ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় ৮ মাস ধরে বিরামহীন ধ্বংস ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে জায়োনিস্ট ইসরায়েলি বাহিনী। ফলে প্রতিনিয়ত অঞ্চলটিতে শহিদ ও আহত হচ্ছেন শত শত নিরপরাধ বেসামরিক জনগণ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ২ মিলিয়ন মানুষ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণায়ের তথ্যমতে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২১ মে পর্যন্ত গাজায় ৩,১৫৮টি গণহত্যা চালিয়েছে জায়োনিস্ট ইসরায়েলি বাহিনী। এছাড়াও আকাশ ও স্থল পথে বোমা হামলা চালিয়ে অঞ্চলটিকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে ইসরায়েল। এতে নিহত ও নিখোঁজ হয়েছেন অন্তত ৪৫ হাজার ৬৪৭ জন গাজাবাসী।
হাসপাতালে নথিভুক্ত তালিকা অনুযায়ী, গত ২১ মে পর্যন্ত অঞ্চলটিতে জায়োনিস্ট বাহিনীর হামলায় নিহত বেসামরিকদের সংখ্যা ৩৫৬৪৭ জন ছাড়িয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৫ হাজর ১৮৬ জনই শিশু। মহিলা রয়েছেন আরও ১০ হাজার ৩৮ জন। নিহতদের এই তালিকায় মেডিকাল স্টাফ রয়েছেন ৪৯২ জন, সিভিল ডিফেন্সের সদস্য রয়েছেন ৬৯ জন, সাংবাদিক রয়েছেন ১৪৭ জন। এছাড়াও নিখোঁজের তালিকায় রয়েছেন আরও ১০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। এই বিপুল সংখ্যক বেসামরিক মানুষ হতাহত হওয়ায় গাজার ১৭ হাজারেরও বেশি শিশু তাদের পিতামাতা বা তাদের একজনকে ছাড়াই বাস করছে।
জায়োনিস্ট বাহিনী সমস্ত বর্বরতা ছাড়িয়ে গাজার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসারত রোগিদের বিরুদ্ধেও গণহত্যা চালিয়েছে। ফলে অঞ্চলটির কয়েকটি হাসপাতালের অভ্যন্তরে ৭টি গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৫২০ জনের মৃতদেহ।
এদিকে আহতদের তালিকাও আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সূত্রমতে, জায়োনিস্ট বাহিনীর আগ্রাসনে গত ২১ মে পর্যন্ত আহতদের সংখ্যা ৭৯ হাজার ৮৫২ জন ছাড়িয়েছে। এদের মধ্যে ৭১ শতাংশই নারী ও শিশু। এসকল আহতদের মধ্যে ১১ হাজার ব্যক্তির অবস্থাই গুরুতর, যাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে গাজার বাহিরে অপারেশনের জন্য স্থানান্তর করা প্রয়োজন। এছাড়াও ক্যান্সারে আক্রান্ত ১০ হাজার মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি দাড়িয়ে আছেন। আর বাস্তুচ্যুত হওয়ায় সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৯৫ হাজার মানুষ। অপরদিকে স্বাস্থ্যসেবার অভাবের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছেন ৬০ হাজার গর্ভবতী মহিলা।
এদিকে জায়োনিস্ট ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় গণহত্যা ও ধ্বংসের পাশাপাশি উপত্যকার ৫,০০০ নাগরিককে অজানা স্থানে বন্দী করে নিয়ে গেছে। এদের মাঝে ৩১০ জন স্বাস্থ্য কর্মী এবং ২০ জন সাংবাদিকও রয়েছেন।
এদিকে জায়োনিস্ট বাহিনী ছোট্ট এই উপত্যকাটিতে ৭৭ হাজার টন বিস্ফোরক ফেলে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করে দিয়েছে ১৮৯টি সরকারি ভবন, ৪২০টি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়, ৮০৪টি মসজিদ। পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে ৮৭ হাজার আবাসিক ভবন, আংশিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার বসতবাড়ি।
জায়োনিস্ট বাহিনীর এমনসব বর্বরোচিত হামলার ফলে ধ্বংস হয়ে গেছে গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থা, ফলে বন্ধ হয়ে গেছে ৩৩টি হাসপাতাল ও ৫৫টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। আর ইহুদিদের হামলার শিকার হয়েছে ১৬০টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে রোগিদের বহনকারী ১২৬টি অ্যাম্বুলেন্সকেও।
এদিকে পুরো গাজা উপত্যকা জুড়ে জায়োনিস্ট বাহিনী কর্তৃক ধ্বংস আর গণহত্যা চালানো সত্ত্বেও, সিসা ঢালা প্রচীরের নেয় ময়দানে দাঁড়িয়ে আছেন বীর প্রতিরোধ যোদ্ধারা। ফলে যুদ্ধের ৭ম মাস পেরিয়ে ৮ম মাসেও অবরুদ্ধ অঞ্চলটির উত্তর থেকে দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বীরত্বের সাথে জায়োনিস্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে প্রতিরোধ দলগুলো। গাজার ধ্বংসস্তুপের নিচে ছড়িয়ে থাকা বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সফল সব অ্যাম্বুশ আর আতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। এমন সব স্থান আর অঞ্চলেও জায়োনিস্ট বাহিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মুখোমুখি হচ্ছে, যা তারা হয়তো কল্পনাও করে নি।
ফলে দেখা যাচ্ছে, গত ১৪ থেকে ১৮ মে পর্যন্ত, আল-কাসসাম ও আল-কুদস নামক ২টি ব্রিগেডের বীর যোদ্ধাদের অভিযানেই জায়োনিস্ট বাহিনীর অন্তত ৩৫৭ সেনা সদস্য হতাহত হয়েছে। এদের মাঝে নিশ্চিতভাবে ১২৮ সেনা নিহত হয়েছে, তবে এই সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি। এদিকে দুটি ব্রিগেডের অভিযানে জায়োনিস্ট বাহিনীর ৮৫টি ট্যাংক, এপিসি ও বুলডোজার ধ্বংস হয়েছে, এই তালিকায় ৩টি ড্রোনও রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, উক্ত ২টি মুজাহিদ বাহিনী ছাড়াও অন্তত আরও ৭টি মুজাহিদ বাহিনী গাজার চলমান যুদ্ধে জায়োনিস্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে। তাদের অভিযানেও আরও অসংখ্য জায়োনিস্ট সৈন্য হতাহত ও তাদের সামরিক যান ধ্বংস হচ্ছে।