দেশের উপজাতি-অধ্যুষিত ও দারিদ্র্য-পীড়িত প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রবণতা ‘ভয়াবহ আকারে’ বেড়েই চলেছে। পশ্চিমা বিশ্বের অর্থায়নে পরিচালিত এনজিও ও খ্রিষ্টান মিশনারি সংস্থাগুলো সেবা ও উন্নত জীবনের প্রলোভনে উপজাতি ও দারিদ্র্য-পীড়িত হিন্দু মুসলিমসহ উপজাতীয় ধর্মে বিশ্বাসীদেরকে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করে চলেছে। খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচারে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তিকে তোয়াক্কা করছে না মিশনারিরা। বরং মুসলিম দাঈ কিংবা এ তৎপরতা সম্পর্কে সতর্ককারী স্থানীয় আলেমদেরকে নানা ধরনের চাপে রাখছে তারা। এমনকি প্রশাসনিক মাধ্যমেও এ সমস্ত দাঈকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ স্থানীয় দাঈদের।
‘পার্বত্য চট্টগ্রামের চিত্র ভয়াবহ’
রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি—তিনটি জেলা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃতি। পার্বত্য চট্টগ্রামে সবচেয়ে আশঙ্কাজনকভাবে খ্রিষ্টান মিশনারিরা কাজ করছে। উপজাতিদের বড় একটি অংশ এখন খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গেছে বলে জানাচ্ছেন অঞ্চলটিতে দাওয়াতি মেহনতের সঙ্গে জড়িত আলেম দাঈগণ। তাঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে কথা হয়েছিল ফাতেহ টুয়েন্টি ফোরের। নিরাপত্তা জনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় প্রতিটি এলাকাই আমার ঘোরা হয়েছে। দাওয়াতি কাজে এই এলাকায় এত বার যাওয়া হয়েছে যে, অনেক এলাকা নিজের এলাকার মতোই আমার কাছে পরিচিত। দুঃখজনক হলো, আজ থেকে ২০-২২ বছর আগে এখানে ১ পার্সেন্টরও কম খ্রিষ্টান থাকলেও বর্তমানে খ্রিষ্টান মিশনারিদের তৎপরতার দরুণ এখানকার বড় একটি অংশ খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘ছোট-বড় প্রায় ১৪টি উপজাতীয় গোষ্ঠীর বসবাস এই অঞ্চলে। তাদের মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট যে গোষ্ঠীগুলো, তাদের প্রায় সকলেই খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে নিয়েছে। গহীন পাহাড়ের ভেতর তাদের বসবাস, কিন্তু আপনি যদি সেখানে যান আর তাদের জীবনমান দেখেন, তবে মনেই হবে না, আপনি বাংলাদেশে আছেন, মনে হবে ওয়েস্টার্ন কোনো কান্ট্রিতে এসেছেন।
‘খ্রিষ্টান মিশনারিরা তাদের শিক্ষাদীক্ষা থেকে শুরু করে রাস্তা-ঘাট সব কিছু করে দিচ্ছে। বিনিময়ে তাদেরকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করছে। কনভার্টেড এসব খ্রিষ্টানদের সঙ্গে কথা বললে আপনি চমকো যাবেন। এদের ভাব ও আচারে মনেই হবে না এরা বাংলাদেশ নামক কোনো রাষ্ট্রকে স্বীকার করে। তাদের এমনও এলাকা আছে যেখানে খ্রিষ্ট মিশনারিদের দ্বারা প্রুফ করা। সেখানে যেতে হলে বিশেষ বাহিনীর পারমিশন লাগে। আর নির্দিষ্ট লোক ব্যতীত সেখানে ঢোকার পারমিশনও পাওয়া যায় না। রাঙ্গামাটির বড়কল উপজেলায় আছে এমন একটি এলাকা।
