বিয়ে, শোক পালন ও হজ সম্পর্কিত ভ্রান্ত প্রথা পরিহারে ইমারতে ইসলামিয়ার নির্দেশনা জারি

0
314

আফগান সমাজে বিয়ে, মৃত ব্যক্তির শোক পালন ও পবিত্র হজ পালন সম্পর্কিত ইসলাম বহির্ভূত অপব্যয় ও ভ্রান্ত প্রথা রোধে বেশ কিছু নির্দেশনা জারি করেছে ইমারতে ইসলামিয়া প্রশাসন।

গত ২০ মার্চ এক প্রতিবেদনে ইমারতে ইসলামিয়া প্রশাসন জানায়, দেশটির কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার অধীনস্থ ফিকহি পরিষদের আলেমগণ, বিশিষ্ট শাইখগণ, অর্থনৈতিক কমিশনের সদস্যগণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিনিধিগণ আফগান সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন সামাজিক রীতিনীতির পর্যালোচনা করেছেন। তাদের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বিয়ে, শোক পালন ও হজ পালনের সাথে জড়িত কিছু প্রচলিত রীতি ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি অপচয় ও অতিরঞ্জনকে উৎসাহিত করছে। এসব অনিয়ন্ত্রিত প্রথা সমাজে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক অবক্ষয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমিরুল মুমিনিন শাইখুল হাদিস মাওলানা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা হাফিযাহুল্লাহর নির্দেশে ইমারতে ইসলামিয়া প্রশাসন দেশটির সকল নাগরিকের জন্য নিম্নলিখিত নির্দেশনাগুলো আইন হিসেবে প্রণয়ন ও জারি করেছেন।

বিবাহ সংক্রান্ত নির্দেশনা:

– একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর অভিভাবক (সাধারণত তার পিতা বা ভাই) তার আইনগত অধিকার রক্ষা করতে বাধ্য। নারীর জীবনযাত্রা সংক্রান্ত বিষয়ে তার মতামত ও সম্মতি নেওয়া অভিভাবকের দায়িত্ব।
– কোনো অভিভাবক নারীর সম্মতি ছাড়া তাকে বিবাহে বাধ্য করতে পারবে না। যদি এমন ঘটনা ঘটে, তাহলে নারী আদালতে বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবে। এই ক্ষেত্রে আমিরুল মুমিনিন কর্তৃক জারি করা নারীর অধিকার সংক্রান্ত ফরমান মেনে চলতে হবে।
– ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহের বিষয়ে নারী পুরুষের মতোই স্বাধীন। স্বামী মারা গেলে বা তালাক দিলে, তাকে শ্বশুরবাড়ি বা শ্বশুর কর্তৃক বিবাহে বাধ্য করা যাবে না। সে শরিয়া নীতি অনুসারে যাকে খুশি, যেখানে খুশি বিয়ে করতে পারবে।
– বিবাহের সময় দেয়া মোহর সম্পূর্ণরূপে নারীর নিজস্ব সম্পত্তি, যা তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ নিতে পারবে না।
– নারীদের প্রতি অন্যায় আচরণ যেমন জোরপূর্বক বিবাহ বা তার অধিকার লঙ্ঘন করা ইমারতে ইসলামিয়ার আদালতে বিচারযোগ্য অপরাধ।
– ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী, সাক্ষী ছাড়া কোনো বিবাহ বৈধ নয়।
– ইসলামি শরিয়াহ মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ ১০ দিরহাম নির্ধারণ করেছে, তবে সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত নয়। নারী সম্মতি দিলে, তিনি এই পরিমাণে বিবাহ করতে পারেন। অন্যথায়, কেবলমাত্র একজন দায়িত্বশীল পিতা বা পিতামহ তার অনুমতি ছাড়া কম মোহর নির্ধারণ করতে পারবে।
– ইসলামি শরিয়াহ অতিরিক্ত মোহর নির্ধারণকে নিরুৎসাহিত করে, যাতে অযথা বাড়তি চাপ সৃষ্টি না হয়। মোহর ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বরের পরিবার থেকে অর্থ নেওয়া ঘুষ হিসেবে বিবেচিত হবে।

