২০২০ সালে শুধুমাত্র ভারতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ট্রানজিট আশুগঞ্জ-আখাউড়া রোড প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। যা ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হবার কথা থাকলেও শেষ না হওয়ায়, দালাল হাসিনা সরকার প্রকল্পটির সময় বৃদ্ধি করেছে। সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০২৫ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
ট্রানজিট রাস্তা তৈরি হতে না হতেই এর কুফল ভোগ করতে শুরু করেছে দেশবাসী। ট্রানজিট এলাকায় স্থানীয়রা পড়েছে চরম বিপদে। প্রতিদিনই তীব্র যানযটে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তা বন্ধ থাকে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয়রা।
চার লেনে রাস্তা নির্মাণ করতে ভরাট করা হয়েছে রাস্তার দু’পাশের পুরোখাল। খালগুলো পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিশাল জেলাটির একমাত্র নিষ্কাশনের উৎস হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল।
বর্তমানে দু’পাশের এলাকার জন্য রাখা হয়নি কোন রকম পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। যদিও বলা হচ্ছে পরবর্তীতে রাস্তার পাশ দিয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা হবে। তবে কবে নাগাদ ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি করা হবে তা কারো জানা নেই। স্থানীয়দের মনে বার বার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে যে, দু’পাশের বিশাল খাল বন্ধ করে ড্রেনেজ ব্যবস্থা কতটা উপকারী হবে? বর্তমানে অল্প পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেই তলিয়ে যাবে শত শত হেক্টর ফসলি জমি। পানি বন্দী হয়ে পড়বে শত শত পরিবার। এছাড়াও বর্ষা মৌসুমে বন্যার পানি নিষ্কাশন এসব ড্রেনেজ আদৌও কোন কাজে আসবে কিনা?
এছাড়াও প্রতি বছর হাজার হাজার কৃষক বোরো মৌসুমে ফসল উৎপাদনের জন্য আশুগঞ্জ পলাশ-অ্যাগ্রো ইরিগেশন সেচ প্রকল্পের (সবুজ প্রকল্প) পানি ব্যাবহার করতো। বর্তমানে দু’পাশের খাল ভরাট করায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুরো জেলার সরাইল উপজেলার সেচ প্রকল্পের বোরো ধান চাষীরা বিপাকে পড়েছে। জমিতে ধান রোপণ করতে পারেনি অসংখ্য কৃষক।
আগে মহাসড়কের পাশের এই খাল দিয়ে পানি প্রথমে জাফর খালে প্রবাহিত হতো। এরপর জাফর খালের সঙ্গে যুক্ত বোয়ালিয়া, নাইজুর, লাহুর, বুড্ডা ও উত্তরের খাল হয়ে সরাইল উপজেলার সদর, পানিশ্বর, কালীকচ্ছ, নোয়াগাঁও, চুন্টা ও শাহবাজপুর ইউনিয়নের ১০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হতো। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কৃষক। গত ৪০ বছর ধরে আশুগঞ্জ সবুজ প্রকল্পের পানি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষ করে আসছেন। কিন্তু শুধুমাত্র ভারতের একক স্বার্থ কক্ষা করতে গিয়ে তাদের সকলকে বঞ্চিত করা হচ্ছে জীবন-জীবিকা থেকে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, পানিশ্বর ইউনিয়নের পানিশ্বর, বিটঘর, বেড়তলা, নাইলা, সদর উপজেলার কুট্টাপাড়া, সৈয়দটুলা, চুন্টা ইউনিয়নের রসুলপুর, চুন্টা বড়বল্লা এলাকায় পানিপ্রবাহ কমে গেছে। সবুজ প্রকল্পের প্রধান খাল কুট্টাপাড়া অংশের পর নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইসলামাবাদ থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত খালটি সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। ওই খালের প্রায় ছয় কিলোমিটার অংশে কোনো পানি নেই। এ অংশে অন্তত ২৫টি সেচ পাম্প সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। পানিস্বল্পতার কারণে বহু সেচপাম্প বিকল হয়ে গেছে। এতে বিস্তীর্ণ এলাকায় পানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অনেক কৃষক বাধ্য হয়ে বাড়তি টাকা খরচ করে স্থানে স্থানে অনেক অগভীর সেচপাম্প (শ্যালো মেশিন) বসিয়েছেন। এ বছর খাল ভরাটের কারণে কৃষকেরা সঠিক সময়ে ধানের চারা রোপণ করতে পারেননি। অন্যদিকে সঠিক মাত্রায় পানিও পাচ্ছেন না।