‘বান্দরবানের মিরিঞ্জা নামক একটা এলাকা আছে, সেখানের উঁচু এক টিলায় মং সম্প্রদায়ের বসবাস। যাদের অধিকাংশই খ্রিষ্টান হয়ে গেছে। খ্রিষ্টান মিশনারিদের কল্যাণে উন্নত হয়েছে তাদের জীবনমান। মং সম্পদায়ের নেতাদেরকে ‘কারবারি’ বলা হয়। সেখানে একবার সফরে গেলে এক কারবারির সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। সে জানাল, ধর্ম যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এমনটা ধারণায়ও ছিল না তাদের। একসময় তারা মনে করত জন্মসূত্রে মুসলিম না হলে কেউ মুসলিম হতে পারত না। এই খ্রিষ্ট মিশনারিরা আসার আগে তাদের কেউ কেউ মুসলিম হতে চাইলে এমন কেউ ছিল না, যে তাকে মুসলিম বানাবে। স্থানীয় বাঙালি মুসলিম যারা ছিল, তারা তাদেরকে মুসলিম সমাজে দাখিল করতে অস্বীকৃতি জানাত। খ্রিষ্টান মিশনারিরা এসে এখন তাদের মনোভাব বদলে দিয়েছে। দলে দলে তাই তারা খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে পাচ্ছে উন্নত জীবনমানের ব্যবস্থা।’
খ্রিষ্টান মিশনারিদের মুকাবেলায় এসব এলাকায় ওলামায়ে কেরামের দাওয়াতি কার্যক্রম কেমন জানতে চাইলে আলেম এ দাঈ বলেন, তাদের তুলনায় আমাদের কার্যক্রম প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাছাড়া আমরা সীমিত পরিসরে যারা কাজ করছি, তারাও নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। খ্রিষ্টান মিশনারিদের কৌশলী তৎপরতা এবং তাদের পাহারাদার উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হিংস্রতা নানাভাবে আমাদের বাধাগ্রস্ত করে। সেখানে নতুন করে কোনো মসজিদ-মাদরাসা স্থাপন করতে হলে ব্যাপক বেগ পেতে হয়। স্থাপন করলেও সেটা সেখানে মোতায়েনকৃত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্পের আশপাশে করতে হয়। পাহাড়ের ভেতরে করার কোনো সুযোগ নেই। খ্রিষ্টান মিশনারি ও তাদের নিরাপত্তা বিধায়ক উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো বাধা দেবে।
উত্তরাঞ্চলের দরিদ্র মুসলিমদেরকেও বানানো হচ্ছে খ্রিষ্টান
শিক্ষাদীক্ষা এবং সুবিধা বঞ্চিত উত্তরাঞ্চলেও খ্রিষ্টান মিশনারিদের তৎপরতা ভয়াবহ। উত্তরাঞ্চলের বন্যা কবলিত ও দারিদ্রপীড়িত জেলা কুঁড়িগ্রামে ব্যাপকভাবে তারা ধর্মান্তরের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষার আলো থেকে দূরে থাকা স্থানীয় মুসলমানদের নানা কৌশলে খ্রিষ্টান বানানো হচ্ছে। খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে যাওয়া এসব মুসলমানের অনেকে বুঝতেই পারছেন না যে তাঁরা খ্রিষ্টান হয়ে গেছেন।
স্থানীয় বেশ কয়েকজন দাঈ’র সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খ্রিষ্টান মিশনারিরা স্থানীয় লোকদের মধ্যে কুরআন-হাদিসের বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা সম্বলিত বিভিন্ন বই-পুস্তক বিতরণ করে। এবং এর মাধ্যমে মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর হজরত ইসা আলায়হিস সালামের শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়ে তাঁর অনুসরণের দাওয়াত দেওয়া হয়। বলা হয়, বর্তমান যে ইসলাম, সেটার তুলনায় ‘ঈসায়ি ইসলাম’ শ্রেষ্ঠ। কারণ ঈসা আলায়হিস সালাম জীবিত নবি আর মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম ‘মৃত’। তাই সকলের উচিত ঈসা নবির অনুসরণ করা।
