মধ্য এশিয়ার ৯৬ শতাংশ সুন্নি মুসলমানের দেশ তাজিকিস্তান। দেশটির জনগণ ফার্সি ভাষার পাশাপাশি তাজিক উপভাষায় কথা বলেন। বিজ্ঞান, রহস্যবাদ, সাহিত্য, কবিতা এবং ইসলামের প্রতি অগাধ ভালোবাসার জন্য দেশটি বিখ্যাত। বুখারা, সকরকন্দের মতো ইসলামি ইতিহাসের ঐতিহাসিক অনেক শহরই ছিলো দেশটির অন্তর্গত। আর এসব কারণে দেশটিকে ইসলামি সভ্যতার দোলনাও বলা হয়।
৮০-৯০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে দেশগুলো স্বাধীন হয়েছিল তারমধ্যে তাজিকিস্তান অন্যতম। কিন্তু এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেন নি দেশটির মুসলিম জনগণ। কেননা ১৯৯২ সালের পর দেশটির ক্ষমতায় আসে ইমাম আলী রহমান নামক এক স্বৈরশাসক। সে ছিলো রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। তাজিকিস্তান স্বাধীনতা লাভের পর এই কমিউনিস্ট নেতা দেশে “পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি” নামে নতুন একটি দল গঠন করে। এসময় সে নিজেকে একজন দেশপ্রেমিক ও তাজিক বংশোদ্ভূত নেতা বলে দাবি করতে থাকে।
কমিউনিস্ট নেতা আলী সর্বদা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের কথা বলে চিৎকার করতো। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সে নিজের আসল চেহারা দেখাতে শুরু করে। এসময় তার দল অন্যান্য বিরোধী দলগুলোকে ধ্বংস করে এবং ৩০ বছরের জন্য দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করে। এরপর শুরু হয় দেশটির জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর একের পর এক অঘাত। ইসলাম বিরোধী নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে তাজিক জনগণের সোনালী ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা এবং সংস্কৃতিকে সে মুছে ফেলতে শুরু করে। আর ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এই লড়াই ইমাম আলীর দীর্ঘ তিন দশকের শাসনের অভ্যাসে পরিণত হয়।
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভায়নক এই যুদ্ধে ইমাম আলী ও তার দল সরকারি তালিকায় নাম না থাকার অভিযোগ এনে দেশের ১০ হাজারেরও বেশি মসজিদ এবং ইসলামি শিক্ষা কেন্দ্রের দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে এর কোনটিকে চা-হাউস, রেস্তোরাঁ এবং ডিস্কোতে পরিণত করা হয়। এসময় সরকারি তালিকায় নেই এমন মসজিদে নামাজ পড়া এবং এমন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়।
এমনিভাবে ২০১২ সালে দেশটির ইসলাম বিরোধী স্বৈরশাসকের আদেশে হাজার হাজার আলেম, প্রভাষক এবং ইসলামি বিজ্ঞানের ছাত্রদের গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ করা হয়। সেই সাথে ধর্মীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞান নিয়ে ইসলামিক ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা এবং আরব বিশ্বে তাজিক ছাত্রদের ভ্রমণ কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর ২০১৫ সালে দেশটির খাতলান প্রদেশে দাঁড়ি ও হিজাবে বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সরকার। প্রদেশটিতে ঐবছর ১২,৮১৮ জনের দাড়ি জোরপূর্বক কামানো হয়। একই প্রদেশে ঐ বছর ৬,৭০০ জন মুসলিম নারীর হিজাব জোরপূর্বক মাথা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।
এরপর এটি ধীরে ধীরে পুরো দেশে বাস্তবায়ন করতে থেকে দেশটির সরকার। ফলে গত ১০ বছরে দেশ জুড়ে হাজার হাজার পুরুষকে জোর করে শেভ এবং মহিলাদের হিজাব খুলতে বাধ্য করে পুলিশ সদস্যরা।