ইসলামাবাদ গ্রামের কৃষক কুদরত আলী, আবদুল আলীম, আঞ্জির আলী, কুট্টাপাড়া গ্রামের আহামদ আলী জানান, তাঁরা জমিতে পানি দিতে পারছেন না। শাহবাজপুর গ্রামের কৃষক আলিম মিয়া বলেন, ‘৭ কানি (৩০ শতক = ১ কানি) জমিতে ধান চাষ করছি। সবুজের পানি না পাইয়া স্কিম ম্যানেজার সেলু (শ্যালো মেশিন) বসাইছে। তাতেও পানি দেওয়া যাইতেছে না। গত ১৭ দিন ধইরা জমিতে পানি নাই।’ সরাইল উপজেলার ইসলামাবাদ গ্রামের কৃষক আফতাব মিয়া বলেন, ‘সেচ প্রকল্পের অধীন আমার তিনটি সেচপাম্প রয়েছে। খালে পানি না থাকায় আমার দু’টি সেচপাম্প বিকল হয়ে গেছে। ২০০ কানির বেশি আবাদি জমি নিয়ে বিপাকে পড়েছি। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো সুরাহা পাচ্ছি না।’ এছাড়াও অসংখ্য কৃষক জমিতে এ বছর ধান রোপণ করতে পারেনি।
ট্রানজিটের ক্ষতি নিয়ে অতীতে দেশের ওয়াকিবহাল মহল সরব থাকলেও, বর্তমানে কেউই বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না, হয়তো কোন অদৃশ্য চাপের কারণে।
অন্যদিকে হলুদ মিডিয়া নর্তকীদের খবর ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করলেও, হাজার কোটি টাকা লোকসানের ভারতীয় ট্রানজিট রোড নিয়ে তাদেরকে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না।
ট্রানজিট রোডের চরম ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে স্থানীয়দের বিভক্ত করে ফেলা। অর্থাৎ রাস্তার দু’পাশের স্থানীয় বাসিন্দারা বর্তমানে যেভাবে যাতায়াত করতে পারে অদূর ভবিষ্যতে সেটি আর পারবে না। ব্যাপকভাবে কথিত আছে যে, রাস্তার দু’পাশ ঘেঁষে উঁচু দেওয়াল তুলে দিবে নির্মাণকারী ভারতীয় দখলদারদের কোম্পানি। তখন এক পাশের বাসিন্দারা অন্য পাশে যেতে চাইলে পারি দিতে হবে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভিতরের একটি বৃহৎ জেলা ব্রহ্মণবাড়িয়াকে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের মতো বিভক্ত করতে চাইছে ভারত।
উল্লেখ্য যে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে ব্যয় হবে প্রায় পাঁচ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। প্রকল্পের বিবরণীতে দেখা যায়, মোট অর্থের মধ্যে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসাবে আসবে প্রায় দুই হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকার দেবে প্রায় দুই হাজার ৮০৯ কোটি টাকা।
বিশাল এই প্রকল্পের পুরোপুরি সুবিধাভোগী ভারত। আর ভারতীয় ঋণের সুদের টাকা পরিশোধ করতে হবে এ দেশের মুসলিম জনগনকেই।
এছাড়াও প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে। প্রকল্পের সকল কাঁচামাল ও শ্রমিকসহ সকল জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে ভারত থেকেই। অর্থাৎ কইয়ের তেলে কই ভেজে এদেশের মুসলিমদের টাকা শুষে নিয়ে যাচ্ছে ভারত।
প্রতিবেদক
: ইউসুফ আল-হাসান
তথ্যসূত্র:
——–
১. খাল ভরাট করে সড়ক উন্নয়ন, পানিসংকটে হাজারো কৃষক-
– https://tinyurl.com/2p8tv5zw
২. আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেন সড়ক প্রকল্পের খরচ ও সময় বাড়িয়েছে বাংলাদেশ
– https://tinyurl.com/3svm5php