মাদক বিরোধী অভিযানের নামে কক্সবাজারে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। মাদক বিরোধী অভিযানের নামে মানুষের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা আদায়ের উদ্দেশ্যে শুরু করে বন্দুকযুদ্ধ প্রতিযোগিতা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে-দেশে সবচেয়ে বেশি বন্দুকযুদ্ধে নিহতের ঘটনা ঘটেছে টেকনাফে। আর এই নৃশংস ঘটনার মূল হোতা প্রদীপ কুমার দাশ। চাহিদা মতো টাকা না দিলে লোকজনকে ধরে এনে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করা হতো। এছাড়াও অনেক রোহিঙ্গাকে বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করে অপকর্ম চালিয়ে যেতেন সদ্য প্রত্যাহার ও গ্রেফতার হওয়া ওসি প্রদীপ। আর বন্দুকযুদ্ধের আড়ালে তিনি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। সর্বশেষ ঈদুল আযহার আগের দিন ৩১ জুলাই সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে গুলী করে হত্যার মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন প্রদীপ কুমার, পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৭ পুলিশ সদস্য। এই নয় পুলিশের বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলায় ওসিসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা বর্তমানে র্যাব-১৫ এর হেফাজতে ৭ দিনের রিমান্ডে আছেন। আরও দুই জনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। পাশাপাশি ওসি প্রদীপ কুমার ও তার স্ত্রীর সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সাবেক মেজর সিনহাকে গুলী করে হত্যার অভিযোগ এনে এ ঘটনা আইনশৃঙ্খরা বাহিনীর পাশাপাশি তদন্ত করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) গোপন তদন্ত প্রতিবেদনে স্থানীয় টেকনাফ থানা পুলিশের বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, হত্যার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা পুলিশ একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যায়ও কোনরূপ দ্বিধা করেনি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে জানাগেছে, থানার ওসির নির্দেশ ছাড়া কোন অফিসার গুলী চালাতে পারে না। সিনহাকে গুলী করার ঘটনার প্রতক্ষ্যদর্শী বিবরণ থেকে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। গুলী করার আগে এসআই লিয়াকত তার মোবাইল ফোন থেকে ওসি প্রদীপের সাথে কথা বলে তার নির্দেশেই সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কোন কথা বলতে না দিয়েই সরাসরি বুকে পর পর গুলী করেন।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর ওসি প্রদীপ কুমার টেকনাফ থানায় যোগদান করেন। এর পর থেকে গত ২২ মাসে শুধু টেকনাফে ১৪৪টি কথিত বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে। আর এসব বন্দুকযুদ্ধের নামে ওসি প্রদীপ কুমার ২০৪ জনকে গুলী করে হত্যা করেছে। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে। যারা তার হাতে মারা গেছে, তাদের পরিবারগুলোও বর্তমানে নিঃস্ব হয়ে গেছে। যাকে ক্রসফায়ার করা হতো, তাকে ক্রসফায়ারের আগে অন্তত ১০ থেকে ১২ দিন থানা হাজতে রাখা হতো। এমন ঘটনাও রয়েছে মাসের পর মাস হাজতেই রাখা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে থানা হাজতে থাকা ব্যক্তির পরিবার পরিজনের কাছ থেকে ক্রসফায়ার না দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে আদায় করা হতো লক্ষ লক্ষ টাকা। পাশাপাশি স্বর্ণালংকার। কিন্তু শেষ সম্বল পর্যন্ত প্রদীপের হাতে তুলে দিয়েও বাঁচতে পারেনি অনেকেই। গত এক বছরে কক্সবাজারে ৫৩ রোহিঙ্গা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। যাদের ইয়াবা কারবারী বলে পুলিশ উল্লেখ করেছে। টেকনাফ থানার বহুল আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক’ বা বিপিএম পেয়েছিলেন। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দফতরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সব কটি ঘটনাতেই আসামী নিহত হন। প্রদীপ কুমার দাশ প্রায় ২২ বছরের চাকরিজীবনে ঘুরেফিরে বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
ওসি প্রদীপ গ্রেফতার হওয়ার পর মুখ খোলতে শুরু করেছেন ভুক্তভুগীরা। তারা ওসির অপকর্মের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন। মাদক নির্মূলের নামে বন্দুকযুদ্ধে লোকজনকে জিম্মি করে টাকা আদায়, এমনকি ধর্ষণে সহায়তার অভিযোগও উঠছে তার বিরুদ্ধে। প্রদীপের দানবীয় কর্মকান্ড থেকে রক্ষা পায়নি বোনের জায়গাও! অভিযোগ উঠেছে, অনৈতিক কর্মকান্ডে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে প্রদীপ আয় করেছেন শত শত কোটি টাকা। দেশ-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ থানা থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশের চাকরিজীবনের পুরোটাই সমালোচনা ও বিতর্কে ভরা। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তা নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে চাকরিজীবনে বরখাস্ত ও প্রত্যাহার হয়েছেন কমপক্ষে পাঁচবার। প্রতিবার অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ফিরেছেন স্বপদে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, প্রদীপ কুমার দাশ তিন বছর ধরে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। তার কাছে সবাই অসহায় ছিল। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার ওসি থাকাকালে বাদুড়তলায় বোরকা পরা এক বৃদ্ধাকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ব্যাপক সমালোচিত হন প্রদীপ। এ ঘটনার পর সারা দেশে তোলপাড় হয়। এরপর পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয় ওসি প্রদীপকে। অসংখ্য অভিযোগ থাকার পরও অতদওসি প্রদীপ কুমার ছিলেন এতদিন ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
একটি সূত্র জানায়, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও তার স্ত্রী চুমকী কারনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সম্প্রতি অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম কার্যালয়। সম্প্রতি এই অভিযোগটির অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে তাদের কাছে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এই দম্পতি আলাদাভাবে তাদের সম্পদের হিসাব কমিশনে জমা দিয়েছেন। দুদকের অনুসন্ধানে ওসি প্রদীপ কুমার ও তার স্ত্রীর নামে-বেনামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকার প্রমাণ মিলেছে। এর মধ্যে স্ত্রীর নামে চট্টগ্রাম মহানগরে ৬তলা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদের প্রমাণ পাওয়া যায়। বিদেশেও বাড়ি রয়েছে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই অসৎ পুলিশ অফিসারের সাথে ভারতীয় দূতাবাসের যোগসাজশের কথা উঠে আসছে নানা গণমাধ্যমে । দৈনিক সংগ্রাম