আমল নির্ধারণ করে নিবেন। এই অবশ্য-পালনীয় আমলগুলো আপনার সময়কে বরকতময় করবে। যেমন: “سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله” এখানে পাঁচটি কালিমা বা বাক্য রয়েছে। আপনি দৈনিক এই বাক্যগুলো এক হাজারবার পাঠ করা নিজের উপর আবশ্যক করে নিবেন। মাঝে মাঝে সংখ্যা আরও বাড়াতেও পারেন। কিন্তু এক হাজারের চেয়ে কম যেন না হয়। আপনি এক বসায় এক হাজারবার পড়তে পারবেন না? অসুবিধা নেই, আমি আপনাকে সহজ ও সুন্দর একটি পদ্ধতি বলে দিচ্ছি। যদি কাউকে বলি: আপনি কি দৈনিক এক হাজারবার “سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله” পড়তে পারবেন? অনেকেই বলবে, প্রতিদিন এক হাজারবার কীভাবে পড়ব? আমি পারব না। কিন্তু যদি সহজ ও সুন্দর এবং ক্লান্তি ও জটিলতামুক্ত কোনো পদ্ধতি বের করা হয়, তাহলে কেমন হবে? স্বাভাবিকভাবে এক বসায় এক হাজারবার পড়লে এক সপ্তাহ বা দশদিন কিংবা দুই সপ্তাহ পর আপনার কাছে এটি বোঝা ও কঠিন মনে হতে থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“أحب الأعمال إلى الله أدومها وإن قلّ”
অর্থ: আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় আমল হচ্ছে যা ধারাবাহিকভাবে করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-৬৪৬৪)
ধারাবাহিক আমলের জন্য সহজ-সরল ও জটিলতামুক্ত একটি পদ্ধতি আছে। তা হচ্ছে, আপনি প্রত্যেক দুই ওয়াক্ত ফরজ নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে দুইশবার করে এই যিকরটি পড়বেন। অর্থাৎ, ফজর ও যোহরের মধ্যবর্তী সময়ে দুইশবার, যোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে দুইশবার, আসর ও মাগরিবের মাঝে দুইশবার, মাগরিব ও ইশার মাঝে দুইশবার এবং ইশা ও ফজরের মাঝে দুইশবার। তাহলে মোট এক হাজারবার হবে।

যদি দৈনিক এক হাজারবার “سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله” এই যিকর করেন তাহলে এতে কী লাভ? আখেরাতে এর কী প্রতিদান? যদি এক হাজারবার পড়েন তাহলে দৈনিক জান্নাতে আপনার জন্য চার হাজার গাছ রোপণ করা হবে। “سبحان الله” একটি গাছ, “الحمد لله” একটি গাছ, “لا إله إلا الله” একটি গাছ, “الله أكبر” একটি গাছ। জান্নাতের গাছ কেমন হবে জানেন? যা কোনো চোখ কোনোদিন দেখেনি, কোনো কান যা সম্পর্কে শোনেনি, কোনো মানুষের অন্তরে যার কল্পনাচিত্র কোনোদিন ভাসেনি। দৈনিক চার হাজার গাছ রোপণ হলে মাসে কতটি গাছ রোপণ হলো? এক লক্ষ বিশ হাজার! এবার আপনার সময়গুলো বরকতময় ও মূল্যবান হয়েছে।

দৈনিক এক হাজারবার এই যিকর করলে কতটি সাদাকার সওয়াব পাবেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“كل تسبيحة صدقة وكل تحميدة صدقة وكل تكبيرة صدقة وكل تهليلة صدقة”
অর্থ: প্রতিটি “سبحان الله” একটি সাদাকা, প্রতিটি “الحمد لله” একটি সাদাকা, প্রতিটি “لا إله إلا الله” একটি সাদাকা, প্রতিটি “الله أكبر” একটি সাদাকা। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৭২০) অর্থাৎ, এই বাক্যগুলোর বিনিময়ে সাদাকার সওয়াব লেখা হবে। তাহলে মাসে সর্বমোট এক লক্ষ বিশ হাজার সাদাকার সওয়াব আপনার আমলনামায় লেখা হবে।

দৈনিক কতটি ধনভান্ডার জমা হবে? আপনি দৈনিক এক হাজারবার “لا حول ولا قوة إلا بالله” পড়েছেন। বুখারি ও মুসলিমে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আবু মুসা আশআরী রা. কে বলেছেন: “আমি কি তোমাকে জান্নাতের ধনভান্ডারের সন্ধান দেব না?” আপনি জানেন জান্নাতের ধনভান্ডার কি? যা কোনো চোখ কোনোদিন দেখেনি, কোনো কান যা সম্পর্কে কোনোদিন শোনেনি। অতঃপর তিনি বলেন, “তুমি “لا حول ولا قوة إلا بالله” বল”। এটি জান্নাতের ধনভান্ডার। আপনি দৈনিক এক হাজারবার পড়লে মাসে ত্রিশ হাজার হয়। অর্থাৎ, মাসে জান্নাতে আপনার ত্রিশ হাজার ধনভান্ডার জমা হয়েছে।

