মুসলিমদের নিকট পবিত্রতম ভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ফিলিস্তিন ভূখণ্ড। গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আকাশ, স্থল ও সমুদ্র থেকে বোমাবর্ষণ শুরু করে জায়োনিস্ট ইসরায়েলি বাহিনী।
বহু বছর ধরেই ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে গাজা উপত্যকা। এরমধ্যে গত ৭ অক্টোবর থেকে অঞ্চলটিতে বিদ্যুৎ, পানি, খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য মৌলিক মানবিক সরবরাহ প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। ফলে গত ৭ মাস বা ২০০ দিন ধরে অঞ্চলটিতে চলতে থাকা জায়োনিস্ট আগ্রাসন ও অবরোধের কারণে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, অবকাঠামো এবং নাগরিক পরিসেবা সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিসের বিবৃতি অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে জায়োনিস্ট বাহিনী গাজায় ৩ হাজার ২৫টি গণহত্যা চালিয়েছে। জায়োনিস্ট বাহিনীর এই আগ্রাসনে অন্তত ৪১ হাজার ১৮৩ জন গাজাবাসী শহিদ বা নিখোঁজ হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৪ হাজার ১৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। বাকিরা এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। গত ২১ এপ্রিল রবিবার গাজার আন-নাসের হাসপাতাল প্রাঙ্গনে একটি গণকবর চিহ্নিত করেছে গাজার নাগরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ। উদ্ধারকর্মীরা ঐদিন দুপুর পর্যন্ত গণকবরটি থেকে ২০০টি লাশ উদ্ধার করেছেন, তাদের ভাষ্যমতে, সেখানে অন্তত ৪০০টি মৃত দেহ রয়েছে। এভাবেই গাজার বিভিন্ন অঞ্চলে শত শত ফিলিস্তিনিকে গণকবর দিয়ে রেখেছে ইসরায়েল। ফলে প্রতিটি গণকবরের সন্ধান আর উদ্ধারে নিখোঁজ ও নিহত ফিলিস্তিনিদের তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত নিহতদের এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ১৪ হাজার ৭৭৮ শিশু ও ৯ হাজার ৭৫২ জন নারী। এছাড়াও নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ৪৮৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী, ৬৭ জন সিভিল ডিফেন্স অফিসার, ১৪০ জন সাংবাদিক। আর আহত ৭৭ হাজার ১৪৩ জনের মধ্যে ৭২ শতাংশই নারী ও শিশু। এদের মাঝে ১১ হাজার জনকেই জরুরি চিকিৎসার জন্য গাজর বাহিরে সরিয়ে নেওয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
হতাহতের এই সংখ্যা ছাড়াও ইসরায়েলি বোমা হামলার বিষক্রিয়ায় রোগাক্রান্ত ১ লাখ ৯০ হাজার মানুষ। এছাড়াও মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছেন ১০ হাজার ক্যান্সারের রোগী। আর ঔষধের অভাবে দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকিতে রয়েছেন আরও ৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ।
ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করেই ক্ষান্ত থাকেনি বরং বেঁচে যাওয়া ফিলিস্তিদেরও বন্দী করছে। গত ৭ মাসে অঞ্চলটির ৫ হাজার বাসিন্দা, ৩১০ জন স্বাস্থ্যকর্মী ও ২০ জন সাংবাদিককে আটক করেছে জায়োনিস্ট বাহিনী। অঞ্চলটিতে জায়োনিস্ট বাহিনীর চালানো গণহত্যা, ধ্বংস ও বন্দীত্ব থেকে বাঁচতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ২ মিলিয়ন মানুষ।
এদিকে জায়োনিস্ট বাহিনী ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের ছোট্ট এই উপত্যকাটিতে ৭৫ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলে পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে ১৮১টি সরকারি কেন্দ্র, ১০৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ২৩৯টি মসজিদ ও ৮৬ হাজার বাড়িঘর। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ৩০৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৩১৭টি মসজিদ, ২ লাখ ৯৪ হাজার বাড়িঘর। আর ক্ষতিগ্রস্ত এসব ভবন বর্তমানে ব্যবহার ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জায়োনিস্ট বাহিনীর এসব বর্বরোচিত বোমা হামলা থেকে বাদ যায় নি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো। ফলে ধ্বংস, ক্ষতিগ্রস্ত ও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ২৪৫টি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। টার্গেট করা হয়েছে ১২৬টি অ্যাম্বুলেন্সকেও। এছাড়াও গাজার ঐতিহাসিক স্থানগুলো ধ্বংসের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে ৩০ বিলিয়ন ডলার।
পুরো গাজা উপত্যকা যখন মৃত্যু আর ধ্বংসস্তুপে পরিণত, ঠিক সেই কঠিন মূহুর্তগুলোতেও টলেনি গাজার মুসলিমদের ঈমানী দৃঢ়তা। তাঁরা সর্ব অবস্থায় এই ভূমির বীর প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরকে সমর্থন দিয়ে আসছেন। ফলে আল-কাসসাম সহ অন্যান্য প্রতিরোধ দলগুলো, ৭ মাস পরেও অবরুদ্ধ অঞ্চলটির উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে বীরত্বের সাথে জায়োনিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছেন। এমন সব অঞ্চল থেকেও জায়োনিস্ট বাহিনীর উপর মুজাহিদগণ হামলা চালাচ্ছেন, যেই এলাকাগুলো জায়োনিস্ট বাহিনী ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে, এবং দাবি করেছে যে তারা এই এলাকাগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও সেখানকার প্রতিরোধ বাহিনীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, জায়োনিস্ট বাহিনীর এমন দাবিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধারা এসব অঞ্চলে জায়োনিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে অ্যাম্বুশ, স্নাইপার, রকেট ও মর্টার শেল দ্বারা হামলা চালাচ্ছেন।
এবিষয়ে আল-কাসসাম মুখপাত্র গত ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত প্রায় ২০ মিনিটে তাঁর সর্বশেষ বক্তব্যে বলেন, আগ্রাসন শুরুর ২০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও জায়োনিস্ট ইসরায়েলি বাহিনী কোনো বিজয় ছাড়াই গাজার চোরাবালিতে আটকে আছে। আমরা এখন পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে আল-কাসসাম ব্রিগেডের বীরদের হামলার সামান্য কিছুই মিডিয়ায় প্রকাশ করেছি। আর শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের এই হামলা ও প্রতিরোধ নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে অব্যাহত থাকবে, যতক্ষণ না আমাদের ভূমির প্রতিটি ইঞ্চি শত্রুর আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত হয়।