একই সময় সরকারিভবে নিয়ম করা হয় যে, সরকারি লাইসেন্স সহ ৪৫ বছরের কমবয়সী কেউ দাড়ি রাখতে পারবে না এবং দাড়ি ৩ সেন্টিমিটারের বেশিও বাড়ানো যাবেনা। একই সাথে পাসপোর্টে দাড়ি সহ ছবি তোলা নিষিদ্ধ করা হয়।
এরপর ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি এক বক্তব্যে বলে যে “মহিলাদের দ্বারা ব্যবহৃত হেডস্কার্ফ এবং কালো কাপড় তাজিক ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, আর লম্বা দাড়ি বাড়ার সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। তাই বাহ্যিক চেহারা দিয়ে তাকওয়া প্রদর্শন বন্ধ করুন, বরং এর পরিবর্তে আল্লাহকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসুন”।
একইভাবে তাজিকিস্তানের নাগরিকদের হজ্জে যাওয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তবে ৪৫ বছর পূর্ণ হলে কিছু শর্ত মেনে হজ্জ করতে পারবে জনগণ। এসময় দেশটির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে দাড়িওয়ালা পুরুষ এবং হিজাব পরিহিত মহিলাদের প্রবেশও নিষিদ্ধ করা হয়।
কমিউনিস্ট নেতা ইমাম আলীর সরকার, ১৮ বছরের কম বয়সী যুবকদের মসজিদে যাওয়া এবং মাদ্রাসায় ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই সাথে সরকারি লাইসেন্স ছাড়া ধর্মীয় ইলম শিখানোও নিষিদ্ধ করা হয়, চাই তা শুধু কুরআন তিলাওয়াত শিখানোই হোক না কেন। একইভাবে মসজিদের বাহিরে ধর্ম নিয়ে কথা বলা এবং দাওয়াত দেওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়।
চলতি বছরের ৮মে দেশটির সংসদে মুসলমানদের পবিত্র ২টি ঈদ উদযাপনের পাশাপাশি মাথায় স্কার্ফ পরা নিষিদ্ধ করার আইন চেয়ে দাবি করা হয়। গত ৮ জুন, দেশটির সংসদের উচ্চকক্ষ “ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি” প্রশ্নবিদ্ধ উক্ত আইনটি অনুমোদন করে। আর গত ১৯ জুন দেশটির জাতীয় পরিষদের ১৮তম অধিবেশনে সংসদের স্পিকার রুস্তমের সভাপতিত্বে গৃহীত ভোটের মাধ্যমে প্রশ্নবিদ্ধ আইনটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
হেডস্কার্ফকে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে, এটি দেশের সংস্কৃতির অন্তর্গত নয় বরং বিদেশী পোশাক। আর সংসদে সংজ্ঞায়িত করা আইনের ফলে, মুসলিম মহিলারা দেশে হেডস্কার্ফ পরতে পারবেন না। উপরন্তু, ঈদ উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠান এবং এদিন বিবাহের পাশাপাশি শিশুরা ঈদ উদযাপনে অংশ নিতে পারবে না।
তাজিক সংবাদ সংস্থা এশিয়া-প্লাস নিউজের তথ্যমতে, সরকারি নতুন এই আইন লঙ্ঘনকারী বেসামরিক নাগরিকদের জরিমানা করা হবে ৭ হাজার ৯২০ তাজিকিস্তান সোমনি, কোম্পানিগুলোকে জরিমানা করা হবে ৩৯ হাজার ৫০০ সোমনি, সরকারি কর্মকর্তাদের ৫৪ হাজার সোমনি, আলেমদেরকে ৫৭ হাজার ৬০০ সোমনি।
এটি স্পষ্ট যে, তাজিকিস্তানে মুসলমানদের উপর চাপ সময়ের সাথে বাড়ছে। সেখানে এখন পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনের ইসলাম বিরোধী নীতির অনুসরণ করা হচ্ছে। আর দেশটির মুসলমানরা শাসিত হচ্ছেন রুশ কমিউনিস্টদের অবশিষ্টাংশ মুসলিম নামধারী নেতাদের দ্বারা।
তথ্যসূত্র:
1. په تاجکستان کې د امام علي رحمان مستبده واکمني او اسلام ضد نوې څپې
– https://tinyurl.com/mr496r8s
2. Ninkaan Wuxuu Islaamka Dal 98% Dadkiisu Muslimiin Yihiin!
– https://tinyurl.com/ycy23fe6