যুগে যুগে যেভাবে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা

0
1635
যুগে যুগে যেভাবে ইসরায়েলকে রক্ষা করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্টরা

গাজায় অভিশপ্ত ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলায় বেড়েই চলেছে মৃতের সংখ্যা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবাদী অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিমান হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত অন্তত ৬১ শিশুসহ ২১২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ শ জন। ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে শত শত বাড়ি। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বজুড়ে। মানবতার বুলি আউড়ানোর খোলসে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী আমেরিকার চরিত্র বুঝতে শুরু করেছে সাধারণ থেকে সাধারণরাও।

জো বাইডেনই সন্ত্রাসী আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট নন যে কিনা সমালোচনা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলের হামলা ও নির্যাতন সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

অতীতে ক্রুসেডার প্রেসিডেন্টদের দীর্ঘ তালিকায় বাইডেনের পূর্বসূরিরা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে শর্তহীনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন ও সামগ্রিক দিক থেকে দেশটিকে ‘রক্ষা’ করেছে।

জো বাইডেন:

গতকাল (১৮ মে) ক্রুসেডার বাইডেন গাজায় ‘যুদ্ধ বিরতি’র আহ্বান জানালেও তার দেশ ইসরায়েলের কাছে ৭৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির পরিকল্পনা করছে।

কয়েকদিন আগে গাজায় একটি বহুতল আবাসিক ভবনে হামলা করে আল-জাজিরা ও বার্তা সংস্থা দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের অফিস ধ্বংস করে দিয়েছে অভিশপ্ত ইসরায়েল। একই দিনে ইসরায়েলি বিমান হামলায় এক পরিবারের ১০ সদস্য নিহত হন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ওই দিনও ইসরায়েলের প্রতি তার নগ্ন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

গত শনিবার (১৬ মে) হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বারের মতো ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে ফোন করে ফিলিস্তিনিদের রকেট হামলা থেকে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ বিষয়ে দৃঢ় সমর্থনের কথা জানিয়েছে।

২০২১ সালের চলতি মে মাসে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা চলাকালে জো বাইডেন দুই বার বিবৃতি দিয়ে ইসরায়েলের প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। ইসরায়েলি হামলাকে সমর্থন করে বিবৃতিতে জানিয়েছে, গাজা থেকে রকেট ছোড়ার পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার আছে।

বাইডেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারাও ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়া, হামলার নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি বিবৃতিও প্রচার করতে দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। যেটি সংঘাত বন্ধে কার্যকর হতে পারত।

ডোনাল্ড ট্রাম্প :

২০১৮ সালের মে মাসে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েল ও এর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কট্টর সমর্থক ছিলেন। সেই মাসে ফিলিস্তিনে হামলা চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যার পরও ইসরায়েলের যে কোন প্রকার সমালোচনার চেষ্টাও বাতিল করে দিয়েছিল সে।

সে সময় ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নিলে বিক্ষুব্ধ হন ফিলিস্তিনিরা। তারা ‘মহা সমাবেশের’ ডাক দিয়ে মিছিলে অংশ নিলে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের ওপর গুলি চালায়।

ইসরায়েলের সেই হামলার দায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চাপিয়ে হোয়াইট হাউজের তৎকালীন ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি রাজ শাহ বলেছিল, ‘এই নির্মম হত্যার দায় ফিলিস্তিনকেই নিতে হবে।’ সে ‘উসকানি’ দেওয়ার জন্য ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠনগুলোকে দায়ী করে। সেইসাথে ‘ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ উদ্ধৃতিটিও স্মরণ করিয়ে দেয়।

বারাক ওবামা :

২০১৪ সালের জুলাইয়ে গাজা উপত্যকায় স্থল হামলার আগে টানা ১০ দিন বোমাবর্ষণ করেছিল ইসরায়েল। সে মাসের ১৮ তারিখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ফোন করে তাদের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি তার সমর্থনের কথা জানায়।

ওবামা বলেছিল, ‘কোনো দেশেরই সীমান্ত থেকে রকেট হামলা বা তার সীমান্তে সন্ত্রাসীদের সুড়ঙ্গ তৈরি মেনে নেওয়া উচিত নয়।’

সে আরও বলেছিল, ‘এটা নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্র, আমাদের বন্ধু ও মিত্রশক্তি আরও বেশি সংঘাত এবং সাধারণ নাগরিকদের প্রাণহানির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’

বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে, ওই সময় ইসরায়েলি হামলায় গাজায় দেড় হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ৫০০-র বেশি শিশু ছিল।

২০১২ সালের নভেম্বরে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় অভিযান চালিয়ে ১০০ জনেরও বেশি বেসামরিক লোককে হত্যা করে।

বারাক ওবামা তখনো ইসরায়েলকে সমর্থন করে বলেছিল, ‘পৃথিবীর কোনো দেশই সীমান্তের বাইরে থেকে তার ভূখণ্ডে মিসাইল নিক্ষেপ সহ্য করবে না। সুতরাং, মানুষের বাড়িতে মিসাইল নিক্ষেপের হাত থেকে ইসরায়েলের “আত্মরক্ষার অধিকারের” প্রতি আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি।’

২০০৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর সকাল থেকে গাজায় ‘অপারেশন কাস্ট লিড’ নামে আক্রমণ শুরু করে অভিশপ্ত ইসরায়েল।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, ২২ দিন ধরে চলা ওই আক্রমণে ১,৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হন, তাদের অধিকাংশই সাধারণ নাগরিক। এ ছাড়া, দেশটির বেশিরভাগ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

জর্জ ডব্লিউ বুশ :