লক্ষ করুন! যদি দৈনিক এক হাজারবার “سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله” এই যিকর করেন তাহলে উল্লিখিত ফলাফল লাভ করবেন। এখানে আরও ফলাফল আছে। সংক্ষিপ্ত করার ইচ্ছায় সেদিকে যাচ্ছি না। আপনারা সহজ ও সুন্দর পদ্ধতি সম্পর্কে জানলেন। প্রত্যেক দুই ওয়াক্ত নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে দুইশবার পড়তে হবে। এই পদ্ধতিতে আমল করলে আপনার জন্য কঠিন মনে হবে না। এই পদ্ধতি আপনার জন্য ধারাবাহিক আমল জারি রাখাকে সহজ করবে।

সুবহানাল্লাহ! আপনি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন বা সফরে বের হন কিংবা কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যান, তাহলেও আপনার আমলনামায় এর পূর্ণ সওয়াব লেখা হতে থাকবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“إذا مرض العبد أو سافر كُتِب له ما كان يعمل صحيحًا مُقيمًا”
অর্থ: যদি কেউ অসুস্থ হয়ে যায় বা সফরে বের হয়, তাহলে সুস্থ ও মুকীম অবস্থায় যে আমল করত এর সওয়াব সে পাবে। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং-২৯৯৬)
আপনি যদি এক সপ্তাহ বা এক মাস অসুস্থ থাকেন যার ফলে যিকর করতে পারেননি, তাহলেও আপনার আমলনামায় এর সওয়াব লেখা হবে।

সময় কাজে লাগানোর আরেকটি পদ্ধতি উপমা হিসেবে বলছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরুদ পাঠ করতে স্বাভাবিকভাবে সংক্ষিপ্ত চারটি শব্দ লাগে। চারটি শব্দ হচ্ছে, “صلى الله عليه وسلم” । আল্লাহ তাআলা বলেন,
(يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيماً)
অর্থ: হে ঈমানদারগণ, তোমরা রাসূলের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ কর।
“صلى الله عليه وسلم” বাক্যটিতে দরুদ ও সালামের সমন্বয় ঘটেছে। আপনি على نبينا محمد বললেও অসুবিধা নেই। কিন্তু “صلى الله عليه وسلم” বললে আমলটি আয়াতের সাথে সামঞ্জস্য হয়ে যাবে।
যদি বলি, কেউ কি দৈনিক এক হাজারবার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করতে পারবেন? বলবে, দৈনিক এতবার কীভাবে পাঠ করব? আমি বলব, আপনি প্রথম উপমায় উল্লিখিত পদ্ধতিতে প্রত্যেক দুই ওয়াক্ত নামাযের মধ্যবর্তী সময়ে দুইশবার “سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله” ও দুইশবার “صلى الله عليه وسلم” পাঠ করুন। তাহলেই আপনার দৈনিক এক হাজারবার দরুদ ও সালাম পাঠ করা হয়ে যাবে।

দৈনিক এক হাজারবার দরুদ ও সালাম পাঠ করলে কী লাভ? এতে পরকালে কী হাসিল হবে?
প্রথম লাভ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা আপনার উপর রহমত বর্ষণ করবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“من صلى علي مرة صلى الله عليه بها عشر مرات”
যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে, আল্লাহ তাআলা তার উপর দশবার রহমত নাজিল করবেন।
আপনি এক হাজারবার দরুদ পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা আপনাকে দশ হাজার রহমত দান করবেন। অন্য হাদীসে এসেছে,
“من صلى علي مرة كُتِب له عشر درجات ومُحيت عنه عشر سيئات وكُتِبت له عشر حسنات”
অর্থ: যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করে, তার জন্য দশটি মরতবা লেখা হয়, দশটি গুনাহ মাফ হয় এবং দশটি নেকি লেখা হয়।

দৈনিক এক হাজারবার দরুদ পাঠ করলে আপনার দশ হাজার মরতবা বৃদ্ধি পাবে। এটি দরুদ পাঠের দ্বিতীয় ফল। তৃতীয় ফল হচ্ছে আপনার দশ হাজার গুনাহ মাফ হবে। চতুর্থ ফল হচ্ছে আপনার দশ হাজার নেকি লেখা হবে। আর একটি নেকি দশ নেকির সমান। তাহলে মোট এক লক্ষ নেকি হবে। আর আল্লাহ যাকে চান আরও বাড়িয়ে দেন।

প্রিয় ভাই, আপনার দিনটি বরকতময় করার এটি একটি চমৎকার পদ্ধতি। ধারাবাহিকভাবে আমল করতে থাকলে দিনদিন আপনি এই আমলে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন। তখন এটি আপনার কাছে সহজ হয়ে যাবে। যেই ব্যক্তি এই পদ্ধতিতে আমল করে সে কত বড় ফল লাভ করবে, তার মরতবা কত উঁচু হবে, তা বুঝার চেষ্টা করুন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দায়েমী আমলে অভ্যস্ত হয়ে আমাদের সময়গুলো বরকতময় করার তাওফীক দান করুন, আমীন।


মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভিডিও || ত্রাণ নিতে আসা ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা
পরবর্তী নিবন্ধআফগানিস্তানের একাধিক স্থানে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে সড়ক উন্নয়ন কাজ