– বাগদানের পর বাগদান ভোজ, বিবাহের মিষ্টি অনুষ্ঠান, বা উপহার আদান-প্রদানের নামে জাঁকজমকপূর্ণ ভোজ আয়োজন করা অপ্রয়োজনীয় এবং এড়িয়ে চলা উচিত। দ্বিতীয় দফায় উপহার প্রদানের অনুমতি নেই, এমনকি প্রথম দফায় শুধুমাত্র অল্প সংখ্যক পুরুষ এবং মহিলা অতিথিদের অংশগ্রহণ করা উচিত। এই অনুষ্ঠানে উপহার শুধুমাত্র বর এবং কনের জন্য সীমাবদ্ধ থাকা উচিত, যার মধ্যে পোশাক এবং সাধারণ ব্যক্তিগত জিনিসপত্র অন্তর্ভুক্ত থাকে। গাড়ি, মোটরসাইকেল, বাড়ি বা অন্যান্য ব্যয়বহুল জিনিসপত্রের মতো ব্যয়বহুল উপহার দেওয়া উচিত নয়।
– বাগদানের পর দেরি না করে বিবাহ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা উচিত।
– সীমিত পরিসরে আয়োজিত বিবাহকে উৎসাহিত করা হবে।
– বর কনেকে যেকোন মুল্যের বিয়ের পোশাক প্রদান করতে পারবে।
– বিবাহ অনুষ্ঠান সাধারণ ও সংযত হতে হবে এবং তা বরপক্ষের নির্ধারিত স্থানে সম্পন্ন করা উচিত।
– বর সরকারি যানবাহন ব্যবহার করতে পারবে না।
– বিয়ের সময় বর পক্ষের জন্য কনের পরিবারের পক্ষ থেকে কাঁচা বা রান্না করা খাবার উপস্থাপন করা জায়েয নয়। মিষ্টি এবং বিয়ের খরচের মতো ব্যয় মেটানোর জন্য কনের পরিবারকে অনুরোধ করা বা প্রত্যাশা করা, বা “ডুডি” বা “টাকরি” এর মতো শব্দে বরের কাছ থেকে পোশাকের অনুরোধ করাও নিষিদ্ধ। শরিয়া আইন অনুসারে, এই কাজগুলি অবৈধ বলে মনে করা হয়।

– বিয়ের সময় কনের মামা, চাচাতো ভাই, গ্রামবাসী, গৃহকর্মী বা বরের পরিবারের পক্ষ থেকে চাঁদা চাওয়া নিষিদ্ধ। তবে কেউ যদি স্বেচ্ছায় বিয়ের সময় ঐতিহ্যগতভাবে সহায়তা করে এমন কোনও গ্রাম্য চাকরকে অর্থ অফার করে, তবে তা গ্রহণ করতে কোনও লজ্জা নেই।
– বিয়ের সময় আনন্দ উদযাপনের অংশ হিসেবে ফাঁকা গুলি ছোড়া, গাড়ি ও মোটরসাইকেল ইত্যাদি পুরস্কার দিয়ে খেলার আয়োজন করা নিষিদ্ধ। তবে যদি কোনো প্রতিযোগিতা পুরস্কার ছাড়া হয়, তাহলে তা বৈধ।
– বিবাহ অনুষ্ঠানে আতশবাজি, সরকারি যানবাহন ব্যবহার, বিশাল শোভাযাত্রা আয়োজন, রাস্তা অবরোধ করা বা জনগণের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
– নববধূর সাথে পারস্পারিক সম্পর্ক বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিয়ের সময় বা পরে নববধূকে তার পরিবারের বাইরের ব্যক্তিদের কাছ থেকে পোশাক বা অর্থ উপহার দেওয়ার অনুশীলন নিষিদ্ধ। এই রীতিটি প্রায়শই বিনিময় প্রথার দিকে পরিচালিত করে এবং আন্তরিকতার পরিবর্তে শত্রুতা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
– বরের পরিবারের বাইরে থেকে আসা অতিথিরা (দাসমল) অনুষ্ঠানের সময় নববধূকে আর্থিক উপহার দিতে পারবেন না এবং কনের পরিবার অতিথিদের পোশাক বা উপহার সরবরাহ করতে পারবে না। অতিথিদের আপ্যায়ন করা উচিত বিনয় ও আন্তরিকতার সঙ্গে, অপচয়ের উদ্দেশ্যে নয়।
– বিনিময় বিবাহ পরিহার করা উচিত, কারণ এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদি এমন বিবাহ হয়, তাহলে অবশ্যই নির্ধারিত মোহর প্রদান করতে হবে। ইসলামি শিক্ষাবিদদের এ ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করা উচিত।

মৃত ব্যক্তির শোক পালন সংক্রান্ত নির্দেশিকা:

কিছু অঞ্চলে মৃত ব্যক্তির পরিবার কর্তৃক গ্রামবাসী এবং অন্যান্যদের খাবার এবং বিনোদন প্রদানের প্রথা রয়েছে, যা ইসলামি আইনবিদরা অনুমোদন করেননি। বিভিন্ন ফিকহ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মত প্রকাশ করেছেন:

