ভারতের ১৪ বিলিয়ন ডলারের ওয়াকফকৃত মুসলিম সম্পত্তি লুট করছে সরকার

0
77

ভারতে মুসলিমদের ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যাপকভাবে লুট হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে প্রায় ২৫০টি বাড়ি, দোকান এবং একটি শতাব্দী প্রাচীন মসজিদসহ বেশ কিছু অবকাঠামো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। এর ফলে ২.১ হেক্টর (৫.২৭ একর) জমি সম্পূর্ণভাবে উজাড় হয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উজ্জয়িনী শহরে একটি হিন্দু মন্দিরের সম্প্রসারণের জন্য বিজেপি সরকার মুসলিমদের ‘ওয়াকফ’ জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৪ বিলিয়ন ডলারের মূল্যমানের ওয়াকফ সম্পত্তি লুণ্ঠনের একটি বৃহত্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত করছে। গত ২৫ মার্চ কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উজ্জয়িনী শহরের ওয়াকফ সম্পত্তি মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ছিল। ‘ওয়াকফ’ হলো মুসলিমদের দ্বারা ধর্মীয় বা দাতব্য কাজে দান করা সম্পত্তি, যা বিক্রি বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। তবে ভারত সরকার এই নিয়ম উপেক্ষা করে উজ্জয়িনীর ওয়াকফ জমি ‘মহাকাল করিডোর’ নামে এক সরকারি প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ করেছে। মহাকাল করিডোর প্রকল্পটি আসলে উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প, যা হিন্দু ধর্মীয় অবকাঠামো সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে।

ভারতে ২০ কোটির বেশি মুসলিমের আবাসস্থলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ওয়াকফ সম্পদ রয়েছে, যার পরিমাণ ৮,৭২,০০০ এরও বেশি এবং আনুমানিক মূল্য ১৪.২২ বিলিয়ন ডলার। প্রতিটি রাজ্য ও ফেডারেল অঞ্চলে ওয়াকফ বোর্ড এসব সম্পত্তি পরিচালনা করে, যা সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের পর তৃতীয় বৃহত্তম। ভারতীয় সংসদে এই সপ্তাহে ওয়াকফ আইন সংশোধনী নিয়ে আলোচনা হতে পারে, যা সরকারের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি এই সংশোধনী বিলটি প্রস্তাব করেছে। মুসলিম গোষ্ঠীগুলোর অভিযোগ, মোদি প্রশাসন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার জন্য তার সংসদীয় শক্তি ব্যবহার করছে।

মধ্যপ্রদেশ ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্য, এবং এটি বেশিরভাগ সময়ই বিজেপির শাসনাধীন ছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বিজেপি নেতা মোহন যাদব মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর, আগামী ২০২৮ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া কুম্ভমেলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মহাকালেশ্বর মন্দিরের আশপাশের মুসলিম ওয়াকফ সম্পত্তিগুলো ধ্বংস করা মূলত কুম্ভমেলার জন্য জমি অধিগ্রহণের অংশ। বিজেপি সরকার পরিকল্পিতভাবে এই জমি দখল করছে, যাতে কুম্ভমেলার আয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা তৈরি করা যায়।

অভিযোগ উঠেছে, রাজ্য কর্মকর্তারা ১৯৮৫ সালের একটি সরকারি নথিকে উপেক্ষা করেছেন, যেখানে উজ্জয়িনীর ওই স্থানটিকে মুসলিম কবরস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, এবং সেখানে একটি ঐতিহাসিক মসজিদও ছিল। তবে বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে ওই জমির প্লট বিক্রি করেছেন, যার ফলে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ২৫০টিরও বেশি স্থাপনা বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

আল জাজিরার প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুনে এক রাজস্ব কর্মকর্তা ওয়াকফ জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান। তিনি জানান, বাসিন্দারা ১৯৮৫ সালের গেজেট বিজ্ঞপ্তি দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন এটি ওয়াকফ জমি। এরপর উজ্জয়িনী জেলা প্রশাসন জানায়, যে ‘সামাজিক কারণে’ জমি অধিগ্রহণে অনুমতির প্রয়োজন নেই। আইনজীবী সোহেল খান বলেন, এই অধিগ্রহণ ওয়াকফ আইনের সরাসরি লঙ্ঘন।

সরকার জানুয়ারিতে উজ্জয়িনীতে ধ্বংস হওয়া বাড়ি ও দোকান মালিকদের ৩৩ কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছে। তবে অভিযোগ উঠেছে যে, অবৈধভাবে জমি দখলকারী ব্যক্তিরাই এই অর্থ পেয়েছে। আল জাজিরার প্রশ্নের উত্তরে মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান সানাওয়ার প্যাটেল বলেন, তিনি দলের আদেশ অনুযায়ী কাজ করবেন। তিনি আরও স্বীকার করেন যে, রাজ্যের ৯০ শতাংশ ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করা হয়েছে বা আদালতে মামলা চলছে।

মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখপাত্র আশিস আগরওয়াল দাবি করেছে, রাজ্য সরকার আইন অনুসরণ করে জমি অধিগ্রহণ করেছে। ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইনের অধীনে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় ওয়াকফ বোর্ডগুলোর ক্ষমতা পরবর্তী সময় ১৯৯৫ ও ২০১৩ সালে বাড়ানো হয়। সম্প্রতি মোদির মন্ত্রিসভা ওয়াকফ (সংশোধন) বিল, ২০২৪ খসড়া অনুমোদন করেছে, যার মধ্যে অমুসলিমদের ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ এবং জেলা প্রশাসনের কাছে ওয়াকফ সম্পত্তির বাধ্যতামূলক নিবন্ধনের প্রস্তাব রয়েছে।

বিরোধী দল আম আদমি পার্টির (এএপি) সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং বলেন, ‘এটি মসজিদ ও দরগাহ জমি দখলের শুরু।’ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী আনাস তানভীর বলেন, উজ্জয়িনী মামলা ‘রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ওয়াকফ জমির অবক্ষয়ের একটি বৃহত্তর জাতীয় উদ্বেগ’। তার মতে, ওয়াকফ সম্পত্তি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবস্থাপনা ও দখল দ্বারা জর্জরিত এবং প্রস্তাবিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৪ এই সমস্যাগুলো আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান প্যাটেল দাবি করেছেন, সরকার সংশোধনীগুলো এনেছে ‘বিদ্যমান সমস্যা ও অসঙ্গতিগুলোর সমাধান’ করতে। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো ভারত সরকারকে ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ দিতে পারে, যা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অনেক মুসলিম নেতা এবং আইনজীবী বলেছেন, বর্তমান আইনের অধীনে এসব জমি ব্যাপকভাবে দখল করা হয়েছে। তারা অভিযোগ করছেন, সরকার জেলা রাজস্ব কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ওয়াকফ জমি অবৈধভাবে ব্যক্তিগত মালিকানায় রূপান্তর করেছে।

মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ড ১৯৬০ ও ১৯৮০-এর দশকে দুটি জরিপ পরিচালনা করেছে, যেখানে ২৩ হাজারেরও বেশি সম্পত্তির ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল। পরবর্তী সময় তারা রেকর্ড ডিজিটালাইজ ও জিওট্যাগ করেছে। বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করছেন, সরকারি রাজস্ব রেকর্ড প্রায়ই স্বাধীনতা-পূর্ব জরিপের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, ফলে ওয়াকফ জমির তথ্য সঠিকভাবে আপডেট হয়নি। ১৯৮৫ সালের গেজেট অনুযায়ী, উজ্জয়িনীতে ১,০১৪টি ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল, কিন্তু রাজস্ব রেকর্ডে তা তালিকাভুক্ত নয়। ২০০০ সালের শেষ দিকে জমি রেকর্ড ডিজিটাইজেশনও সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যেখানে ওয়াকফ জমি মাঝে মাঝে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে রেকর্ড হয়েছে।

এমনকি ২০২১ সালেও মধ্যপ্রদেশ সরকার একটি ওয়াকফ সম্পত্তি এনজিওকে হস্তান্তরের অনুমতি দেয়, যেখানে বিজেপি নেতারা ট্রাস্টি হিসেবে যুক্ত ছিল। এছাড়াও, বিভিন্ন শহরে শত শত ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করা হয়েছে, যেখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অবৈধ নির্মাণ বা বিক্রয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের ইন্দোরে এক ওয়াকফ তত্ত্বাবধায়ককে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি ব্যক্তিগত লাভের জন্য ওয়াকফ জমি অবৈধভাবে বিক্রি করছিলেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি ও বেসরকারি দখল, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে ওয়াকফ সম্পত্তি মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এছাড়া, সাম্প্রতিক সংশোধনী ও নীতিগত পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে পারে।


তথ্যসূত্র:
1. How India’s $14bn Muslim endowments are being plundered, even by government
– https://tinyurl.com/bdzkjhce

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধইজতেমা মাঠকে জঙ্গির কারখানা বললো বিএনপি নেতা ফজলুর রহমান
পরবর্তী নিবন্ধব্যবসায়ীকে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়; গ্রেফতার ০৩ পুলিশ সদস্য