২০০৯ সালের ২ জানুয়ারি তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ হোয়াইট হাউসে তার মেয়াদের শেষ সপ্তাহে ওই হামলার জন্য শুধু ফিলিস্তিনকেই দায়ী করেছিলেন।

তখন এনবিসি নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ছড়িয়ে পড়া সংঘাতের জন্য ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোই দায়ী বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট বুশ’।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে দখলদার ইসরায়েলের অভিশপ্ত নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদ পরিদর্শনে গেলে তার বিরুদ্ধে গণপ্রতিবাদ জানায় ফিলিস্তিনিরা। প্রতিবাদি মিছিলে ইসরায়েলি নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে সাত ফিলিস্তিনি নিহত হন। এরপর ‘আল-আকসা ইন্তিফাদা’ নামে দ্বিতীয় গণজাগরণের ডাক দেওয়া হয়।

সে সময় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী নির্বিচারে মানুষ হত্যা করায় তারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় অন্তত ৩,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইসরায়েলি আগ্রাসনে কোন বাধা দেয়নি। এ ছাড়া, ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে শ্যারনের প্রত্যাখ্যানকেও সমর্থন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বুশ।

বিল ক্লিনটন :

১৯৯৬ সালের এপ্রিলে দক্ষিণ লেবাননের কানায় জাতিসংঘের অফিস চত্বরে আশ্রয় নেওয়া নিরীহ মানুষের ওপর ইসরায়েলের সামরিক হামলাকে সমর্থন করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন।

ওই হামলায় ১০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন কয়েক শ।

ইসরায়েল দাবি ছিল, ভুলবশত ওই হামলা করা হয়েছে।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কোনো সম্ভাবনা পুরাপুরি বাতিল করা সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়-ক্ষতির ধরন প্রমাণ করে জাতিসংঘ চত্বরে বোমা হামলা ছিল কারিগরি ও পদ্ধতিগত ভুল।’

ওই হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পর আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (আইপ্যাক) উদ্দেশে বিল ক্লিনটন বলেছিলেন, ‘কানায় লেবাননের শিশুদের রাখা হয়েছিল এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এটা হিজবুল্লাহর কৌশল ছিল।’ আর এভাবে সে-ও ইসরায়েলের আক্রমণকে তাদের ‘আত্মরক্ষার’ কৌশল হিসেবে বৈধতা দিয়েছিল।

রোনাল্ড রিগ্যান :

যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ইসরায়েলের ক্ষমতা বৃদ্ধিকে ‘অন্যান্য কৌশলগত সম্পদে’ পরিণত করতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ সামরিক প্রযুক্তি সহায়তা দেয়।

ইসরায়েলকে অভিযুক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা ও দেশটির কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের বিষয়ে রিগ্যানকে প্রশ্ন করা হলে সে সাংবাদিকদের বলেছিল, ‘পরিস্থিতি খুবই জটিল, এবং আমরা যে লক্ষ্য অর্জন করতে চাই বর্তমানে আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করছি।’

এ ছাড়া, ইসরায়েলকে অভিযানের বিষয়ে ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে সে বলেছিল, ‘এ ঘটনায় আমরাও অন্যদের মতো অবাক হয়েছি। তবে, আমরা কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে এবং বিশ্বাস করি একটা সমাধান আসবে।’

রিচার্ড নিক্সন :

১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়ার নেতৃত্বে কয়েকটি আরব দেশ এক যোগে অভিযান চালিয়ে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা সিনাই উপদ্বীপ ও গোলান মালভূমি উদ্ধারের চেষ্টা করে।

প্রতি আক্রমণে ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বিমান হামলা চালানোর জন্য অস্ত্র সরবরাহ করে। দ্রুততম সময়ে সেসব অস্ত্র সরবরাহ করায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডে মেয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশংসা করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্রের কারণে যুদ্ধের ফলাফল ঘুরে গিয়েছিল। দ্রুত অস্ত্র সরবরাহ করায় নিক্সন তার দেশের কংগ্রেসের প্রশংসা করেছিল।

লিন্ডোন বি জনসন :

১৯৬৭ সালের জুনে মিশরে বিমান হামলা করে ইসরায়েল। যার ফলে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ শুরু হয়। সেই যুদ্ধে জর্ডান ও সিরিয়াও জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে গাজা, পশ্চিম তীর ও সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল।

যুক্তরাষ্ট্রের সে সময়কার প্রেসিডেন্ট লিন্ডোন বি জনসন ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক টাইমস-এ এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারি, যখন শত্রুপক্ষ তাদের সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে, গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং যখন রাজনৈতিক নেতারা একটি জাতিকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়ে বাতাস ভারি করে তোলে, তখন লোকেরা অবশ্যই তাদের নিজেদের মতো করেই সিদ্ধান্ত নেয়।’

হ্যারি এস ট্রুম্যান :

১৯৪৮ সালের ১৪ মে জুইশ অ্যাজেন্সির প্রধান স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দেন যখন সেই ভূমিতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের সমাপ্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান তখনই এ অবৈধ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

ট্রুম্যানের সই করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই সরকার জানতে পেরেছে যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছে, এবং অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি চাওয়া হয়েছে।’

‘যুক্তরাষ্ট্র নব গঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্থায়ী সরকারকে ডি-ফ্যাক্টো কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।

 

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধগাজায় যাওয়া ত্রাণের ট্রাক আটকে দিল বর্বর ইসরায়েল
পরবর্তী নিবন্ধসোমালিয়া | মুজাহিদদের হামলায় ১০ এরও বেশি মুরতাদ সৈন্য হতাহত