– মৃত্যুর দিনে এলাকার লোকজনকে খাবার পরিবেশন করা মাকরুহ বলে বিবেচিত হয়, কারণ ভোজ সাধারণত আনন্দের সাথে সম্পর্কিত, শোকের সাথে নয়। এটি একটি নেতিবাচক বিদআত।
– মৃত্যুর ঘটনায় সমবেত ব্যক্তিদের জন্য খাবার প্রস্তুত করা গুনাহ হিসেবে গণ্য হয়। তবে, প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য খাবার সরবরাহ করা উচিত।
– শোকসভায় চিৎকার ও উচ্চস্বরে কান্নাকাটি করা গুরুতর গুনাহ। শোকাহতরা অন্যদের জন্য খাবার পরিবেশন করা নিষিদ্ধ, কারণ এটি তাদের দুঃখ আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং জাহিলি যুগের রীতির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হতে পারে।
– প্রচলিত দান অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ ও আত্মপ্রদর্শনের জন্য করা হয়, যা শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া উচিত। যদিও প্রচলিত দান অনুমোদিত, তবুও এটি মাকরুহ এবং বাধ্যতামূলক মনে করা হলে তা পরিত্যাগ করা উচিত।

ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিবেচনায় নিম্নলিখিত নিয়মগুলো অনুসরণ করা আবশ্যক:

– মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য ঐতিহ্যগত রীতিনীতি অনুসরণ করা নিষিদ্ধ যেমন মৃত্যুর পরে নির্দিষ্ট দিনে (প্রথম, তৃতীয়, সপ্তম এবং চল্লিশতম দিন) খাবার সরবরাহ করা। পরিবর্তে, কিছু শর্ত পূরণ করে অন্য যেকোন রূপে দান করা যেতে পারে, যা মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব হাসিলের মাধ্যম হতে পারে।
– মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পর এতিমের সম্পত্তি থেকে সদকা করা নিষিদ্ধ। যারা এতিমের সম্পত্তি এভাবে পরিচালনা করবে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে।
– মৃত ব্যক্তির প্রথম ঈদে তার বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানানো অনুচিত এবং তা পরিত্যাগ করা উচিত।
– মৃত্যুর পরে কোনও মহিলাকে তার পৈতৃক কবরস্থানে স্থানান্তর করার অনুশীলনটি আইনত বাধ্যতামূলক নয়। তাকে তার স্বামী বা সন্তানদের কবরস্থানে দাফন করা উত্তম।
– প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের মৃত ব্যক্তির পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
– ইসলামী আইন দাফনের পরে সমবেদনা জানানোর জন্য তিন দিনের সময়সীমা মঞ্জুর করে, অনুপস্থিত ব্যক্তিদের পরে সমবেদনা জানাতে ব্যতিক্রম ছাড়া।
– একবার তেলাওয়াত করার পর ফাতিহা আদায় করার নিয়তে মৃত ব্যক্তির ঘরে একাধিকবার যিয়ারত করা মাকরূহ বলে গণ্য হবে।
– ইমারতে ইসলামিয়ার কর্মকর্তারা তাদের মৃত আত্মীয়দের জন্য ফাতিহার প্রকাশ্যে ঘোষণা করবেন না; তারা প্রকাশ্য ঘোষণা ছাড়াই তিন দিনের জন্য তাদের বাড়িতে ব্যক্তিগতভাবে ফাতিহা পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
– মুক্তিপণ পরিশোধ করার অসিয়ত না করেই মারা গেছেন, এমন ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রক্রিয়া বা হিলাহ ইস্কাত পরিচালিত হবে, আর তা হানাফি ফিকহ অনুসারে করতে হবে।

হজ ও উমরাহ থেকে ফিরে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও অনুপযুক্ত রীতি পরিহার:

কিছু অঞ্চলে হজ ও উমরাহ থেকে ফেরার পর অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন, এলাকাবাসী ও অতিথিদের জন্য দান-খয়রাত করা, ব্যয়বহুল উপহার বিতরণ করার প্রচলন দেখা যায়। যদিও এই রীতিগুলো ধর্মীয় অনুমোদন পায়নি, এটি অনেক মানুষের জন্য আর্থিক সংকট সৃষ্টি করেছে, যার ফলে অনেকে হজ বা উমরাহ পালনে বিলম্ব করে বা সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হয়।

অতএব, সমস্ত হাজিদের প্রতি পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে, তারা যেন এই ধরনের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ক্ষতিকর সামাজিক রীতিগুলো থেকে বিরত থাকেন।


তথ্যসূত্র:
1. Decree of the Esteemed Amir-ul-Momineen (may Allah protect him) Regarding prevention of improper customs during weddings, calamities, and upon return from Hajj and Umrah
– https://tinyurl.com/36823zp4

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট || ইমারতে ইসলামিয়ায় ২২৬৯ তরুণের সেনা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন
পরবর্তী নিবন্ধগাজার একমাত্র ‘বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতাল’ গুঁড়িয়ে দিল দখলদার ইসরাইল