এরকম নানা খোঁড়া যুক্তি এবং অর্থ ও জীবনমানের উন্নতির প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করা হয়। তবে খ্রিষ্টান হয়ে যাওয়া এসব লোককে বুঝতে দেওয়া হয় না যে তারা খ্রিষ্টান হয়ে গেছে। তাদেরকে বলা হয়, ভ্রান্ত ইসলাম থেকে সঠিক ইসলাম তথা ‘ঈসায়ি ইসলামের’ দিকে ফেরত আনা হয়েছে। তাই তারা এখন থেকে ‘ঈসায়ি মুসলিম’।
কুঁড়িগ্রামে খ্রিষ্টান এসব মিশনারির মুকাবেলায় সাধারণ মানুষদের মধ্যে ইসলামের সঠিক বাণী পৌঁছে দিতে কাজ করা কয়েকজন স্থানীয় দাঈ’র সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল ফাতেহ টোয়েন্টি ফোর থেকে। তাঁদের একজন উপরোক্ত তথ্যগুলো নিজের নাম গোপন করার শর্তে প্রদান করলেও অন্যান্য দাঈরা কথা বলতেই অপারগতা জানিয়েছেন। তাদের কথাবার্তায় ছিল ভয় এবং আতঙ্কের ছাপ।
এ ছাড়া টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নেও চলছে খ্রিষ্টান মিশনারিদের কার্যক্রম। সেখানকার দারিদ্র পীড়িত এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে সেবার আড়ালে ধর্মান্তরের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে খ্রিষ্টান মিশনারিরা। স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং কয়েকজন দাঈ’র সঙ্গেও মুঠোফোনে কথা বলার চেষ্টা করা হয়েছিল ফাতেহ টুয়েন্টি ফোর থেকে। কিন্তু নাম প্রকাশ করে বা বিস্তারিতভাবে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি কেউই। নাম গোপন রাখার শর্তে তাদের দুজন কেবল একটি ইউনিয়নের কথা বলেছেন। মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নে উপজাতিদের বসবাস রয়েছে। বেশ অনেক বছর ধরো খ্রিষ্টান মিশনারিরা সেবার আড়ালে ধর্মান্তকরণে কাজ করে আসছে। বিশ বছর আগেও যেখানে একজন মানুষও খ্রিষ্টান ছিল না, সেখানে এখন দলে দলে মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষা লাভ করেছে।
তাঁরা বলছেন, ডাক্তার এড্রিক বেকার নামের যে একজন খ্রিষ্টান ডাক্তার ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্লিনিকের প্রতিবেদন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’তে সম্প্রতি প্রচারিত হয়েছে, এবং মানবসেবার জন্য যিনি প্রশংসিত হচ্ছেন,সেই মূলত খ্রিষ্টান মিশনারিরই লোক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালিয়াকুরি ক্লিনিকটিও মিশনারির অর্থায়নে পরিচালিত। সেবার আড়ালে তাঁদের মূল উদ্দেশ্য দারিদ্রপীড়িত স্থানীয় মানুষদেরকে খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত করা।
স্থানীয় দাঈদের এমন আতঙ্কগ্রস্ততা এবং এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশের কারণ জানতে চেয়ে কথা হয়েছিল এই অঙ্গনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজধানীর কয়েকজন দাঈর সঙ্গে। তারা ফাতেহ টোয়েন্টি ফোরকে জানান, খ্রিষ্টান মিশনারিদের মুকাবেলায় বাংলাদেশে যারাই কাজ করছেন প্রত্যেকেই একটা চাপ ও হুমকির ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। কঠোর নজরদারির ভেতর রাখা হয়েছে তাদেরকে। এমনকি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনও নজরদারির আওতায় রয়েছে। বিশেষ করে স্থানীয় দাঈদের ওপর এই নজরদারিটা বেশি। তাদের সঙ্গে কারা যোগাযোগ করছে, কীভাবে করছে, এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।